আমরা খুব আবেগ প্রবণ জাতি। ঠিক এক বছর পর কেউ তিতুমীর কলেজের রাজীবের (দুই বাসের চাপায় হাত হারানো, পরে হাসপাতালে মৃত্যু) কথা মনে রাখবে না। তার দুই ভাই পড়াশুনা করতে পারলো কি না; পেট ভরে খেল কি না; কেউ খবর নেবে না। এর মধ্যে কত শত রাজীবের স্বপ্নের মৃত্যু হবে, পরিবার নিঃস্ব হবে; বাকশক্তি হারাবে, পঙ্গু হবে। হয়তো এদের দুই একজনকে মিডিয়ার কল্যাণে আমরা জানবো; বড় জোর দুই-চারদিন উহু, আহু করবো। ব্যাস, এ পর্যন্তই। মরুভুমিতে যেমন ধূলা-বালুর ঝড় এলে আপনার সুন্দর পোষাকটিকে নিমিষেই বালুময় করে দেবে; ঠিক তেমনি বালুকণার ন্যায় হাজারো সমস্যার মাঝে বসবাস করলে স্মৃতি আর বিবেকের কুঠরেও জং ধরে।
কত প্রভাবশালী মানুষ, কত রাজনীতিবিদ, কত শত সাধারন মানুষ গুম হলো। কত খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি ও মহামারি হল কেউ কি খবর রাখে? কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় খুন হওয়া তনুর কথা নিশ্চয় মনে আছে? কত মানববন্ধন, কত আর্তনাদ, কত চোখের জল বিফলে গেল। আসল কাজের কাজ কিছুই হলো না, অপরাধী চিহ্নিত হলো না, ধরা পড়লো না। ঘটনাটির মাত্র বছরখানেক হল কিন্তু মনে হচ্ছে একযুগ পেরিয়ে গেছে!
এটা কী আমাদের স্মৃতিভ্রম নাকি বিচারহীন সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ বলে ভোতা ও জং ধরা জাতীয় অনুভূতি তা আমি বুঝতে পারি না। কত শত তনু আজ স্মৃতির জ্যামে আটকে ভূলে গেছি হিসাব নেই। আরো কত তনুর বাবা মায়ের অসহায় আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হচ্ছে, আমরা কয়টি খবর রাখি, বলুন? রাজীবও একসময় হারিয়ে যাবে আমাদের দৃষ্টি থেকে, স্মৃতি থেকে, অনুভব থেকে। শুধু বেঁচে থাকবে তাঁর কষ্ঠের স্মৃতি, সারা জীবনের লালন করা একটু স্বচ্ছলতার স্বপ্ন আর প্রিয়জনদের চোখের জল।
যে সমাজে আইনের শাসন অনুপস্থিত। আইন আদালত ক্ষমতার দাপটে অসহায়, সে দেশে ন্যায়বিচারের আশা করা অন্যায়। এদেশে হাইকোর্টের বিচারপতিগন নিয়োগ পান রাজনৈতিক বিবেচনায়। প্রধান বিচারপতির নিয়োগ হয় সরকারী দলের আনুগত্যের মাপকাটিতে। এদেশে নেই কোন শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের রক্ষাকবচ। এখানে মানবাধিকার নিয়ে যারা কথা বলেন এদের বেশির ভাগ-ই মানবাধিকার ব্যবসায়ী। এরা বিদেশীদের কাছে আমাদের অসহায়ত্বের ছবি ও সংবাদ বিকিয়ে নিজের আখের গোছায়, সুবিধামত বিবৃতি দেয়, পকেট ভারী হলে কেটে পড়ে। নির্বাচন আসলে বিদেশীদের দেওয়া বড় সেলামী পেয়ে একদল লোক গণতন্ত্রের নামে ভেটারদের সবক দেন, গণতন্ত্র শেখান। ভোট শেষ, টাকার হিসাব শেষ। সাথে গণতন্ত্রের সবকও শেষ!
স্বাধীনতা উত্তর হঠাৎ গজিয়ে উঠা দেশের গুটিকয়েক পরিবারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষ এখনো জিম্মি। এ জিম্মি দশার কবে শেষ হবে কেউ জানে না।
এ দেশে কেউ স্বাধীনতা বিক্রি করে কোটিপতি, কেউ মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসা করে কোটিপতি, কেউ রাজাকার হয়ে কোটিপতি, কেউ রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকার সুত্রে কোটিপতি, কেউ চান্দাবাজি করে কোটিপতি, কেউ রাজনীতির ব্যবসা করে কোটিপতি, কেউ তেল (চাটুকারি) ব্যবসা করে কোটিপতি, কেউ ধর্ম বেঁচে কোটিপতি, কেউ জমি দখল করে কোটিপতি, কেউ খুন করে কোটিপতি, কেউ মন্ত্রী/এমপি হয়ে কোটিপতি, কেউ শিক্ষা বিক্রি করে কোটিপতি, কেউ ইয়াবা/ফেন্সিডিল/কোকেইন বিক্রি করে কোটিপতি, কেউ ম্যাডাম/নেত্রীর সু-নজরের জন্য কোটিপতি, কেউ সরকারি চাকরি নামক আলাদীনের চেরাগ পেয়ে কোটিপতি।
আর আমার মত প্রজাতন্ত্রের অতি সাধারন জনগণ; যারা উপরে উল্লেখিত কোন ক্যাটাগরিতে পড়ি না, যাদের কোন কোটার সুবিধা নেই, তারা যখন কোন অনাচার দেখি তখন আবেগী হয়ে উঠি। অতিশয় আবেগী! দরদ উথলিয়া উথলিয়া পড়ে আমাদের। ভীষণ কষ্ট পাই। সব সময় দেশপ্রেমের বড়াই করি, সুন্দর একটি শোষণমূক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করতে পারি না। কখনো কখনো করতে দেওয়া হয় না।
লোভের যেমন কোন পরিসমাপ্তি নেই, ঠিক তেমনি ভোগ বিলাসের আকাঙ্খা আমৃত্যু থাকে। এই আকাঙ্খা আসে উচ্চবিলাস ও অনুকরণের সংস্কৃতি থেকে। যারা সোজা পথে বিলাসিতা করতে অপারগ তারা বাঁকা পথের সন্ধান করেন। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক বড় দূর্ণীতিগুলো মানুষ করে চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর বয়সের পর। তখন পদের সাথে অভিজ্ঞতা বাড়ে, সুযোগ বাড়ে। কিন্তু এ সম্পদ ডালপালা দিয়ে বড় হতে হতেই এদের বেশিরভাগই দেহত্যাগী হোন। বয়সে কুলায় না। পরে পোষ্যদের মধ্যে চলে সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি আর মামলা মোকদ্দমা। কখনো খুণ খারাপি!
কেউ কেউ এই টাকা দিয়ে মসজিদ/মন্দির বানান। তীর্থ যাত্রা করেন। কোরবানী আসলে বাজারের সবচেয়ে দামী গরুটি কিনে লোক দেখানো কোরবানি দেন। শুক্রবারে জুম্মার নামাজে দামী পাঞ্জাবী-পায়জামা পরে মসজিদের সামনের কাতারে আসন নেন। রমজান আসলে দামী দামী হরেক রকম ইফতারির আয়োজন করেন (কেউ কেউ রোজা না রেখে)। চলে ইফতারি দেওয়া ও ঈদের কেনাকাটার পর্ব এই ঘুষের টাকায়। তাহলে কী লোভ, উচ্চাকাঙ্খা ও দুর্নীতি মানুষকে হিপোক্রেট বানায়? নাকি এগুলো তারা বিবেকের তাড়নায় অনুশোচনা থেকে করে!! জানা নেই আমার।
একটি ঘটনার কথা সব সময় মনে পড়ে, লন্ডনে থাকার সময় মরিশাসের একটি ছেলে আমার হাউজমেট ছিল, সে University of East London-এ আইন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করত। প্রায় সময় বাংলাদেশী একজন সহপাঠী বন্ধু তার কাছে আসতো। বাংলাদেশী এ ছেলেটির সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সে পড়াশুনার পাশাপাশি কোন পার্টটাইম জব করে না! শুনে অবাক হয়ছিলাম। লন্ডনের মত এতো ব্যয়বহুল শহরে তা কিভাবে সম্ভব? তার যাবতীয় খরছ নাকি সচিব বাবা প্রতিমাসে দেশ থেকে পাঠিয়ে দেন।
ছেলেটি হিসাব করে বল্ল, বছরে প্রায় বাইশ লক্ষ টাকা। একদিন কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম, সৎ পথে তার বাবার এত টাকা আয় করা সম্ভব কি, না? উত্তরে ছেলেটি বলেছিল, ঘুষ দুর্ণীতি করতেও যোগ্যতা লাগে, যা তার বাবা সচিব হয়ে অর্জন করেছেন! অতএব বাড়তি ইনকাম (ঘুষ খাওয়া) তার যোগ্যতারই প্রতিদান। উত্তর শুনে শুধু চেয়ে চেয়ে থাকলাম, কোন কথা মুখ দিয়ে বের হল না। ধন্য হলাম যোগ্য বাবার যোগ্য ছেলের জবাব শুনে। এ ছেলে একদিন ব্যারিস্টািরি পাশ করে দেশে গিয়ে বড় আইনজীবী হবে। রাজনৈতিক লিংক থাকলে হাইকোর্টের বিচারপতি হবে। প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত হওয়া হয়ত সম্ভব। আর রাজা/রাণীদের সুনজর থাকলে তো এমপি/মন্ত্রী! খুবই সম্ভব।
আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়লো। তখন লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রীটে কাজ করতাম। একদিন বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রীকে পাঁচ তারকা একটি হোটেলের নীচে পায়চারী করতে দেখলাম। সঙ্গে উনার স্ত্রী ও মেয়ে। উনার স্ত্রী বাংলাদেশের একজন নামকরা মানবাধিকার কর্মী এ জন্য সহজে চিনতে পারলাম। এভাবে দুই তিনদিন দেখা হল। একদিন কৌতুহল বশত এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করে জানতে চাইলাম হোটেলে অবস্থানের কারণ। তিনি জানালেন সেন্ট্রাল লন্ডনের মে ফেয়ারে (may fair) একটি বাড়ি কিনতে এসেছেন। দরদাম চলছে, কেনার প্রক্রিয়া শেষ করতে কিছুদিন লন্ডনে থাকতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, মে ফেয়ার হলো লন্ডন তথা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ভিআইপি এলাকা। এখানে দুই বেড রুমের একটি ফ্ল্যট কিনতে মিনিমাম ত্রিশ কোটি টাকা খরছ হয়। তিনি জানালেন, বাড়িটির দাম ৪.২ মিলিয়ন পাউন্ড (৫১ কোটি টাকা)। সাহস করে বল্লাম, আপনারা মন্ত্রী হয়ে কোটি কোটি টাকা খরছ করে বিদেশে বাড়ি কিনেন আর দেশের মানুষকে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখান, ঘুষ ও দূর্ণীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। মন্ত্রী মহোদয় আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে কছুটা লজ্জিত হয়ে চলে গেলেন। আমার এতো বড় স্পর্ধা দেখে বেশ বিরক্ত হলেন। অবশ্য দেশে হলে এমন প্রশ্ন করার সুযোগ ও সাহস কোনটিই হতো না। গোল্ডেন ভিআইপি (এ+ ক্যাটাগরি) বলে কথা!
আমরা শিক্ষক হয়ে শিক্ষা বিক্রি করি, বিচারপতি হয়ে ন্যায় বিচার বিক্রি করি, আইনজীবী হয়ে মিথ্যা আইন বিক্রি করি, আমলা হয়ে নাগরিক অধিকার বিক্রি করি, উর্দি পরে মানুষ শোষণ করি, রাজনীতিবিদ হয়ে দেশ বিক্রি করি, কালো টাকার মালিক হয়ে রেমিটেন্স পাচার করি, ধার্মিকের নামে ধর্ম বিক্রি করি, লেখক হয়ে চাটুকারি করি, মানবাধিকারের নামে অধিকার বিক্রি করি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের নামে মানুষকে বিভক্ত করি, সমাজ সেবার নামে সমাজ বিক্রি করি, ডাক্তারীর নামে মানুষ কোরবাণী করি, ঔষধের নামে নেশার বড়ি/বোতল বিক্রি করি।
এতে আমাদের বিবেকে বাঁধে না; বিবেক শাণিত করিনি বলে। আর বিবেক নেই বলে এতো এতো জাতীয় দিবস ঘটা করে উদযাপন করেও বুকের কোনায় একটুও দেশপ্রেম জাগে না। বিবেকের কোটরে জমা হয় শুধু লোভ, ভোগ, অবিচার ও ঘৃণা। যার ফলে আমরা হই মুখোশধারী মানুষ নামক রোবট।
তাই বলি কি অন্তত: নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য সম্ভব হলে চুপ থাকি। সব কিছু দেখেও কিছুই দেখিনি, কিছুই বুঝিনি বলে এড়িয়ে যাই। আর নিজের বেলায় কোন অঘটন যাতে না ঘটে এজন্য সতর্ক থাকি। কারণ আমরা হচ্ছি অতি সুবিধাভোগী, বিবেকহীন, দেশপ্রেমহীণ, কালো টাকার মালিক একটি সমাজের অচল পয়সা মাত্র।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৮