মাথার উপর চড়ে উঠা সূর্য যেন ক্রোধে ছন্নছাড়, কড়া আগুনে ঝলসে দিচ্ছে চারদিক। বৈশাখের দুপুরে, কড়া রোদে, লক্ষ্ণণ ভান্ডারীতে চারদিক শূন্যসার। আকাশের মাঝখানের লাল সূর্যটা জ্বলছে, বাতাস যেন মিন মিন কিছু বলতে চাচ্ছে। রোদের ক্ষিপ্রতা যেন আজ অবলীলায় মূর্ত করে দিবে অস্তিত্বকে।
ঘরের ডান পাশের রুমে পাথরের মতো পড়ে আছে অনু, থমকে যাওয়া জীবন যেন স্থির হয়ে আটকে গেছে। জীবন্ত লাশের মতো শুয়ে আছে অনু, মুখের উপর ভ-ভ-ভ করা মশা তাড়াবারও কোনো শক্তি নেই শরীরে!
“আপু, উঠ। নাস্তা খেতে হবে। উঠ, উঠ।” ট্রে এর মাঝে সকালের নাস্তা আনতে আনতে বললো তাহিরা।
বিছানার পাশে এসে ট্রে সাইড টেবিলে রেখে বিছানা থেকে টেনে অনুকে তুলে ঠেস দেয় পিছন বক্স খাটের কার্নিশে, বালিশ দিয়ে সোজা করে বসিয়ে রাখে অনুকে।
“রিফাত কেমন আছে?” অনু প্রশ্ন করে।
“ভালো আছে আপু, আজকে দেখা করতে যাবো।” মুচকি হেসে জবাব দেয় অনু।
“প্রেম ভালো ই চালিয়ে যাচ্ছিস তাইলে? নাকি?” নাক কুঁচকে প্রশ্ন করে অনু।
“আপু, বাজে বকিস না।” বলে লজ্জ্বার হাসি হাসে তাহিরা।
ধানমন্ডি লেকের পাশে হেঁটে যাচ্ছে তাহিরা, অপেক্ষার প্রহর গুনছে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে। যদিও মাথার উপর কালো ছাতাটা মেলিয়ে আছে, তবুও বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা জমেছে কপালের উপর। লেকের এক মাথা থেকে অপর মাথা পর্যন্ত অন্তত এই নিয়ে তিন বার গোল চক্কর দিয়ে দিয়েছে। বিরক্তির চিহ্ন নাকের ডগায় ঝিলিক দিয়ে উঠছে।
মনে মনে বলেছে – “ধ্যাত! কেন যে রিফাত শুধু শুধু ক্ষ্যাপাতে গেলাম। নাহ, ছেলে একদম ভালোবাসে না আমাকে...” ভাবতে ভাবতে চতুর্থবারের চক্কর শেষ মূল বিন্দু এসে দাঁড়ালো তাহিরা।
কাজল কালো টানা টানা চোখ দিয়ে পলক ঝাপটে ঝাপটে মায়া বাড়াচ্ছে রিফাতের দিকে, বৈশাখের আচমকা এক হিম বাতাস যেন আঁচল জুড়ে কড়া রোদকে বেঁধে দিয়েছে।
খোপায় বেঁধে দেওয়া শিমুলের ফুল, কানে দুলতে থাকা দুলারি আর কপালের এক টিপ যেন হলুদ সূর্যকে হার মানিয়ে নিয়েছে। রিফাতের ওমন করে চেয়ে হা দেখে বাসন্তী দেহের তাহিরা লজ্জ্বায় মুখ লুকিয়ে নেয়, আর তা দেখে গালভর্তি হাসি হেসে রিফাত বলে – “বেবি, আরো একটা চক্কর বাকি আছে। যাও তাড়াতাড়ি...” বলে ধমকে উঠে রিফাত।
রিফাতের এই বদলে শরতের আবহাওয়ার মতো যাওয়া চেহারার উপর ভেংচি মেরে হনহন করে হেঁটে যেতে লাগলো তাহিরা, রাগে গজগজ করতে করতে আবারো শাস্তির দন্ড ভোগ করতে লাগলো তাহিরা।
মিনিট দুই-তিনেক পর চক্কর শেষ করে রিফাতের পাশে দুম করে বসে পড়লো তাহিরা, যেন বিশ্ব ভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফিরলো সে!
“এই নাও” বলে হাতের থাকা রুমাল বাড়িয়ে দিলো তাহিরার দিকে।
“থাক, তোমার আর প্রেমের দরকার নাই। রাখো তোমার প্রেম...” বিরক্ত ভরা মুখে রিফাতের হাত সরিয়ে দিয়ে রাগত স্বরে জবাব দিলো তাহিরা।
মিনিট এক-দেড় পর রিফাতের হাতে থাকা রুমাল কেড়ে নেয় তাহিরা। রিফাত বরাবরের মতো বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে বলে উঠে – “ঢং রে!”
“কিছু বল্লা মনে হলো...” উৎসুক চোখের ভ্রু টেনে প্রশ্ন করলো তাহিরা।
“আরেহহ...নাহ। Not a single word, Honey....” কাঁচুমাঁচু কণ্ঠে জবাব দিলো।
“এদিকে আসো, এতো দূরে বসছো কেন? আমরা কি স্কুলের হেড মাস্টার আর লীলা ম্যাডাম নাকি যে, দূরে ভাগবা? কাছে আসো.....” ধমক দিয়ে রিফাতকে টেনে কাছে আনলো তাহিরা।
“আরে আরে...করো কি? মানুষ দেখতে কি ভাববে? এতো কাছে বসা ঠিক হবে না, দূরত্ব রাখা ভালো...” বলে খানিকটা দূরে সরে যায় রিফাত।
“বাসর রাতে তাইলে কাছে আইসো, জুতা পিটা করমু ঐদিন....” গোস্বায় জোর আওয়াজে লাল আপেল চেহারা করে বলে উঠলো তাহিরা।
“আরে..আরে...আস্তে...আস্তে...ঠিক আছে। স্যরি...স্যরি.....” বলতে বলতে ডান হাত দিয়ে তাহিরার মুখ চেপে ধরে দূরত্ব কমিয়ে বসলো।
খানিকপর মুখ ছেড়ে দিয়ে বললো – “তোমার সাথে যে আমার প্রেম কিভাবে হলো তা আমি আজও ভেবে পেলাম না। তুমি তো....” শেষ করার আগ মুহূর্তে তাহিরা আবার বলে উঠলো – “ কি তো? আমার সাথে ব্রেক-আপ করবা? ছেড়ে দিবা তো?”
“আরে বাবা, আমি আবার এইকথা কবে বললাম। কি যে বলো না, সামনের সপ্তাহে আমাদের বিয়ে আর তুমি এখন আবোল-তাবোল বলতেছো?” গোমড়া মুখে জবাব দিলো রিফাত।
“হইছে, হইছে। আর, এতো প্রেম দেখাতে হবে না। ভাবের জ্বালায় আর বাঁচি না....” বলে মুখ ভেংচি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহিরা।
“আচ্ছা শোনো না...এই...শোনো...আহ....শোনো না.....” বলে আদুরে কন্ঠে ডাকতে লাগলো রিফাত।
“কি হইছে, বলো?”
“বিয়ে কি তাহলে আমরা কাজি অফিসে করছি?”
“কেন? টাকা-পয়সা কি বেশি হয়ে গেছে নাকি? বেশি পটর-পটর করবা না, টাকা জমাইতে শিখো...” বড় বড় চোখ করে জবাব দিলো তাহিরা।
“আচ্ছা, ঠিক আছে। ওকে, স্যরি।”
“হুহ...”
“আচ্ছা, তোমার বোন কেমন আছে?”
“আগের থেকে অনেকটা ইম্প্রোভ হয়েছে। আমাদের বিয়ের তারিখ শুনে আরো উদ্বেলিত হয়ে গিয়েছে, রগে-রগে বান দৌঁড়ছে...” শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলো তাহিরা।
“তোমার বোনের সাথে আজ পর্যন্ত দেখা করা হলো না! উনি এতোটা অসুস্থ, একবার তো দেখতে যাওয়া উচিত ছিলো। তাই না?” আবেগী কন্ঠে জবাব দিলো রিফাত।
“একেবারে না হয় শেষ দেখা দেখে নিবে....” ছলাৎ করে বান ছুটে চলা আওয়াজে জবাব দিলো তাহিরা।
“মানে? শেষ দেখা মানে...”
“বাদ দাও আপুর আলাপ। তুমি তোমার কথা বলো। বিয়ের জন্য সাক্ষী কে কে আসছে?”
“ইফতি ভাইয়া, সোনিয়া ভাবী, আসাদ, নূরু.....এইতো।”
“আচ্ছা, ভাইয়া একটু আগে আসতে পারেন না? একদম শেষদিনে কেনো?”
“ব্যবসায়িক ঝামেলা চলছে দেশে ভাইয়ের, সোলাইমানের সাথে কষাকষি চলছে অনেকদিন ধরে!”
“কোন সোলাইমান? কান কাটা, ঐ ভয়ংকর দেখতে....” অবাক চোখে চেয়ে বললো তাহিরা।
“বাদ দাও তো, তোমার পক্ষ থেকে কে আসবে ওটা বলো?”
“সারপ্রাইজ!”
“সারপ্রাইজ? এটা কি নাম নাকি অবস্থা?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো রিফাত।
“হতে পারে তোমার এক্স প্রেমিকাদের কাউকে তুলে নিয়ে আসবো সাক্ষীর জন্য, নতুবা ওদের বাপ-ভাইদেরকে....” বলে ফিক করে হাসি হাসে তাহিরা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে হাসির শব্দ।
“তবে রে মেয়ে.....” বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে তাহিরা খপ করে ধরতে যায় রিফাত, চেয়ার থেকে দৌঁড়তে থাকে তাহিরা। দু’জনের ভালোবাসা আর খুনসুঁটি মাঝে সময় এভাবে চলে যেতে থাকে।
“এই, থামো। থামো...আর না, দম নিতে পারছি না....” দৌঁড়তে দৌঁড়তে হাঁপিয়ে উঠে দাড়িঁয়ে যায় রিফাত।
সামনে থাকা তাহিরা থেমে যায় রিফাতের গলা শুনে, ভালোবাসার মানুষের হার মেনে নেওয়ার উৎসাহে হেঁটে আসতে থাকে সে।
রিফাতের সামনে আসামাত্র খপ করে হাত টেনে ধরে পিছনে বাঁকিয়ে নিয়ে যায় রিফাত, বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলে উঠে – “Never underestimate the power of a lover boy……হা-আ-হা...”
“ভাব নিয়ো না, চোর। চিটিং করে জিতেছে, উ আর এ লুজার...” গোমড়া মুখে বলে উঠে তাহিরা।
তাহিরাকে ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের মুখোমুখি করলো রিফাত, চোখগুলো যেন প্রতিটি পলকের কথা পড়ে নিচ্ছে। নিশ্বাসগুলো যেন শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রকে উষ্ণ করে তুলছে, ঠোঁটের আকুলতা যেন নিষ্পেষিত করে তুলছে দুটি সত্তা। ঠোঁটের পাঁপড়িগুলো যেই না মুখোমুখি হবে, সে সময় পিছনে থেকে কর্কশ ভাষায় এক ঝাড়ুদার মহিলা বলে উঠলো – “বারিত গিয়া পিরিত দেহাও, আমাগো লাইগা এইডা ছাইড়া দেও।” বলে হনহন করে হেঁটে চলে গেলো মহিলা।
“হোহোহোহোহোহোহ......” করে হেসে উঠলো রিফাত আর তাহিরা।
বিয়ের দিন.......
অনবরত ফোন বেজে যাচ্ছে রিফাতের, অপর প্রান্ত থেকে কোনো জবাব আসছে না। তাহিরার গলা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, কি থেকে কি হচ্ছে ভেবে কুল পাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত পঞ্চাশ থেকে ষাট বারের মতো ফোন দিয়ে দিয়েছে কিন্তু কোনো জবাব আসছে না। এরমধ্যে, রিফাতের বন্ধু আসাদ আর নূরুকে ফোন দিয়ে রিফাতের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়েছে।
“ভাবী, গতকাল রাত থেকে তো আমাদের কোনো আলাপ হয় নি। আমরা তো কিছু বলতে পারবো না...” একই জবাব দিলো আসাদ আর নূরু।
তাহিরা ‘হু-হু-হু’ করে কেঁদে উঠলো, কাঁদতে কাঁদতে যেন দম আটকিয়ে যাবে এই অবস্থা। কান্না থামিয়ে নিয়ে বললো – “তবে কি রিফাত আমাকে ধোঁকা দিয়েছে? আমাকে ছেড়ে কি ও.....” বলা শেষ করার আগে আবারো কেঁদে উঠলো তাহিরা। বুক চিড়ে বেরিয়ে যাওয়া আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো ফোনের এক প্রান্ত থেকে।
“আরে ভাবী, আমরা দেখছি কি করা যায়। আপনি ইফতি ভাইয়ের সাথে কথা বলেন আগে...” নূরু বলে উঠলো।
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি কথা বলছি।” বলে ফোন রেখে দিয়ে ইফতির নাম্বারে ডায়াল করলো তাহিরা।
“আচ্ছা, এই শালা গেছে কই? গতকাল রাইতে বার থেইক্কা একসাথে বাইর হইলাম, এরপর শালারে বাসার সামনে নামায়া দিয়া গেলাম। শালায় কি বাসায় যায় নাই?” ভাবুক চিন্তায় বলতে লাগলো নূরু আর আসাদ।
“চল তো, রনির ফ্ল্যাটে যাই। শালায় আবার ওইখানে গিয়া কোনো কুকীর্তি ঘটাইলো কি না আল্লাহয় জানে...” বলে বাইকে কিক দিয়ে ‘দুমুড়-ভুরুম’ আওয়াজে টানতে লাগলো সামনে বসা আসাদ।
“ভাইয়া, আসসালামু আলাইকুম....” তাহিরা বলে উঠলো।
“আরে তাহিরা যে....হে আপু বলো। হঠাৎ করে কি করে আমার কথা মনে পড়লো? বিয়ে ক্যানসেল করার প্ল্যান নাই তো আবার তোমাদের....” উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলো ইফতি।
“না ভাইয়া, তেমন কিছু না। তবে...” বলা শেষ করার আগে ইফতি বলে উঠলো – “যাক, তাহলে ঠিক আছে। আমেরিকা থেকে খুব টানাটানি করে ছুটি এনেছি, নতুন গ্রীন কার্ড পাওয়া লোকজনের উপর একটু ভালো নজরদারি রাখে আমেরিকান লোকজন। আর, এখন যদি বিয়েটা....” নিজে নিজে বলে যেতে লাগলো ইফতি।
কথা কেটে দিয়ে তাহিরা কান্নার সুরে বলতে লাগলো – “ভাইয়া, রিফাতকে পাচ্ছি না খুঁজে।”
“কিহহহ? খুঁজে পাচ্ছো না মানে? ও কি বাচ্চা নাকি যে খুঁজে পাচ্ছো না...” উদ্বিগ্ন সুরে বলে উঠলো ইফতি।
“ইফতি ভাই...আমি ওকে কাল রাতে ফোন দিয়েছিলাম। ও আমায় বলেছে যে, আসাদ আর নূরু ভাইদের সাথে আছে। পরে ফোন দিবে। এখন আমি আসাদ আর নূরু ভাইকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলে উনারা বললো যে, রিফাতের সাথে গতকাল রাতের পর থেকে আর কোনো কথা হয় নি! আমি সকাল থেকে ফোন দিচ্ছি, কিন্তু ফোন ধরছে না। আমার কিন্তু ভাই বুক কাঁপছে, আমি কিন্তু মরে যাবো যদি রিফাতের কিছু.....” বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে শুরু করলো তাহিরা।
“আরে....বোকা মেয়ে। কেঁদো না, কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো, আমি দেখছি। সবকিছু আমি সামলে নিবো....” বলে ফোন রেখে দিলো ইফতি।
হনহন করে বেরিয়ে এসে দরজার সামনে থাকা সাদা রঙের BMW তে বসে সাঁই করে বাতাস কেটে উড়াল দিলো ইফতি, ফোন স্পিকারে রেখে ফোন দিলো একটি নাম্বারে।
“আরে, জামাই যে....কি খবর তোমার? হঠাৎ করে মনে পড়লো কেমনে?” শক্ত কন্ঠস্বর বলে উঠলো।
“খবর ভালো না। তোর একটা হেল্প লাগবে। তোমার ও.সি. গিরি ক্ষমতার গরম আজকে আমার চাই, ও.সি. কিবরিয়া।”
“কি হইছে? আবার কোনো নতুন ঝামেলা নাকি?” ও.সি. কিবরিয়া বলে উঠলো।
“রিফাত মিসিং, গতকাল রাত কিংবা সকাল থেকে। ওর হবু বউ আমাকে ফোন করে বললো। বেকুবটারে নিয়া আর পারলাম না, তুই একটু দেখ...”
“তোর কাউকে সন্দেহ? কারোর উপরে....”
“কানকাটা সোলাইমানের উপর সন্দেহ হচ্ছে, গত সিজনে ওর বাড়া ভাত খায়া দিছিলাম আমি...” ইফাত সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো।
“আচ্ছা, আমি দেখতাছি ব্যাপারটা। তুই বেশি কিছু করিস না।” বলে ফোন রেখে দিলো ওসি কিবরিয়া।
মিনিট দশ-পনের পর ইফাতের ফোন ‘টুং টুং’ করে বেজে উঠলো, হড়বড় করে ফোন তুলে নিয়ে ইফাত যা দেখলো সেটা কারোর জন্য সুখকর ছিলো না!
“একটা দশ সেকেন্ডের ভিডিও এসেছিলো, যেখানে রিফাতকে বেহাল করে মারা হয়েছে। চল্লিশ মিনিটের সময় দেওয়া হয়েছে ইফাতকে।
যদি নিজের ভাইকে বাঁচাতে চায়, তবে যেন ‘পুরানো ভাট্টির’ গ্যারেজে চলে আসে। আর, বরাবরের মতো যাতে গাদ্দারি না করে....”
গাড়ি বাতাস কেটে সাঁই সাঁই শব্দে উড়ে যেতে লাগলো রাস্তা ধরে, একটানা চেপে ধরে রাখা হর্ণের শব্দে পুরো এলাকা যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো।
তেত্রিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলো ইফাত, গাড়ি থেকে বের হবার সময় কোমরে গুঁজে নিলো পিস্তল।
গ্যারেজের মাঝখানে চেয়ারে বাঁধা রয়েছে একটি শরীর, দূর থেকে অন্ধকারের কারণে চেহারা ঠিক করে দেখা যাচ্ছিলো না।
“রিফাত...রিফাত....” বলে দূরে থেকে আওয়াজ দিলো ইফাত।
“ভাই...ভাই....আমারে বাঁচাও.....ভাই....” বলে চিৎকার করতে লাগলো রিফাত।
ইফাত দৌঁড়ে ছুটে এলো চেয়ারে বাঁধা সত্তাটির কাছে, উলটো দিকে ঘুরানো থাকায় চেয়ার টেনে নিজের মুখী করলো ইফাত। নিচু হয়ে থাকা মাথা হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে উপরে তুললো ইফাত, মুহূর্তের মাঝে যেন কয়েক হাজার বোল্টের শক খেয়ে ভড়কে গিয়ে কদম পা পিছিয়ে গেলো ইফাত।
অবিশ্বাস্য সত্য যেন নিজের চোখকে ধোঁকা দিচ্ছে, সময়ের ফোঁড়ে যেন পুরো পৃথিবী ডুবে যাচ্ছে।
“তুমি বেঁচে আছো কিভাবে? তোমাকে না আমি গত তিন বছর আগে নিজ হাতে মেরে ফেলেছিলাম।” কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো ইফাত।
“আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, ইফাত। আমার পেটে আমাদের তিন মাসের বাচ্চা ছিলো, ইফাত।” শীতল কন্ঠে একটি পরিচিত কণ্ঠ মেয়েলী বলে উঠলো।
“আর, এই জন্য আমি তোমাকে ট্রাকের সামনে ঠাক্কা দিয়েছিলাম। চলন্ত ট্রাকের সাথে টক্কর লাগার পরও কিভাবে তুমি বেঁচো আছো?”
“সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো বলে বেঁচে আছি...” বলে রহস্যময়ী হাসি হাসে পরিচিত কণ্ঠের মেয়েটি।
ইফাত কোমরে গুঁজে থাকা পিস্তল বের করে তাক করে মেয়েটির দিকে, রাগে ফুঁস ফুঁস করে বললো – “আমার ভাই কোথায়? আজকে ওর বিয়ে, ওরে ছেড়ে দে। নাইলে তোকে আমি জিন্দা পুঁতে ফেলবো।”
“আমি এখনো একটা জিন্দা লাশ হয়ে আছি, ইফাত। আমি সম্পূর্ণ লাশ, জীবন্ত লাশ।”
“বাজে বকিস না, আমার ভাই কোথায়?”
“তোর জন্য আরো একটা বড় সারপ্রাইজ আছে। দেখবি, ইফাত?”
“আমার ভাই কোথায়, বেশ্যার বাচ্চা?” বলে পিস্তলে বাট দিকে আঘাত করে কপাল বরাবর, ভ্রু কেটে রক্ত বেরিয়ে আসে মেয়েটির শরীর থেকে।
“সারপ্রাইজ, ইফাত ভাই।” আওয়াজ শোনে পিছনে তাকালো ইফাত, পলকের মধ্যে ‘আঁ’ শব্দ করে কাঁপা কাঁপা পা নিয়ে টলতে টলতে লাগলো ইফাত।
সাড়ে আট ইঞ্চির ঝকঝকে ছুরি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে ইফাতকে, পৃথিবীর সমস্ত শান্তি দেন নেমে এসেছে ধরণীর বুকে।
“এসবের পিছনে তাহলে তুই, তাহিরা?” পেটের বা দিকে চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলো ইফাত।
“হে, ইফাত ভাই। আমি। আমার তিনমাসের প্র্যাগনেট বোনকে যখন তুই টাকার লোভে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো, তখন শুধুমাত্র তোর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অনু বেঁচে ছিলো। আজকে অনু হাসবে, আগের মতো করে বাঁচবে, ইফাত ভাই।”
“তুই....তু....” তোতলাতে তোতলাতে মাটিতে পড়ে গলে ইফাত, রক্তের ধারা যেন পবিত্র করে দিচ্ছে ধরণীকে।
“আমার বোন একটা জীবন্ত লাশ, ইফাত ভাই। প্যারালাইসড, সম্পূর্ণ। জানে বেঁচে গেলেও শরীরে বাঁচতে পারে নি, ইফাত ভাই। অনুর বড্ড ইচ্ছে ছিলো আপনাকে নিজের হাতে মারবে, কিন্তু হলো না। যাক, কিছু কিছু ইচ্ছা অপূর্ণ থাকা ভালো, ইফাত ভাই...”
“পুলিশ আসছে...তোদেরকে ছাড়বে না। তোরা....” বলা শেষ করার আগে তাহিরা আবার বলে উঠে – “ইফাত ভাই, জানেন...আরো একটা সারপ্রাইজ আছে। আপনার ভাই রিফাত আমার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে, সারারাত আপনার ভাই আমায় নিতে মেতেছিলো, আজ আমি আপনাকে নিয়ে মাতলাম....ইফাত ভাই......”
“বেশ্যার বা....” বলা শেষ করার আগে তাহিরা ‘ছ্যাঁত’ করে পোচ মেরে দিলো ইফাতের গলায়, ‘খকখকক’ করতে করতে কাঁটা মুরগির মতো হাত-পা কাঁপাতে কাঁপাতে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল ইফাত।
“আপু, আপু.....” চেয়ারে বসে থাকা অনুকে ডাক দিলো তাহিরা।
“মরে গেছে?”
“একদম আপু।”
“বাসায় চল, তোর বিয়ের আয়োজন করতে হবে আবার!” মুচকি হেসে বললো অনু।
এমন সময় অনুর পাশে থাকা ফোন কেঁপে উঠলো, স্ক্রিনে ভেসে আসা নাম দেখে হেসে ফোন রিসিভ করে তাহিরা বললো – “হবু জামাই, বলুন....”
“কোথায় তুমি? বিয়ের তো সময় শেষ হয়ে যাবে..”
“সারপ্রাইজ আনছি, হবু জামাই। সারপ্রাইজ....”
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৮:৪৬