বই পর্যালোচনা (রিভিউ): ১২
বইয়ের নামঃ বরফ গলা নদী
লেখকঃ জহির রায়হান
ভাষাঃ বাংলা
ঘরনাঃ চিরায়ত উপন্যাস
বইয়ের পৃষ্ঠাঃ ৯৬
বিনিময় মূল্যঃ ১৩২ টাকা
প্রকাশনীঃ অনুপম
ব্যক্তিযোগ অনুযোগঃ ৪.৪/৫
“মা আর কোনো প্রশ্ন করলেন না, ভাতগুলো মজে এসেছে। এখনি নামিয়ে ফেন ঢালতে হবে। তারপর জলের কড়াটা চড়িয়ে দিতে হবে চুলোর উপর।
মরিময় পাকঘরে এসে ঝুঁকে পড়ে বললো, এক কাপ চা দিতে পারবে, মা?”
আহ-হা, বেদনাভরা এক উত্তর, প্রতিত্তর!
সমাজ, নিম্নবিত্ত পরিবার!!
উপরের অংশটুকু প্রিয় লেখক, প্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রিয় সৃজনী... জহির রায়হানের অনবদ্য এক উপন্যাস, বরফ গলা নদী, এর অংশবিশেষে। যেখানে তিনি নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজের বৈচিত্র্যহীন জীবনের ঘটনাবলীর সুশৃঙ্গল ইতিবৃত্ত টেনেছেন, যা বস্তুত এই উপন্যাসের মূল রসদ। জীবন বাস্তবতার লেখক হিসেবে সুখ্যাতি পাওয়ার এই লেখক অনন্য, সৃষ্টিশীল আরেক সাহিত্যিক, শহীদুল্ল্যাহ কায়সার, এর অনুজের। যদিও এখানে শহীদুল্ল্যাহ কায়সারের কোনো প্রতিরূপ নেই।
সমাজের একটি বাস্তব দর্পনে প্রতিবিম্ব হয়েছে এই উপন্যাস।
একটা পরিবারের শুরু থেকে পথচলা কোথায়, কোথায় এসে শেষ হচ্ছে... লেখক এক লেখনীতে প্রকাশ করেছেন অসাধারণভাবে। লেখকের সৃষ্ট প্রতিটা চরিত্র পাঠকের সামনে উপস্থিত হবে নিজ নিজ ভঙ্গিমায়। জহির রায়হান একাধারে ছিলেন গল্পকার, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং ঔপন্যাসিক। তার সৃষ্ট আরও অনেক উপন্যাস আমরা পড়েছি। মুগ্ধ হয়েছি একাধিকবার। ‘বরফ গলা নদী’ও তার ব্যতিক্রম নয়।
মধ্যবিত্ত পরিবারে নিজের খেয়াল মত বেঁচে থাকা অনেক দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার। এখানে বেঁচে থাকতে হলে আগে ভাবতে হয় পরিবারের সবার কথা। এরপর যদি নিজের ভাল থাকার মত কিছু থেকে থাকে তবে তাই নিয়ে বাঁচতে হয়।
মাহমুদ প্রতিবাদী যুবক। অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে পারেনা সে, সবসময় সততার আদর্শে চলে। পত্রিকা অফিসে চাকুরি করতে এসে সে জানতে পারলো, ‘এখানে টিকতে হলে আদর্শ ধরে রাখা যাবে না।’ সব অন্যায় ধামাচাপা দিয়ে, তোষামোদ করে খবর বানাতে হবে। এসব দেখতে না পেরে চাকরিটা ছেড়ে দেয় সে।
অন্যদিকে,
মরিয়ম এক বড়লোকের বাড়িতে সেলিনা নামের এক মেয়েকে পড়াতো। সেলিনার বড়বোনের দেবর মনসুরের সাথে সেখানে পরিচয় হয় মরিয়মের।
হাসিনা এক উচ্ছ্বল কিশোরী। তার চোখে রঙিন স্বপ্ন। যদিও জীবনের চরম দারিদ্র্যতায় তার সব স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যায়, তবুও সে পরাজিত হয় না। জীবন যুদ্ধে নিজের মতো করে রাজ্য জয়ে এগিয়ে যায় উদ্দেশহীন সম্মুখপানে।
নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়া বলতে গেলে অনুভূতির রাজ্যে হারিয়ে যাবো। কারণ, বাংলা সাহিত্যের লেখনিতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যত লেখক, কবি, সাহিত্যিক এসেছেন, আছেন উনাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়ে হৃদকপটে জায়গা করে নিয়েছেন ‘জহির রায়হান।’ লেখক সম্পর্কে ইন শা আল্লাহ অন্য একদিন কাব্যপাঠ বা সাহিত্যপাঠ লিখবো!
উপন্যাসটা শেষ করে ঝিম ধরে বসে থাকলাম। মনে হচ্ছে আমার ভেতরে নিদারুণ কষ্টের বরফ জমে গেছে! বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই লাল বাড়িটি। চাকচিক্যে মোড়া নাগরিক সভ্যতার এক শহরেরই কোন কোনে, অন্ধকার, দুর্গন্ধময় গলি ভেতরে পলেস্তারা খসে পড়া লাল দালানে থাকেন হাসমত আলী ও তার পরিবার।
স্যাঁতসেঁতে, পুরানো ফুটো ছাদ, করুণ চোখের মরিয়ম কিংবা একবুক আশা নিয়ে থাকা হাসিনা। হাসমত আলীর স্ত্রী সালেহা বিবি। দুই ছেলে মাহমুদ আর খোকন । মাহমুদ পরিবারের বড় ছেলে। খুব কম বেতনে চাকরী করে একটি পত্রিকা অফিসে। বড়লোকরা হয়ে ওঠে তার চক্ষুশূল।
মাহমুদের বন্ধু শাহাদত, বন্ধুপত্নী আমেনা, নাঈম। সর্বমোট ডজনখানেক চরিত্রের উপস্থিতি আছে এই উপন্যাসে। জীবনের কিছু চরম সত্য যে আড়াল করতে হয়, তার পুরোপুরি ভুক্তভোগী হচ্ছে স্বামী-সোহাগ বঞ্চিতা মরিয়ম।
বাস্তবিক অর্থে, কিছু কিছু অনুভূতি কখনোই প্রকাশ করা যায় না। এই উপন্যাসটি পড়ে বুকের মধ্যে এমন উথালপাতাল অনুভূতি হয়, যা সত্যিকার অর্থে প্রকাশ করা অসম্ভব!
কথাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী’ উপন্যাসটি সাহিত্যপ্রেমীদের পড়ার সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি.....
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:৪৯