বই পর্যালোচনা (রিভিউ) – ০৯
বইয়ের নাম – আমি বিজয় দেখেছি
লেখক – এম আর আখতার মুকুল
ঘরনা – মুক্তিযুদ্ধ
বইয়ের পৃষ্ঠা – ৪০০
বিনিময় মূল্য – ৩৭৫ টাকা
প্রকাশনী – অনন্যা
ব্যক্তিগত অনুযোগ (রেটিং) – ৪.৭/৫
বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য, দুঃসাহসী অথচ সংযত ও সহিষ্ণু ৬৩ বছর বর্ষীয় ‘চির যুবা’ এম আর আখতার মুকুল, সেই যে ছোটবেলায় বাঙালি ঘরাণার রেয়াজ মাফিক দু’দুবার বাড়ি থেকে পলায়ন পর্ব দিয়ে শুরু করেছিলেন জীবনের প্রথম পাঠ।
তারপর থেকে আজ অবধি বহু দুস্তর ও বন্ধুর চড়াই-উৎরাই, বহু উথান-পতন ও প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে যেতে হলেও আর কখনও তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি; রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছ পা হননি কোনও পরিস্থিতিতে। যা আছে কপালে, এমন একটা জেদ নিয়ে রুখে দাঁড়েয়েছেন অকুতোভয়ে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে তার বিজয়ী মুকুটে যুক্ত হয়েছে একের পর এক রঙ্গিন পালক।
বইটির বিশেষত্ব এই জায়গায় যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস উপহার দেয়ার জন্য তিনি শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হন নি বরং সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটসহ বামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করেছেন।
বইটি শুরু হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ উদ্ধৃতির মাধ্যমে। এর পর তিনি অবসান করেছেন স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত বিতর্কের।
রবার্ট পেইনের ম্যাসাকার গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। যেখানে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু ডিকেটশন দেন, “the Pakistani army has attacked police lines at Razarbagh and East Pakistan Rifles Headquarters at Pilkhana at midnight. Gather strength to resist and prepare for a War of Independence.”
এই বার্তাটি প্রথমে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করেন এমএ হান্নান এবং পরে অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। এরপর ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র প্রচার করেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। লেখক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে এসবই হচ্ছে ঐতিহাসিক ও বাস্তব তথ্য।
মুক্তিযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা নিয়ে বলেছেন। কানাডার টরেন্টোতে আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। টরেন্টো ঘোষণা নামে পরিচিত সম্মেলনটির বিশ্বের সমস্ত দেশের প্রতি জানানো ৫ দফা ছিল নিম্নরূপঃ
১. পাকিস্তানকে দেয় সমস্ত সমরাস্ত্র বন্ধ ঘোষণা,
২. পাকিস্তানকে দেয় সমস্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ ঘোষণা,
৩. জাতিসংঘের তত্তাবধানে পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরে দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনসাধারণের মাঝে সম্ভাব্য সকল সাহায্য বিতরণ করা,
৪. শরণার্থীদের জন্য ভারতকে প্রয়োজনীয় রিলিফ প্রদানের ব্যবস্থা করা,
৫. শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ করা।
লেখক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক জয় হয়। শেষদিকে ভারতের স্বীকৃতি প্রদান, মিত্রবাহিনীর মিলিত আক্রমণ, নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবিরাম ভেটো প্রদান আমাদের বিজয়কে ত্বরাণ্বিত করেছিল। মূল আলোচনার শেষদিকে তিনি অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পত্রিকার উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। ফলে আমরা ঐ সময়ে বাইরের মহলের মনোভাব বুঝতে পারি।
আত্মসমর্পণের দিন কর্নেল ওসমানীর অনুপিস্থিতর সঠিক কারণ আজো অজানা রয়ে গেল। লেখক সাপ্তাহিক বিচিত্রার উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন, “১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজীর আত্মসমর্পণ কেন তাঁর কাছে হলো না- এ প্রশ্ন করলে তিনি জবাব এড়িয়ে যেতেন। বলতেন, মুক্তিযুদ্ধের এমন অনেক ঘটনা আমি জানি যাতে অনেকেরই অসুবিধা হবে। আমি একটি বই লিখছি, তাতে সব ঘটনা পাবেন।”
নিজের ব্যক্তিগত পাঠ প্রতিক্রিয়া বলতে গেলে অনেকটা ধন্ধে পড়ে যাবো, একই সাথে পাঠকরাও! দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি শব্দগুলো নিয়ে যাদের ভালোবাসা, সম্মান অন্যদের চেয়ে বেশি তারা বইটি এক বসায় পড়ে শেষ করতে পারবেন! হৃদয়ের শিরাগুলো উপচে উঠবে ক্রোধে, ঘৃণায়, ভয়ে।
বইটা পড়ে তাজউদ্দীন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যাবে। তিনি যে কত বাঁধা ডিঙিয়ে দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুজিবনগর সরকার, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের ভূমিকাসহ আরো কত কিছু জানা যাবে এই বই পড়ে! সব মিলিয়ে চমৎকার একটা বই।
যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং সরাসরি দেখেছেন তাদের পক্ষে এম আর আখতার মুকুলের অবদানের কথা ভুলে যাওয়া সহজ নয়। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রচার মাধ্যম।
দেশাত্মমূলক গান প্রচার ও মুক্তিযুদ্ধের খবর পরিবেশন করে এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরাট ভূমিকা রাখে। কিন্তু যে অনুষ্ঠানটির জন্য প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন তার নাম ছিল “চরম পত্র”, যার পাঠক ছিলেন এম আর মুকুল। পাকিস্তানি সেনা আর রাজাকারদের প্রতি একরাশ ঘৃনা ছড়ানো কন্ঠে তিনি পড়তেন, “আইজ ভেড়ামারার কাছে আমাগো ‘বিচ্ছু’ পোলাপাইনরা এমুন মাইর দিচে, কমসে কম তেরজন পাকি সৈন্য প্যাঁকের মধ্যে পইড়্যা কাঁতরাইতাছে”।
মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি “বিচ্ছু” বলতেন। কিভাবে আমাদের স্বাধীনতা এল, কিভাবে তখন যুদ্ধ পরিচালনা হত, সবকিছু বাস্তবের মত চোখের সামনে ভেসে উঠলো লেখকের ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইটি পড়ে।
বাঙালি জাতিসত্তায় গড়ে উঠা প্রতিটি মানুষকে বইটি পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি.....
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২৪