পৃথিবীর নামকরা সব ব্র্যান্ডের একটি করে নীতিবাক্য (slogan) থাকে। এগুলো এত চমৎকার ও বুদ্ধিদীপ্ত হয় যে, প্রায়ই এগুলোর অর্থ বা বিশেষণ বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। আমি বিখ্যাত এসব কোম্পানীর নীতিবাক্য খুব ফলো করি। যেমন বিখ্যাত এ্যাপল (apple) কোম্পানীর বিজ্ঞাপন হল- 'Think Different' অর্থাৎ ভিন্ন ভাবনা; এইচএসবিসির (HSBC) 'The world's local bank' অর্থাৎ পৃথিবীর স্থানীয় ব্যাংক; ল'রিয়ালের (L'oreal) 'Because you are worth it' অর্থাৎ আপনি এটির মূল্য বুঝেন; সেইন্সবারির (Sainsbury's) 'Try somethjng better today' অর্থাৎ আজ ভাল কিছু ট্রাই করুন; ওয়ালমার্টের (Walmart) 'Always low prices' অর্থাৎ সর্বদা কম দাম; পেপসির (Pepsi) 'When there is no coke' অর্থাৎ যেখানে কোক নেই, সেখানে পেপসি।
লক্ষনীয় বিষয় হল এসব নীতিবাক্যে কোম্পানিগুলো সরাসরি ক্রেতাকে তাদের পণ্য ও সেবা গ্রহণ করতে বলেনি। এখানে ওয়ালমার্ট ও পেপসির বিজ্ঞাপন দু'টি আমার কাছে সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মনে হয়েছে। পেপসি বলছে যেখানে কোক নেই সেখানে আমার পানীয় পান কর। প্রকারান্তে তারা কোকের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছে। তবে কোকের পরে তারাই যে সবচেয়ে এগিয়ে এটা বুঝাতে চেয়েছে এখানে। অপরদিকে ওয়ালমার্ট আরেক ধাপ এগিয়ে। তাদের বিজ্ঞাপনের শাব্দিক অর্থ যা বুঝায় আসলে কোম্পানিটি তা বলেনি। মূলত পণ্যের ন্যায্য মূল্য ও সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে তাদের পণ্যের দাম এটা বুঝাতে এ বিজ্ঞাপন।
এসব কোম্পানি নিজেদেরকে সেরা বলে দাবী করেনি বা অন্য কোন কোম্পানীকেও ছোট করেনি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রের অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েছে। এতে কিন্তু তারা ব্যবসায়িক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং লাভবান হয়েছে। তাঁরা নিজেদের পণ্য ও সেবার মান বাড়িয়ে অন্য কোম্পানিকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, ক্রেতাদের সন্তুষ্টি অর্জন করেছে। এসব কোম্পানী জানে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে, ধোকাবাজি করে, নিজেকে সেরা প্রচার করে হয়তো সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায়, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। আসল কথা হল দামের সাথে পণ্যের কেয়ালিটি ঠিক রাখা, ক্রেতাদের সুবিধা ও পছন্দমত পণ্য তৈরী করা এবং তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করা।
নভেম্ভর-ডিসেম্বর আসলে আমাদের দেশে শুরু হয় স্কুল-কলেজের নামে লিফলেট, ব্যানার ও ফেস্টুনে বিজ্ঞাপন। কত যে চটককদার নাম স্কুলগুলোর! বেশির ভাগ নামই ইংশিস ভার্সনের। এতে বঙ্গ সন্তানদের পটাতে সুবিধা হয়। আর কোচিং সেন্টারের কথা কি আর বলবো! তেনারা আরো এক কদম এগিয়ে। পৃথিবীর কোথাও শিক্ষা নিয়ে এতো তেলেসমাতি, এতো কাড়াকাড়ি নেই। কারন এখানে শিক্ষা ও চিকিৎসা একটি অতি লাভজনক ব্যবসা। এক কথায় লোভনীয় পণ্য! আর পণ্যের নীতি হলো প্রচারেই প্রসার। এক্ষেত্রে ডাক্তার মহাশয়রা আরেক কদম এগিয়ে। নামের সাথে কত যে দেশের ডিগ্রী (দেশের নামটি বোঝা গেলেও সংক্ষেপে লেখা ডিগ্রীগুলোর অর্থ আমার মস্তিষ্কে ঢোকে না)। অনেক সময় দেখা যায় কোন দেশে সপ্তাহ-দুই সপ্তাহের ট্রেনিংয়ে গেছেন কিন্তু এটাকেও একটা ডিগ্রী হিসাবে প্রচার করেন! একটি দেশের সাথে একটা ডিগ্রী যুক্ত হওয়া মানে নিজেকে পণ্য হিসাবে পাবলিকের কাছে আরো লোভনীয় করা।
এ তো গেল পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপনের কথা। মানুষের প্রচার ও পরিচিতির জন্যও বিজ্ঞাপন অপরিহার্য। মানুষের পরিচিতি নির্ভর করে নিজের কর্মে। এটাই তার বিজ্ঞাপন। পণ্য ও সেবার নিজস্ব কোন ভাষা নেই; তারা নিজে থেকে বলতে পারে না আমিই সেরা, আমাকে নিয়ে যাও প্লীজ! নিজের গুণ দেখিয়েও বোঝাতে পারে না তাদের শ্রেষ্ঠত্ব। কারণ, পণ্যগুলো জড় বস্তু। এগুলোর কোন প্রাণ নেই। অপরদিকে আমরা যে সেবা গ্রহণ করি এগুলোও খালি চোখে দেখা যায় না, ছোয়া যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। এজন্য বিজ্ঞাপন হল পণ্য ও সেবার পরিচিতি পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম।
তবে আজ পর্যন্ত নিজের প্রচার প্রচারণা করে কোন মানুষ বিশ্ব মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, সম্মানিত হতে পারেনি। যা হয়েছে তা হল মানুষের সাময়িক মোহ মাত্র। যখন মোহটা কেটে যায় তখন পাবলিক ব্যক্তির বিজ্ঞাপন ভূলে যায়।
তবে প্রচারেই প্রসার এই নীতিটা আমাদের দেশে বেশ প্রচলিত। তবে তা পণ্যের বিজ্ঞাপনে নয় ব্যক্তির প্রচারে। ইদানিং শুনেছি কিছু কিছু নেতা মিছিল/মিটিংয়ের সুন্দর ছবি ও ভিডিও রেকর্ড করার জন্য ক্যামেরাম্যান হায়ার করেন, কোন কোন সময় ফটো সাংবাদিকদেরও টাকা দেন ভাল মানের ছবি তোলার জন্য। এজন্য সামনের সারিতে কে ব্যানারে ধরবে তা নিয়ে মারামারি হয়। কখনো তা খুন খারাপিতে পর্যন্ত গড়ায়। আসল উদ্দেশ্য হল পাবলিকের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো, দলের বড় নেতার চোখে পড়া, মিডিয়ার নজরে আসা ইত্যাদি। সহজ কথায় এটা হল ছোট নেতার বড় রাজনীতিবিদ হওয়ার বিজ্ঞাপন। রাজনীতি নামক পেশায়! নিজের অবস্থান পোক্ত করার কৌশল।
দেখা যায় এলাকায় বড় নেতা, এমপি ও মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে শুরু হয় স্থানীয় নেতা/উপ নেতাদের পোস্টার বিলি করা, তোরণ নির্মাণ ও বিশাল ব্যানার দিয়ে গেইট নির্মাণের হিড়িক। তবে অতিথি প্রধানমন্ত্রী হলে তো কথাই নেই; চার-পাঁচ হাত দূরত্বে শুধু গেইট আর ব্যানার দিয়ে ছাটা থাকে পুরো এলাকা। কোন বিশেষ উপলক্ষ যেমন- দুই ঈদ, বিভিন্ন জাতীয় দিবস, এমনকি বিভিন্ন পূজা-পার্বণেও চলে নিজেদের প্রচার প্রচারণা। যেভাবেই হোক নিজেকে পাবলিক চিনতে হবে, বড় নেতার নেক নজর পেতে হবে। এতে যত টাকা খরছ হোক তাতে কোন সমস্যা নেই।
এই বিজ্ঞাপন শুধু রাজনীতিতে হয় তা কিন্তু নয়। এমনও দেখা যায় কেউ কেউ নব্বই টাকা দামের পনের বিশটি কম্বল বিতরণ করতে হাজার-পনেরশো টাকার বিশাল ব্যানারে নিজের নাম বড় বড় হরফে লেখে নিজেক দানশীল হিসাবে প্রচার করেন। এমনও সামাজিক সংগঠন আছে যারা বাজেটের শতকরা আশি ভাগ টাকা খরছ করে শুধু মঞ্চ/গেইট নির্মাণে আর অতিথি আপ্পায়নে। আবার অনেকে আছেন এলাকার বড় নেতার ছবি উপরে দিয়ে নিচে নিজের ছবি ও পদবী লেখে পোস্টার ও ফেস্টুন বানিয়ে বিলি করেন।
তবে পরিচিত হওয়ার জন্য রাজনৈতিক স্লোগান একটি বড় ভূমিকা রাখে। মিছিলের সামনে যারা সুন্দর করে হাত-পা নাচিয়ে, মুখ ভেংচিয়ে উচ্চস্বরে দলীয় স্লোগান দিতে পারেন দলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি থাকে। টিভি পত্রিকায় তাদের ছবি আসে, মানুষ তাদের সহজে চিনতে পারে।
অনেক বঙ্গ সন্তান রীতিমত ডোনেশন দিয়ে বিভিন্ন সামাজি, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্টানে অতিথি হোন। এটা হলো নিজের ঢোল নিজে পেটানোর বিজ্ঞাপন। এতে অতিথি মহোদয় নিজেকে একটা উৎকৃষ্ট পণ্য হিসাবে জাতির সামনে উপস্থাপনের সুযোগ পান।
পরিচিতি লাভের আরেকটি সহজ উপায় হল বড় নেতা-নেত্রী, এমপি-মন্ত্রী ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষজনের সাথে ছবি তোলে যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। অনেকে আবার নেতাদের সাথে সেলফি তুলতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তিনি যে নেতার খুব পরিচিত ও ঘনিষ্ট তা জাতিকে জানিয়ে দেওয়া কর্তব্য মনে করেন। এতে ঐ নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে পরিচিতি পাওয়া যায়, বিভিন্ন তদবির ও ধান্ধায় সুবিধা আদায় করা যায়।
সব শেষে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করে লেখাটি শেষ করব। ২০১৪ সালের কথা। তখন লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে (Central London) কাজ করি। একদিন বিকালে সাইকেল চালিয়ে "মার্বেল আর্চ" হয়ে "পিকাডিলি সার্কাস" যাচ্ছিলাম। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম ছিল। উল্লেখ্য যে, সকালের অফিস আওয়ারে এবং বিকালে অফিস ছুটির পর ওয়েস্ট এন্ডে পাবলিক বাস ও ট্যাক্সির প্রচন্ড জট থাকে। এজন্য যানজট হয়। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার ঠিক বামপাশে লন্ডনের তখনকার মেয়র বরিস জনসন (বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রী) সাইকেল নিয়ে আটকা পড়েছেন।
ছবিটি আমার ক্যামেরায় তোলা (Oxford Street, London), ২০১৫ সালে ক্রিসমাসে।
চোখাচোখি হতে হাই-হ্যালো বল্লাম। তিনিও প্রতি উত্তরে একটু হেসে হাত নেড়ে ধন্যবাদ জানালেন। মাত্র পাঁচ মিনিটের রাস্তা পার হতে আমাদের আধা ঘন্টার বেশি সময় লাগল। খেয়াল করলাম মেয়র ধৈর্য ধরে সাইকেল চালাচ্ছেন। তাঁর মুখে বিরক্তির কোন লক্ষণ নেই। অবাক হলাম লন্ডনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর লোকটির ধৈর্য দেখে। তিনি একাধারে লন্ডনের বত্রিশটি বারার (Council) প্রধান। লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ তাঁর অধীনস্থ। লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন ও বাসের বসও তিনি। লন্ডনের বিখ্যাত ব্ল্যাক ক্যাব, মিনি ক্যাবের নিয়ন্ত্রকও তিনি।
রাস্তার পাশে বিশাল ফুটপাত (মূল রাস্তার সমান), তিনি চাইলে ফুটপাত দিয়েও সাইকেল চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আইনের প্রতিশ্রদ্ধাশীল হয়ে তা করেন নাই। আইনের পৃষ্টপোষক হয়ে বেআইনি কাজ করা যে গুরুতর অন্যায় তা তিনি জানেন। তিনি এও জানেন জনগন ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করেছে। এজন্য জনগনই সকল ক্ষমতার উৎস ও মালিক। তিনি হলেন তাদের নির্বাচিত একজন প্রতিনিধি মাত্র। জনগনের সেবক, মাস্টার নয়।
এতো ক্ষমতা, এতো পরিচিতি তারপরও নেই কোন দেমাগ, নেই বাড়াবাড়ি, নেই বিলাস বহুল গাড়ি, নেই কোন সিকিউরিটি। রাস্তায় তাঁকে কেউ চিনতে পেল কি না তাতে তাঁর বিন্দু পরিমাণ আক্ষেপ নেই। তিনি জানেন কর্ম ও নিষ্ঠা তাঁকে নেতা বানাবে। মিছিল, সেলফি, বড় নেতার পরিচিতি ও ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন নয়। তিনি এও জানেন তাঁর দল তাঁকে কর্ম দিয়ে মূল্যায়ন করবে, পরিচিতি দিয়ে নয়। যতটুকু জানি ভবিষ্যতে কনজারভেটিভ দলের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে তার।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ২:০৮