কবিতা পাঠের সুখ বা তৃপ্তি
কখনো কখনো একটা কবিতাকে আরেকটা থেকে আলাদা করা যায় না, কিংবা অনেকগুলো কবিতাকে একত্র করলে সবগুলো কবিতা মাত্র একটা কবিতা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। আবার একটা কবিতার একেকটা স্তবককে ভেঙে আলাদা আলাদা শিরোনামে ছেড়ে দিলে ওগুলোও একেকটা স্বতন্ত্র, উজ্জ্বল ও সার্থক কবিতা হয়ে উঠতে পারে।
কবিতার রূপ বা গঠন যদি এই হয়ে থাকে তবে কবিতা পাঠের মূল তৃপ্তি বা সুখ কোথায়?
আমরা যখন একটা গল্প বা উপন্যাস পড়ি, তার প্রভাব খুব সরাসরি আমাদের মন ও মননে আঘাত হানে; তাই একটা কাহিনী থেকে খুব সহজেই আরেকটা কাহিনীকে আলাদা করা যায়। তদ্রূপ প্রবন্ধ বা নিবন্ধ খুব সরলভাবে শিরোনামে বক্ষ্যমাণ বিষয়ের ইঙ্গিত দিয়ে থাকে বলে মূল বক্তব্যে খুব তাড়াতাড়িই আমরা পৌঁছে যেতে পারি, যা অনুধাবনে আমাদের তৃপ্তি বা তৃষ্ণা মেটে; আর সহজেই একটা প্রবন্ধ থেকে আরেকটাকে আলাদা করা যায়।
নির্মাণ ও প্রকাশে কবিতা বর্তমানে যে অবয়ব ধারণ করেছে, তার নির্যাসের স্বাদ সবাই খুব সহজেই লাভ করতে পারেন বলে আমার বোধ হয় না। কবিতা খুব গভীর উপলব্ধির বিষয়। বেশিরভাগ বোদ্ধারাই কবিতায় চিত্রকল্পের নান্দনিক গ্রন্থনার কথা বলেন। কিন্তু আমার মনে হয় অধুনা কবিতায় চিত্রকল্প সৃষ্টির চেয়ে এবস্ট্রাক্ট বিষয়ের বুননই অধিক মাত্রায় হয়ে আসছে। মূলত আমিও মনে করি, কবিতা কোনো চিত্রকল্পের বিষয় নয়, ভাববোধ বা ভাব সৃষ্টির বিষয় হলো কবিতা।
তাহলে কবিতার রসাস্বাদন কিভাবে সম্ভব?
খুব নিগূঢ়ভাবে কবিতা পড়তে হয়; কবিতার ভেতর ডুবে যেতে হয়। একেকটা শব্দ পাঠককে একেকটা দিগন্তে নিয়ে যাবে, একেকটা দিগন্তে পাঠক একেকটা ভুবন দেখতে পাবেন; তখন একটা কবিতা থেকে আরেকটা কবিতা আলাদা, নাকি পুরো বই জুড়ে একটা মাত্র কবিতা, পাঠকমনে এই প্রশ্নের উদ্রেক হবে না মোটেও, কেননা প্রশ্নটাই তখন বেজায় অবান্তর। কবিতা মূলত শব্দে ভাবাবহ সৃষ্টির খেলা। শব্দেই পাঠক ঘায়েল কিংবা কুপোকাত।
আধুনিক কবিতা এমনই।
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
আধুনিক কবিতার অর্থ ও শব্দকবিতা
একটা কবিতা লিখে বহুবার রিভিশন দিয়ে ওটাকে রিফাইন করা হয়। ফলে একটা অপোকৃত অপরিপক্ব কবিতা কিছুটা হলেও পরিণতি লাভ করে। কবিতা লিখার এটাই বোধ হয় চিরন্তন ও প্রায়-সর্বজনসিদ্ধ ও অনুসৃত পদ্ধতি।
সাম্প্রতিককালে মণীষী-কবিদের কবিতাবিষয়ক জ্ঞানগর্ব আলোচনা ও বিদগ্ধ পাঠকবর্গের সুনিপুণ কাব্য-সমালোচনা পড়ার পর এ বিষয়ে আমার জ্ঞানভাণ্ডার অনেকগুণ সমৃদ্ধ হয়েছে। প্রথমেই যেটা বুঝতে পেরেছি তা হলো : একটা কবিতা লিখে ছেড়ে দিলেই কবি হিসেবে আমার দায়িত্ব প্রায় শেষ; ও-কবিতার গূঢ়ার্থ বা শাব্দিক কিংবা আক্ষরিক অর্থ উদ্ধারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পাঠকের। কবিতার অর্থ উদ্ধারে পাঠকের যতো কষ্ট ও ভোগান্তি হবে, কবি হিসেবে আমার কৃতিত্ব বা বড়ত্ব ততোই বেশি। ভুলক্রমে অথবা ছাপাখানার বিড়ম্বনায় কোনো শব্দ বা বাক্য উলটপালট হয়ে গেলে কবিতার যে অর্থ-বিভ্রাট ঘটে, পাঠক তাতে জটিল সৃজনীশক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে আমাকে কুর্ণিশ করবেন বৈকি!
কবিতা যদি পানির মতো তরল ও স্বচ্ছ হয়, তা সত্যিকারেই কোনো কবিতা হয় না বোধ হয়; আমাদের কিছু কবি তাই মনে করেন। জসীম উদ্দীনের কবিতা সেই বিবেচনায় ‘কবিতা’ কিনা তা এখন বিচার্য্য বিষয় বটে!
অতএব, কবিতা লিখা বোধ হয় নজরুল-রবীন্দ্র যুগের চেয়ে আজকাল অনেক অনেক সহজ হয়ে গেছে। কিছু সাবলীল ও কিছু অপ্রচলিত শব্দগুচ্ছ ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে পঙ্ক্তিবদ্ধ করে ছেড়ে দিলেই হলো; তার যদি একটা গূঢ়ার্থ থাকে তো ভালো, না থাকে তো আরো ভালো- বুদ্ধিমান পাঠকগণ জটিল ও দুরূহ গাঁথুনির ভেতর ঢুকে অমূল্য রত্নখনি তুলে এনে সগর্বে কবির সামনে উপস্থাপন করবেন। কবি অতিশয় চমৎকৃত হলেও হতে পারেন- এতো সৃষ্টিশীল ও শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা- এতো বাঙ্ময়, এতো বহুব্রীহিময়- কবি নিজেও হয়তো কবিতা রচনার কালে ভেবে উঠতে পারেন নি। প্রকৃতপক্ষে, কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থোদ্ধারের দায়িত্ব পাঠকেরই, কবির নয়; পাঠকগণই গবেষণা করে বের করবেন রচিত কবিতার ‘মেসেজ’টা আসলে কী; সেই বাণী জ্ঞাত হয়ে কবি নিশ্চিত হতে পারেন- হ্যাঁ, আমি বোধ হয় এ-ই বলতে চেয়েছিলাম।
কবিকে কেবল একগুচ্ছ শব্দ সুগ্রন্থিত করতে হবে। তার অর্থ অথবা অর্থহীনতা অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাঠকের। অর্থের ভেতর যেমন নানান অর্থ লুকায়িত, ‘অর্থহীনতা’ও অশ্রুতপূর্ব অর্থদ্যোতনায় ভাস্বর হয়ে উঠতে পারে।
সর্বোপরি এবং প্রায়শ, কবির চেয়ে পাঠকগণই কবিতা বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখেন।
বস্তুত কবিতার কোনো অর্থ হয় না। কবিতার সর্বজন-স্বীকৃত সারমর্মের অনুসন্ধানও যৌক্তিক নয়। কবিতার যদি কোনো অর্থ থেকেও থাকে, তা কেবল পাঠককল্পিত অর্থ, যা পাঠক ভেদে বহুবিধ।
আমি তাই বলি, একটা পুরো কবিতা লিখবারই বা কী দরকার? একটা একটা করে শব্দ একের পিঠে আরেক দাঁড় করিয়ে দিলে কেমন হয়? একটা ব্যাকরণগত সার্থক বাক্য না হোক, এরা পাশাপাশি বসে বা দাঁড়িয়ে কি কোনো ভাব বা আবহ সৃষ্টি করে? দৈবাৎ যদি একটা মাত্র শব্দও আপনাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে যায়, যা একশ পঙ্ক্তির একটা কবিতাও পারে নি, ওটিই আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতা। এভাবে শব্দের পর শব্দ বসিয়ে দেখুন, আপনিও পারেন কিনা শব্দকবিতা সৃষ্টি করতে- আমি এর নাম রেখেছি 'শব্দকবিতা’ : শব্দেই দৃশ্যানুভূতি।
২৬ জানুয়ারি ২০০৯ রাত ১১:০৮
শব্দকবিতা
গাঙচিল লালপাল ধনুকের নদী
বাঁশপাতা দুপুরের উড়ন্ত ঘুড়ি
বালুচর কলাপাতা গরমের ঘুম
রাখালের বাঁশিমন উচাটন দিন
ঝড়খড় বাউলের একতারা পথ
শূন্যতায় ভরে ওঠে সময় কলস।
২১ আগস্ট ২০০৮
পুরনো কথা
একটি পুরনো খাঁচা; ভাঙা
একজন পুরনো বন্ধু, বিশ্বস্ত বাঘ
কপালে একটি টিপ; স্মৃতির
তুমি সনাতনী বিগ্রহ
তুমি উচাটন চুম্বন
তুমি বিষধর পেলবতা
তুমি ক্ষয়িষ্ণু সঙ্গম
একটি মুমূর্ষু কবিতা
একটি বিষণ্ন ঝড়
একটি বিরাণ দুপুর
একটি করুণ জানালা
একটি পুরনো খাঁচা, শূন্য, খাখা
একজন পুরনো বন্ধু, দূরের জানালা
তোমার কপালে টিপ, উজ্জ্বল কলঙ্করেখা
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯