বই পর্যালোচনা (রিভিউ) – ১০
বইয়ের নাম – একাত্তরের ডায়েরী
লেখিকা – সুফিয়া কামাল
ভাষা – বাংলা
ঘরনা – মুক্তিযুদ্ধ
বইয়ের পৃষ্ঠা – ২০৮
বিনিময় মূল্য – ২২৫ টাকা
প্রকাশনী – হাওলাদার
ব্যক্তিগত অনুযোগ (রেটিং) – ৪.৬/৫
“২৭ মে, বৃহস্পতিবার, ১৯৭১”
রাত ৯ টা।
“কোথাও আর অন্য কথা নেই। মা হারা বাপ হারা সন্তান হারা মাতা পিতার নিরুদ্ধ বেদনার্ত কাহিনী। কিন্তু, তার মধ্যেও সুগভীর বিশ্বাসে কি অপরিসীম ধৈর্যে প্রতীক্ষা। আল্লাহ সুদিন দেবেন। সকলের মিলিত প্রার্থনায় আল্লাহ দেশের ভালো নিশ্চয়ই করবে। ৮টার সময় বোমার শব্দ হল। আজ নারায়নগঞ্জের রাস্তায় একটি দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আহা! কোন মায়ের বাছা।”
কবি সুফিয়া কামাল এর অনন্য সৃষ্টিকর্ম ‘একাত্তরের ডায়েরি’ এর দিনপুঞ্জিকার একটি অংশ বিশেষ উপরের এই অনুচ্ছেদটি।
আহ!
কি দরদ, কি মায়া আর নিয়তির পরীক্ষিত সময়কে লেখিকা সুফিয়া কামাল ফুটিয়ে তুলেছেন যুদ্ধের সময়গুলোকে।
মূলত....
১৯৭১ সালে লেখা সুফিয়া কামালের দিনলিপিতে উঠে এসেছে একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নানা মুহূর্ত। যা ওই সময়ের আতঙ্কগ্রস্ত, বিধ্বস্ত জীবনকে উপলব্ধি করতে পাঠকদের সহায়তা করবে। এ দিনলিপি লেখা প্রসঙ্গে সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন, “.....মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস আমি বারান্দায় বসে বসে দেখেছি পাকিস্তানী মিলিটারীর পদচারণা। আমার পাশের বাসায় ছিল পাকিস্তানী মিলিটারীরর ঘাঁটি। ওখানে দূরবীন চোখে পাকবাহিনীর লোক বসে থাকতো। রাস্তার মোড়ে, উল্টো দিকের বাসায় সবখানে ওদের পাহারা ছিল....।’’
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। দুর্যোগে বিপর্যন্ত মানুষের হাতে রিলিফ সামগ্রী তুলে দিতে তিনি গিয়েছিলেন। পটুয়াখালির ধানখালি চর এলাকায়। রিলিফ দিয়ে ঢাকার ফিরলেন ৮ জানুয়ারি।
সত্তরের জলোচ্ছ্বোসের পরে ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বাঙালি নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করলেন।
শেষ পর্যন্ত ১ মার্চ ১৯৭১ সালে গণপরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। ১মার্চ, সোববার রাত দশটায় কবি লিখছেন, ‘বিক্ষুদ্ধ বাংলা।’ ভুট্ট্যো সাহেব পরিষদে যোগ দিবেন না সিন্ধান্তে পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রইল। ১২টায় এ খবর প্রচারিত হওয়ায়, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে বিভিন্ন তারিখে তিনি দেশের পরিস্থিতির কথা নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের দলিল হিসেবে এই ডায়েরির তথ গবেষণার উপাদান হিসেবে কাজ করবে।
নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়ার আলোকে বলতে শব্দগুলো বেশ এলোমেলো হয়ে যাবে। কবি সুফিয়া কামাল নিজের স্মৃতিচারণ করে লিখে গিয়েছেন একটি দেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বর্ণনা! ডায়েরির একটি বিশেষ দিক এই যে কোনো কোনো তারিখে তিনি শুধু একটি কবিতা লিখেছেন। একজন কবি এভাবেই নিজের প্রকাশ ঘটান। এপ্রিল ১, বৃহস্পতিবার। রাত আটটায় তিনি লেখাটি শেষ করেছেন এভাবেঃ
“......কারফিউ চলছে। প্লেনের আসা-যাওয়ার বিরাম নেই। কাল থেকে নাকি ব্যাঙ্ক সব খোলা হবে। আট আনায় তিনটি পান কিনলাম। বাংলার ইতিহাস কে রচনা করবে....?’’
শেষের বাক্যটি অন্য বাক্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু কোনোবাবেই এটি কোনো আকস্মিক বাক্য নয়। কারণ ২৫ শের রাতে গণহত্যার পরে শুরু হয়ে গেছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হবে বাঙালির নতুন ইতিহাস। তিনি আহবান করছেন ইতিহাস রচয়িতাকে।
এখানে চিহ্নিত হয় তাঁর আগ্রগামী চিন্তার স্বরূপ। ডিসেম্বর ১৬, বৃহস্পতিবার লিখছেন, ‘আজ ১২ টায় বাংলাদেশ যুদ্ধ বিরতির পর মুক্তিফৌজ ঢাকার পথে পথে এসে আবার সোচ্চার হল ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণে। আল্লাহর কাছে শোকর।’
বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের, বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসীদের এবং বইপ্রেমীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দেশপ্রেমের অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে পরিচিত ‘একাত্তরের ডায়েরী’ বইটি পড়ার সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি.....
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:১২