চরের মেয়ে-২
চরের মেয়ে-১
চরের মেয়ে-২
চরের মেয়ে-৩
চরের মেয়ে-৪
চরের মেয়ে-৫
খালাম্মা খুশি হলেন। বললেন, আপনি জানেন স্কুলে আমার রোল নম্বর কত ছিল?
আমি বললাম, জ্বি না।
তিনি হেসে দিয়ে বললেন, এটা কিন্তু আপনি অবশ্যই আন্দাজ করে বলতে পারতেন। কিন্তু আপনাকে চাপাবাজ বলবো বলে বলছেন না।
হেসে ফেললাম। বললাম, ঠিক ধরেছেন। তবে আপনার কথা শুনে বলতে সাহস পাচ্ছি যে আপনার রোল নম্বর এক ছিল। বলুন, হয়েছে?
সঠিক উত্তর বলতে পারার জন্য ধন্যবাদ। খালাম্মা বললেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছিলেন? আমি জিঞ্চাসা করি।
খালাম্মা জবাব দিলেন, আমার হাই-এ্যাম্বিশন নেই বলে যে খোটা দিলেন, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আমি এক বাপের এক বেটি। এই পরিবারে আমি যা বলি তাই হয়, এবং আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কোনদিন একটা টু-শব্দ করে না। এমন পরিবারে জন্মগ্রহণ করতে পেরে আমি আল্লাহ্র কাছে কৃতঞ্চ। আমার বাপ-দাদার ধন-সম্পদের কোন অভাব ছিল না। এত সুখের মধ্যে থেকে কষ্ট করে কেউ লেখাপড়া করতে চায়? আপনি শুনলে অবাক হবেন যে আমি তৃতীয় বছরও ফেল করেছিলাম। চারদিকে দুর্ণাম রটে গেল আমি টাকা খরচ করে এস.এস.সি-তে অমন ভালো রেজাল্ট জোগাড় করেছিলাম। আপনিই বলুন, তাই কি কোনদিন হয়? হলে তো এইচ.এস.সি পরীক্ষায়ও তা করতে পারতাম। পারতাম না?
জ্বি পারা যেত।
আমার জেদ ক্রমশ বেড়ে গেল। আমি দমবার পাত্রীই নই। আমি চতুর্থ বারের মত পরীক্ষা দিলাম। বলুন তো আমি কোন্ ডিভিশনে পাশ করেছিলাম?
আমি ধাঁধায় পড়ে গেলাম। এত জেদ নিয়ে পরীক্ষা দিলে তো একটা ভালো রেজাল্টই হওয়ার কথা। বেসিক্যালি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। কিন্তু তাহলে পরপর তিন বার ফেল করে কিভাবে? অতএব ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়াটা দুঃসাধ্য বটে। তদ্রূপ যেহেতু দৃঢ় প্রতিঞ্চা নিয়ে পরীক্ষা দেয়া, অতএব একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রীর পক্ষে তৃতীয় বিভাগ বা সামান্য পাশটাও মানানসই হয় না। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম, আপনি সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছিলেন।
খালাম্মা অবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য, কিভাবে বুঝলেন?
তাঁর অতি-বিস্ময়ভাব দেখে আমি ভাবলাম, এটাও আগের মতই ভান নয় তো? তারপরও, আমার যুক্তির কথা শুনে তিনি বললেন, ঠিকই, এটা কোন ভণিতার কথা না। আমি সত্যি সত্যি সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছিলাম। তবে সেবারের ট্র্যাজেডীর কথা শুনবেন? মাত্র দুটি নম্বরের জন্য আমি ফার্স্ট ডিভিশনটা মিস করলাম।
আমি বললাম, এতে কিন্তু আপনার জন্য বরং ভালোই হয়েছিল। আপনি ফার্স্ট ডিভিশন পেলে আরেকটা বদনাম বেরুতো যে টাকা খরচ করে ফার্স্ট ডিভিশন ম্যানেজ করেছেন।
আপনার সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করবো না।
তবে সব কিছু মিলিয়ে আপনার দুটি রেজাল্টই কিন্তু অসাধারণ। তা সত্ত্বেও আপনি লেখাপড়া ছাড়লেন কেন?
কে বলেছে আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম?
আপনি ডিগ্রী পাশও করেছেন? সত্যিই অসাধারণ!
এস.এস.সি আর এইচ.এস.সিতে আমাকে লাক ফেভার করেনি। কিন্তু ডিগ্রীতে কাটায় কাটায় ৪৫০ নম্বর পেয়ে সেকন্ডে ক্লাস পাই।
আমি বিসিমত হয়ে বলি, আপনি একজন সুশিক্ষিতা মহিলা, অথচ সাধারণ গৃহিণী। আপনার এ ডিগ্রীর কোন্ দাম আছে?
এ ব্যাপারে আমি আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করবো। একজন সাধারণ গৃহিণীর যে কোন লেখাপড়ার দরকার নেই এটা কিন্তু চরম ভুল ভাবনা। কেবল চাকরি-বাকরির উদ্দেশ্যেই লেখাপড়া করতে হবে, শিক্ষার উদ্দেশ্য তা নয়। শিক্ষা একজন মানুষকে সমৃদ্ধ করে। একজন শিক্ষিত মানুষ সর্বদা এবং সর্বক্ষেত্রেই শিক্ষক, কি তার নিজ পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, সমাজ - সর্বত্র। শিক্ষা মানুষের অন্তরের চোখ খুলে দেয়। শিক্ষা মানুষকে অনেক বড় করে। একজন শিক্ষিত মানুষ অন্তত নিজের কাছে নিজেকে বড় করে তুলতে পারে। মানেন আমার কথা?
আমি সংকোচবোধ করতে লাগলাম, আর এ মহিলাকে বোঝার চেষ্টা করতে থাকলাম। এঁকে দেখে এঁর বয়স বোঝার যেমন উপায় নেই, এঁর সাথে কথা না হলে এঁর বুদ্ধিমত্তার প্রখরতা সম্বন্ধেও কোন ধারণা পাওয়া যাবে না। অথচ কথাবার্তায় কি দারুণ চটুল, মনে হয় চৌদ্দ পনর বছরের কোন এক বালিকার সাথে কথা হচ্ছে।
আমি বললাম, আপনি একজন ঞ্চানী ও শিক্ষিত মহিলা, আপনার সাথে যুক্তিতে আমি হেরে যাব। তবে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন? আপনি তো ইচ্ছে করলেই অন্তত একটা শিক্ষকতার চাকরি নিতে পারতেন।
খালাম্মা হাসলেন। তারপর বললেন, আপনি আসলে আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
আমি ভাবলাম, না জানারই তো কথা। আজই প্রথম দেখা, জানবো কিভাবে?
আমি জিঞ্চাসা করলাম, সত্যি বলুন না, আপনি কি কিছুই করেন না?
তিনি বললেন, আমি গত পাঁচ বছর ধরে বেগম আয়েশায় শিক্ষকতা করছি। খুশি? বলেই খালাম্মা হাসতে লাগলেন।
আমার অবাক হবার পালা। আমার সত্যি এত কিছু জানা ছিল না। মহিলা তো দেখি রীতিমত একজন ম্যাডাম। এঁকে তো ম্যাডাম বলে ডাকতে হয়! কিন্তু একটা কথা, এঁকে তো কোনদিন পরীক্ষার হলে দেখিনি। আরো একটি কথা। আজ আমাদের পরীক্ষা নেই, কিন্তু কমার্স আর আর্টস্ গ্রূপের পরীক্ষা আছে তো। তিনি একজন শিক্ষিকা হলে এখন ডিউটিতে থাকতেন না? নাকি চাপা মারা হচ্ছে? মেয়েলোকদের দিয়ে তো বিশ্বাস নেই। গল্প শেষ হলে দেখা যাবে যে কিসের ম্যাডাম, কিসের শাশুড়ি, ইনি নিজেই শাহজাহানের বউ। আমাকে বোকা বানাবার জন্য এতক্ষণ মজা করলেন আর কি।
আমি বললাম, পরীক্ষার হলে ডিউটি পড়েনি?
তিনি বললেন, হ্যাঁ, পড়েছে তো।
আপনাকে কিন্তু একদিনও পরীক্ষার হলে দেখিনি।
দেখবেন কিভাবে? আমার সীট যে মেয়েদের হলে?
তাহলে আজ যাননি কেন?
অবশ্য গত পাঁচ দিন ধরে হলে যাচ্ছি না।
কেন?
আমি অসুস্থ তো, তাই ছুটি নিয়েছি।
আপনি অসুস্থ? এতক্ষণ বলেননি কেন? কি হয়েছে আপনার?
ও বুঝবেন না। বলেই খালাম্মা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেলেন।
আমাকে এক রহস্যের ঘোরে ঠেলে দিয়ে লাজ-রাঙ্গা হাসি হাসতে লাগলেন খলাম্মা। তারপর বললেন, এখানে কেন বসে আছি, জানেন?
জ্বি না।
আমি ওদের দুজনকে পাহারা দিচ্ছি। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি যে হয়েছে, একটুও লাজ-লজ্জা নেই। একটু আড়াল হলেই দেখি দুজনে একত্র হয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। আমি বলেছি, না, পরীক্ষা যদ্দিন চলবে তদ্দিন কোন মেলামেশা নেই, দেখাদেখি নেই, চোখাচোখি নেই, এমনকি কথা বলাবলিও নেই। পরীক্ষার সময় আমি এসব পছন্দ করি না। পরীক্ষা হলো সবচেয়ে বড়, জীবনের প্রথম পরীক্ষা নিয়ে কোন হেলা-ফেলা করতে নেই। আমার সময়ে কি হয়েছিল শুনবেন? জয়নবের বাবাকে বলেছিলাম, তুমি আমাদের বাড়ি চলে যাও। ওকে আমি যা বলতাম বিনা বাক্যব্যয়ে ও তা শুনতো। আমার আপন ফুফাত ভাই তো, তাই সব সময় মাতব্বরী খাটাতাম। বলেই তিনি খিলখিল করে হেসে উঠলেন।
হাসি থামলে খালাম্মা জিঞ্চাসা করলেন, আচ্ছা আপনি কি গান গাইতে পারেন?
জ্বি না।
তবুও একটা গান ধরুন তো দেখি।
খালাম্মা, আমি গান গাইতে পারি না।
আহা, গান না?
কোন্টা গাইব?
আপনি তাহলে অনেকগুলো গান জানেন?
জ্বি না।
তাহলে যেটা জানেন সেটাই গান।
আসলে খালাম্মা, গান গাইতে আমার খুবই লজ্জা হচ্ছে। কোন গান জানি না তো।
কেন লজ্জা করবে? এই দেখুন না আমি গাই কেমন করে? বলেই খালাম্মা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সুরে গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণ পর জিঞ্চাসা করলেন, বলুন তো আমি কোন্ গানটার সুর ধরলাম?
এ মহিলা নিজেকে এত পণ্ডিত ভাবছেন কেন? উনি কি জানেন যে আমার নাম নাহিদুল ইসলাম, মালিকান্দা হাইস্কুলের ফার্স্ট বয়, যে কিনা এবার জয়পাড়া সেন্টার থেকে একটা রেকর্ড ভঙ্গকারী রেজাল্ট সৃষ্টি করতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের একটা বাচ্চাও কি এ সুরটা শুনে সাথে সাথে বলে দিতে পারবে না যে এটা জ্ঞআমার সোনার বাংলাঞ্চ গানের সুর, যা এদেশের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত? আমার মত সাহিত্যমনা একজন ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র এটা জানবে না তা কি করে এ মহিলা ভাবতে পারলেন? আমার ঞ্চান সম্বন্ধে মহিলা আমাকে খুব তুচ্ছ ভাবছেন দেখে তাঁর প্রতি আমার প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকলো। আমি যে কতখানি ব্রিলিয়ান্ট, এখন শাহজাহান এলে তবে ওর মুখ দিয়েই শুনিয়ে দেয়া যেত। নিজের ঢোল তো আর নিজে পেটানো যায় না।
খালাম্মা বললেন, যদি বলতে পারেন তবে আপনাকে একটা বিশেষ পুরস্কার দিব।
আমি বললাম, এটা তো রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা' গানের সুর, যা পাঁচ বছরের শিশুও জানে।
খালাম্মা হাসলেন। বললেন, আপনাকে ১০ এর মধ্যে ৫ নম্বর দেয়া যায়। আপনি কি গগন হরকরার এই গানটি কখনো শুনেছেনঃ
আমি কোথায় পাব তারে,
আমার মনের মানুষেরে?
বললাম, জি না।
আপনি কি জানেন যে 'আমার সোনার বাংলা' গানটি গগন হরকরার 'আমি কোথায় পাব' গানের সুরে গাওয়া হয়েছিল?
এ মহিলার জ্ঞানের ব্যাপ্তি অনুধাবন করতে পেরে আমি ক্রমশ অবাক হতে থাকি। আমি জিঞ্চাসা করি, আপনি কোন্ সাবজেক্টে পাশ করেছেন?
হ-য-ব-র-ল। বলেই খালাম্মা খিলখিল করে হেসে উঠলেন।
হাসছেন কেন? আমি জিঞ্চাসা করি।
কারণ, আমি সায়েন্স থেকে এস.এস.সি, আর্টস্ গ্রূপে এইচ.এস.সি এবং রাষ্ট্র বিঞ্চানে ডিগ্রী পাশ করেছি। আর মাষ্টার্স দিব কোন্ সাবজেক্টে জানেন? সমাজ বিঞ্চানে।
আপনি মাষ্টার্সও দিচ্ছেন।
অবাক হচ্ছেন? আমার বুঝি সেই যোগ্যতা নেই?
না তা বলছি না। ভাবছি আপনার মানসিক শক্তি আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা। আচ্ছা, আপনি স্কুলে পড়ান কোন্ সাবজেক্ট?
সেটা শুনে আরো অবাক হবেন। কারণ, ওসব সাবজেক্টে আমার কোন হাইয়ার ডিগ্রী নেই।
বলুন না, কি পড়ান?
স্কুলে আমি ইংরেজি আর অংক পড়াই।
আশ্চর্য।
আশ্চর্য কেন?
দুটি কারণে। প্রথমত, রিসপেক্টিভ সাবজেক্টে হাইয়ার কোয়ালিফিকেশন না থাকলে তাঁকে ও-বিষয়ের কোন ক্লাস দেয়া হয় না। কিন্তু আপনাকে দেয়া হচ্ছে।
খালাম্মা হেসে হেসে বললেন, এটা আমরা সবাই জানি। স্কুলে যে কোয়ালিফাইড টিচার নেই তাও কিন্তু নয়। তারপরও আমাকে প্রতিদিন ক্লাস নাইন ও টেনে অংক এবং ইংরেজি পড়াতে হয়। এজন্য কম করে হলেও আমার ওপর পাঁচ জন শিক্ষক ভীষণ ক্ষিপ্ত। নাইন-টেনে অংক আর ইংরেজি পড়ানো খুব প্রেস্টিজের ব্যাপার। আমার কোয়ালিফিকেশন নেই, অথচ পড়াই। এটা সবাই কি মেনে নিতে পারেন? কিন্তু আমি কি করবো, বলুন? প্রধান শিক্ষক সব সময় ছাত্রীদের পছন্দ-অপছন্দের মূল্য দিয়ে থাকেন।
আমার একবার ইচ্ছে হলো এঁর মেধা পরীক্ষা করার - তিনি কি চাপা মারছেন, নাকি সত্যিকারের মেধাবী এবং অভিজ্ঞ একজন শিক্ষিকা? আমার ইচ্ছে হলো ভয়েজ চেঞ্জের সেই প্রশ্নটি এঁকে করি - 'হু আর ইউ'র প্যাসিভ ভয়েস কি হয়?
পরে ভাবলাম, না থাক, আমি কি আর পাগল নাকি?
আমি বললাম, দ্বিতীয় অন্য কারণটি জানতে চাইলেন না, কেন আশ্চর্য হলাম?
ও হ্যাঁ, বলুন তো।
আপনার ডিগ্রী এক বিষয়ে, পড়ান অন্য বিষয়, কিন্তু গান নিয়ে আপনি এত কিছু জানেন কি করে?
খালাম্মা হেসে উঠে বললেন, আপনি আবার আমার এত জ্ঞান দেখলেন কোত্থেকে? এ সামান্য একটা জ্ঞানের কথা শুনে ভাবছেন আমি কত কিছুই না বুঝি জানি, তাই না? আসলে জ্ঞান অর্জন করাটা একদিনের ব্যাপার না। আর কষ্ট না করে মানুষ কোনদিন জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। এ জন্য প্রচুর পড়ালেখা করা দরকার। ধরতে গেলে জয়পাড়া এখন একটা শহর; তারপরও মনে হয় এটা যেন এখনো একটা গণ্ডগ্রাম। এ গণ্ডগ্রামে স্কুলপাঠ্য বই-পুস্তকের বাইরে পড়ালেখার কোন সুযোগই নেই। কোন পাঠাগার নেই, বুক স্টল নেই, সংবাদপত্র বিক্রয় কেন্দ্র নেই। পড়ার জন্য বই-পত্র, ম্যাগাজিন, ইত্যাদি কোন কিছুই আমরা পাই না। জ্ঞানচর্চা কিভাবে হবে, বলুন?
একটু বিরতি নিয়ে বললেন, অথচ ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি আমার দারুণ ঝোঁক। জানেন, আমার পড়া প্রথম উপন্যাস কোন্টি?
আমি বললাম, বলুন।
তার আগে বলুন, সাহিত্যে আপনার দখল কেমন?
আমি ভিতরে ভিতরে প্রতিশোধ-স্পৃহায় উত্তেজিত হতে থাকলাম। এতক্ষণ ধরে আমার কাছে জ্ঞান ফলানো হলো তো, এবার আমি দেখে নিব সাহিত্যে আপনার ঞ্চান কতখানি আছে। আপনার বিষয় ইংলিশ আর ম্যাথমেটিকস্, আমার বিষয় সাহিত্য। আমাকে তো আপনি চিনেন না, এবার আপনাকে আমি সাহিত্য শেখাব। আমি কৌশল অবলম্বন করে বললাম, সাহিত্য আমার মাথায় ঢোকে না।
তিনি বললেন, নেভার মাইন্ড। একবার আমার ফুফাত ভাইটি, অর্থ্যাৎ আমার বর্তমান স্বামী ঢাকা গেল (বলার সময়ে একটু মুচ্কি হাসলেন)। ওকে বলে দিলাম ঢাকা থেকে ফেরত আসার সময় যেন আমার জন্য কয়েকটা ভালো বই নিয়ে আসে। সে আমার জন্য দুটি ভালো বই এনেছিল। হাসির কথা কি জানেন? সে হলো অশিক্ষিত ছেলে, তার ওপর হাবা-গোবা, বুদ্ধি-সুদ্ধি কম। কিন্তু জমিদার পুত্র তো, চোখ যায় সব সময় বড় জিনিসটার প্রতি। মানুষের কাছে জিঞ্চাসা করে করে সে শহরের একটা বড় লাইব্রেরীতে গিয়ে বললো, আমাকে বেশ দামী কয়েকটা ভালো বই দিন তো। দোকানদার এ কথা শুনে মজা করার চেষ্টা করলে সে ভীষণ ক্ষেপে যায়। লোকজন জড়ো হয়। দোকানদারের তখন 'ছাইড়্যা দে মা কাইন্দ্যা বাঁচি' অবস্থা। তবে দোকানদার ঠিকই দুটি ভালো বই তাকে দিয়েছিল। আর দুটি বই-ই রবীন্দ্রনাথের, একটা 'শেষের কবিতা', অন্যটা চার খণ্ড একত্রে 'গল্পগুচ্ছ'। ব্যাপারটা এবার চিন্তা করুন, পড়ি মাত্র ক্লাস ফাইভে, যখন রবীন্দ্রনাথের নামটাও বোধ হয় শুনিনি, আর আমার জন্য কিনা নিয়ে এসেছে রবীন্দ্রনাথের বই। খুব হাস্যকর না?
বইগুলো কি করলেন?
সে কথা পরে বলি। আপনি কি জানেন, সমালোচকদের মতে বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোন্টি?
আমি বিপদে পড়ে গেলাম। আমি এত সাহিত্য রচনা করেছি, কিন্তু এ তথ্যটি যে আমার এখনো জানা হয়নি। আমি লজ্জিত হলাম। বললাম, আমার জানা নেই।
অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৭