অধ্যাপক ডক্টর ত্রিগুণা সেন। একটি নাম, একটি ইতিহাস, একজন শিক্ষক, একজন রাজনীতিবিদ ও একটি বিপ্লবী চেতনার নাম। সিলেটের জকিগঞ্জে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠককে আমরা কয়জনই বা চিনি? তিনি ছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অগ্রপথিক। অন্যতম সংগঠক।
ড. ত্রিগুণা সেন ১৯০৫ সালে সিলেট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জকিগঞ্জ উপজেলা) বিরশ্রী গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পৈত্রিক নিবাস একই মহকুমার মাইজগ্রামে (ভারতের আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ)। তাঁর বাবা গোলক চন্দ্র সেন এবং মা সুশীলা সুন্দরী দেবী। ড. সেনের নানা ছিলেন তৎকালীন সিলেট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার বাদে-কুশিয়ারাকূল পরগনার বিখ্যাত জমিদার রাজকৃষ্ণ দত্ত চৌধুরী। তাঁর মামা ছিলেন ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বাবু গুরু সদয় দত্ত।
উল্লেখ্য যে, বাবু গুরু সদয় দত্ত ১০ই মে, ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে বীরশ্রীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কখনো ব্রিটিশদের দেওয়া পারিবারিক উপাধি "চৌধুরী" ব্যবহার করতেন না। ১৮৯৯ সালে তিনি এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) পরীক্ষায় আসাম প্রদেশে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯০৪ সালে তিনি আইসিএস (ICS) পরীক্ষায় ভারতবর্ষের মধ্যে সপ্তম স্থান লাভ করেন। তিনি সচিব পদমর্যাদায় উচ্চ পদে চাকরি করলেও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি জাত-পাত ও জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি সাহিত্যপ্রেমী ও গবেষক ছিলেন। তাঁর রচিত অনক বিখ্যাত রচনাবলী আছে। দেশের শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি একাধিক স্কুল প্রতিষ্টা করে গেছেন।
এবার আসি ড. ত্রিগুণা সেনের কথায়, যাকে নিয়ে আমার আজকের লেখা। তাঁর জন্ম ও বেড়ে উঠা বীরশ্রীর নানা বাড়িতে। তাঁর নানার প্রতিষ্ঠিত বীরশ্রী এম. ই. স্কুলে নিম্ম মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করে ১৯২১ সালে শিলচর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অসংখ্য ব্রিটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন তিনি। এজন্য ব্রিটিশদের চক্ষুশুল হয়ে পড়েন ও দুই-দুইবার কারা বরণ করেন।
১৯২৬ সালে তিনি বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিইশন (Bengal Technical Institution) থেকে ডিস্টিংশন সহ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের শাস্তি স্বরুপ সরকার বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ সম্রাজ্যের সর্বত্র তাঁর সরকারি চাকরি ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের অধিকার খর্ব করে।
১৯২৯ সালে ড. সেন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট (Indian Institute) থেকে স্কলারশীপ নিয়ে জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রকৌশল বিদ্যায় পি.এইচ.ডি. (PhD) ডিগ্রী অর্জন করেন। অনেক ভাল চাকরি ও অর্থের প্রলোভনও তাঁকে জার্মানিতে আটকে রাখতে পারেনি। পড়াশুনা শেষ করেই দেশে ফিরে এসে আবারো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এবার সরকার তাঁর প্রতি আর কঠোর হয় এবং গ্রেফতার করে। এক বছর কারাবাসের পর ১৯৩৩ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকার জন্য তাকে বাংলা থেকে বহিষ্কার করা হয়। বাঙলা থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি আসামে টিউবওয়েলের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিষিদ্ধ ছিলেন বলে বিভিন্ন বেসরকরি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সাচল্লিশে দেশভাগের সময় পরিবার পরিজন নিয়ে কলকাতায় স্থানান্তরি হন। যা মেনে নেওয়া তাঁর মত দেশপ্রেমিকের জন্য অনেক কষ্টের ছিল। নিয়তির করুণ পরিহাসে ব্রিটিশদের তাড়াতে গিয়ে নিজেই বিতাড়িত হলেন স্বদেশ থেকে।
এই পরিণতি কখনো মেনে নিতে পারেননি ড. সেন। প্রিয় মাতৃভূমি থেকে ব্রিটিশরা চলে গেল ঠিকই, শুধু ধর্মের নামে পাকিস্তানীরা নতুন করে পূর্ববঙ্গের দখল নিল। যা ছিল তাঁর মত স্বদেশী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতার জন্য বিষাদের, পাশাপাশি চরম অপমানের। এজন্য সব সময় স্বপ্ন দেখতেন বাঙ্গালীদের স্বাধীন সত্তার, স্বাধীন দেশের। সারা জীবন তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেছেন। জাত-পাত ও জমিদারি প্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।
দেশভাগের পর তিনি কলকাতার বিখ্যাত রিপন কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেন। এছাড়া তাঁর হাত ধরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ড. সেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন । ১৯৬৭ সালে ভারতের বিখ্যাত বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন ও বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়লে সরকার তাকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিলে দক্ষতার সাথে তিনি পরিস্থিতি সামাল দেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পরিবেশ ফিরিয়ে আনেন।
২০০৬ সালে আসাম ইউনিভার্সিটিতে ত্রিগুণা সেন স্কুল অফ টেকনোলজি (Triguna Sen School of Technology) নামে একটি ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়। উল্লেখ্য যে, ত্রিগুণা সেন প্রকৌশল বিদ্যার (Engineering) উপর ডক্টরেট ছিলেন। এছাড়া কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে "ত্রিগুণা সেন অডিটোরিয়াম" নামে একটি মিলনায়তন আছে।
কর্মজীবনে উল্লেখযোগ্য সময় তিনি শিক্ষকতা করলেও রাজনীতি ছিল তার অস্থি-মজ্জায়। একটা সময় তিনি কলকাতা পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। এটি ছিল সিলেট তথা পূর্ব বাংলায় জন্ম নেওয়া কোন বাঙালির কলকাতার মত বিখ্যাত শহরের পৌরসভার চেয়ারম্যান হওয়ার প্রথম কৃতিত্ব। ইন্দিরা গান্ধির প্রথম মন্ত্রীসভায় তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬৮ সালে ইন্দিরা গান্ধী ড. সেনকে দ্বিতীয় বারের মত কেন্দ্রীর শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে মতবিরোধের জেরে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন। তারপর তাকে আর সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে দেখা যায়নি।
২০১০ সালে ভারতের ডাক বিভাগ ডক্টর সেনের সম্মানে স্বারক ডাক টিকেট ছাপায়।
বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের কথা ভাবছিলেন তখন ড. ত্রিগুণা সেন ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর। ১৯৬১ সালে যখন আসামের কাছাড়ে ভাষা আন্দোলন হয় তখন তিনি আসামের শিলচরে ছিলেন। এসময় পূর্ব বাংলার নেতাদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। এসব নেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয় ড. সেনের। বাঙালিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বঙ্গবন্ধুকে তিনি পরামর্শ দেন এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতার ব্যাপারে ভূমিকা নেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। তিনি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য তৎকালীন নেহরু সরকারকে প্রভাবিত করার দায়িত্ব নেন। সে অনুযায়ী ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু আগরতলায় যান। এ সময় ড. সেন ত্রিপুরার রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। আগরতলায় বঙ্গবন্ধুর সাথে মিটিংয়ে তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।
ড. ত্রিগুণা সেন আজাদ বাংলা ও আজাদ পূর্ব পাকিস্তান বেতার কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করতে শক্তিশালী ট্রান্সমিশন বসাতে ইন্দিরা গান্ধীকে পরামর্শ দেন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকায় পূর্ববঙ্গ ও ইন্দির গান্ধীর সাথে সেতুবন্ধক হিসাবে কাজ করেন।
১৯৭১ সালের মে মাসে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ দূত হিসাবে আগরতলায় শরণার্থী শিবির ও মুক্তিবাহিনীর ক্যম্প পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি শরণার্থীদের সান্তনা দেন এবং তাদের সমস্যার কথা শুনেন। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং তাদের অনুপ্রাণিত করেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর বিশেষ আমন্ত্রণে ড. ত্রিগুণা সেন ঢাকায় আসেন। আবেগ আপ্লুত হয়ে বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু ড. সেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। পরে দুই নেতা দীর্ঘ সময় দেশ গঠনের ব্যাপারে মতবিনিময় করেন ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা বিভিন্নভাবে দেশকে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের সবাইকে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সম্মাননা দিয়েছেন। এসব সম্মাননা প্রাপ্তদের অন্যতম হলেন আমাদের জকিগঞ্জের গর্ব ড. ত্রিগুণা সেন।
আমরা প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। চেতনার ধারক, বাহক ও প্রচারক হিসাবে নিজেদের জাহির করতে ব্যস্ত থাকি। চেতনার নামে সমাজে ঘৃণা ছড়াই এবং সমাজকে বিভক্ত করি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেতনার উদ্ভোধ্যকারী মানুষদের অবদান ও ইতিহাস জানতে বড়ই অনীহা আমাদের। যে প্রচারবিমুখ শুভাকাঙ্খী মানুষদের জন্য দেশ স্বাধীন হলো তাদেরকে প্রচারের আলোয় আনি না। কৃতিত্ব দেই না। নিজেদের প্রচারে সর্বদা ব্যস্ত থাকলেও যাদের প্রচার হওয়ার কথা তাদের অবদান স্বীকার করতে, জানতে এবং অন্যদের জানাতে তেমন আগ্রহ নেই আমাদের। সুক্ষ কৃপণতা!
প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা কখনো নিজের ঢোল নিজে পেটায় না। এরা দেশ মাতৃকার সেবা করেন নীরবে, নিভৃতে। এরা সত্যিকারের হিরো। আমাদের সবার দায়িত্ব এ স্বর্ণ সন্তানদের খুঁজে বের করে দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরা। এতে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত হিরোদের চিনতে পারবে, জানবে। এসব গুণী মানুষদের দেখে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
সত্যি সত্যি দেশপ্রেমিক হওয়াটাই চেতনা; সত্যিকারের চেতনাবাজদের খুঁজে বের করাই চেতনা; সবাইকে একসাথে নিয়ে চলতে পারাই চেতনা; মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বুকে ধারণ করাই চেতনা; সংখ্যালঘু শব্দটি মাটি চাপা দিয়ে পারস্পপরিক অধিকার ও মর্যদা নিয়ে একসাথে বসবাস করাই চেতনা; অন্যায়-অবিচার, ঘুষ-দুর্ণীতি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাই চেতনা। বাকী সব ভন্ডামি।
তথ্যসূত্র-
The Royal Asiatic Society(Journal),
part 1, January (Yuan Chwang).
Ramesh Chandra Majumdar (8 edi)
Delhi, 1977.
daakticketindia.com
jaduniv.edu.in
aus.ac.in
mhrd.gov.in
etceju.org
ঢাকা টাইমস (জুন ১, ২০১৬).
যায়যায় দিন (মার্চ ১১, ২০১৫).
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৮ রাত ২:০১