
যেদিন ফুল গাছটি সম্পুর্ন রুপে মরে গেল সেদিন কষ্টে রাতে ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এর পর অনেক দিন পেরিয়ে গেল। ছোট্ট মনে সে সব আর মনেই রইলোনা। তখনকার কথা তখন মনে থাকতোনা, কিন্তু এখন ? ঠিকিই মনে পড়ে। আর হারিয়ে যায় মন সে ছোট্ট বেলায়। একেকটি সুখ স্মৃতি আমাদের কখনো হাসায় কখনো বা কাঁদায়।
এর বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ভাইয়া দেখি কিসব পলিথিনে করে নিয়ে আসলো। আমাদের ধরাতো দুরে থাক, দেখতেও মানা । পরদিন সকালে দেখি খন্দা কোদাল নিয়ে ভাইয়া মাটি কুড়ে কয়েকটা পাতা বাহার, কিছু দশটা ফুল (আসল নাম জানিনা, আমরা সবাই তখন সেটাকে দশটা ফুল বলতাম) লাগিয়ে দিলেন। আর নিয়ম করে অল্প অল্প পানি দিতেন। গাছগুলো আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠলো। আমাদের আনন্দ দেখে কে? যখনি সময় পেতাম তখনি সে গাছগুলোর পাশেই বসে থাকতাম। ছুতে মানা, তারপরও লুকিয়ে ছুয়ে দেখতাম।
হঠাৎ কি হলো, ভাইয়া সব পাতা বাহার আর দশটা ফুলের গাছ তুলে ফেলে দিলেন। মনে হলো কেউ যেন আমাদের আনন্দ গুলোকেই ছিড়ে ছিড়ে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এর পর একদিন ভাইয়ার জমানো মাটির ব্যাঙকটি ভেঙ্গে ফেল্লেন। অনেক গুলো টাকা বেরুলো। ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, চার আনা, আট আনা আর এক টাকা মিলিয়ে প্রায় ৭০-৮০ টাকা হবে। ভাইয়া সব টাকা দিযে শহর থেকে অনেক গুলো ফুলের গাছ আর অজানা সব ফুলের বীজ নিয়ে হাজির।
ভাইয়াতো বড়। তাই বড় কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে পারে। কিন্তু এত বড় কোদাল আমরা হাতেই উঠাতে পারিনা। কি করি? শক্ত বাঁশের কঞ্চি এক পাশে দা দিয়ে চিকন করে ধাড়ালো করে সেটা দিয়েই মাটি খুড়তাম। কিন্তু সেটাও দুয়েকবার করার পর ভেঙ্গে যায়। পরে বাবা আমাদের জন্য একটা ছোট্ট কোদাল নিয়ে এলেন। আমাদের আনন্ধ দেখে কে? কিন্তু সেটা নিয়ে আরেক বিপত্তি। আমি আর ছোটতো ঝগড়া বাধিঁয়ে দিলাম। সেটা কে নেবে । পরে সিন্ধান্ত হলো আমি কিছুক্ষন, ছোট ভাই কিছুক্ষন, এভাবেই আমরা মাটি কাটবো। এভাবে একদিন আমরা পুরো জায়গা জুড়ে অনেক গুলো ফুলের গাছ লাগালাম। যে বীজগুলো আনা হলো সেগুলোও ভাইয়া দেখে দেখে বপন করে দিলেন। বাবা করে দিলেন বাগানের জন্য বাঁশের বেড়া। যাতে গরু ছাগল, মুরগী কিংবা বাচ্চারা সেখানে ঢুকে বাগান নষ্ট না করে। আর আমরা নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে বাগানে পানি দিতাম। স্যার থাকতেন পরিচালনায়।
বাগানটি যেন আমাদের সন্তান। প্রতিদিন প্রতিটি মুহুর্তে সেটার খোঁজ নেয়া, কোন গাছ কাতঁ হয়ে গেলে সেটাকে বাশেঁর কঞ্চি দিয়ে ঠেস দিয়ে সোজা করে দেয়া। মাটি শক্ত হয়ে গেলে সেটা খুব সাবধানে কুড়ে দেয়া, পানি শুকিয়ে গেলে পানি দেয়া। হাস মুরগী তাড়ানো। কতো কি। আম চুরি, ডাঙ্গুলি, মারবেল, লাটিম, কাদা মাঠে ফুটবল, পুকুরে ডুব সাঁতার সব ভুলে বাগান নিয়েই ব্যস্থ হয়ে পড়লাম। কোন কাজ না থাকলেও আমরা সেটার পাশে বসে থাকতাম। দেখতাম কোন গাছটা বড় হচ্ছে, কোন গাছের আরেকটা পাতা বেরুচ্ছে। আহ সে এক মজার ব্যাপার । মা বকতেন, ও গুলোর পাশে বসে থাকলেকি গাছগুলো বড় হয়ে যাবে??? কে শুনে সেসব??? বসেই থাকতাম।
এভাবাবে দিন পেরিয়ে সাপ্তাহ পেরিয়ে মাস গেল। আমাদের বাগানে ফুলের কলি আসতে শুরু করেছে। সেকি আনন্দ আমাদের। মাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখাতাম। দেখো দেখো ওইটাতে বাচ্চা আসছে। মা হাসতো, আপুরাও। এতটুকু সাফল্যে ভাইয়া উৎসাহ পেয়ে বাকী খালি স্থানটাতেও ফুল গাছ লাগিয়ে দিলো। একদিন সব গাছেই ফুল ফুটলো। কতো রকমের ফুল। গোলাপ, সুর্যমুখী, রজনী গন্ধা, গাঁদা, (গাঁদা ফুলের মাঝেও বেশ কয়েক রকম) গন্ধরাজ সহ আরো নাম না জানা প্রায় ১০-১১ রকমের ফুলে আমাদের স্বপ্নের বাগান ফুলের সুভাস ছড়াতে লাগল চারিদিক।
প্রথম বারেই এতো ফুল ফুটেছিলো যে অবাক করার মতো। একেকটি গাঁদা আর গোলাপ গাছে প্রায় ১৫-২০টা পর্যন্ত ফুল ফুটলো। আর ফুল গুলো এতো বড় বড় ছিলোযে অবিশ্বাসের মতো। আমি অন্তুত আমার জীবনে আজ পর্যন্ত এত বড় গোলাপ আর গাঁদা ফুল দেখিনি। ফুল ছাড়া গাছ দেখাই যায়না। এটা হয়তো বাগানের প্রতি আমাদের ছোট্ট মনের ভালবাসার প্রতিদান আল্লাহ পাকের। ফুলের ভাড়ে গাছ ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। তাই ভাইয়া প্রতিটি গাছেই চার পাচঁটা করে কঞ্চি দিয়ে দাড় করিয়ে রাখতো। একটা আশ্চর্য ব্যাপার ছিলো, আমাদের পাড়ার ছোট বড় কেউই একটা ফুলও ছিড়তো না। সবাই শুধু কাছে গিয়ে দেখতো। সবাই বাগানটাকে আসলে ভালবেসে ফেলেছিল। ফুলকে কে না ভালবাসে?

কিন্তু আমাদের এ স¦প্ন বাগান, ভালবাসার বাগান একদিন তছনচ করে দিলো এক বিবেকহীন স্বার্থান্বেসী হায়েনার দল। আমাদের গ্রামে চেয়ারম্যান ইলেকশনে অনেক বড় একটা গন্ডোগোল হয়ে গেল। তাতেই আমাদের বাড়িরই একজন ছেলে খুন হয়। সে ছিলো আবার এমপির ডান হাত। সবসময় সে এমপির সাথেই থাকতো। যেদিন সে মারা যায় সেদিন গ্রামটা একটা রনক্ষেত্রে পরিনত হয়। এক ভয়াবহ অবস্থা। চারিদিকে পুলিশ আর পুলিশ। ছেলেটিকে দাফন করা হবে সকাল বেলা, খুব ভোরে ভোরে। সকালবেলা এমপি আসবে, এমপিকে মালা পড়ানো হবে। এমপি সাহেব ছেলেটির কবরে ফুল দেবে। এত রাতে কোন দোকানে ফুল পাবে? তারা চাইলে গাড়ি করে শহর থেকেও নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সেটা করবেনা। তাদের শকুনি চোখ কুদৃষ্টি হানলো আমাদের বাগানে।
ভাইয়াকে বল্লো কয়েক কিলো ফুল বিক্রি করতে । ভাইয়ার এত কষ্টের, এত স্বপ্নের বাগান কি ফুল বিক্রি করার জন্য?? উনি রাজি না। ভাইয়া বল্লো একটু কষ্ট করে শহর থেকে নিয়ে আসতে পারেন। এখনো তেমন রাত হয়নি। এ ফুল আমার, আমার ছোট ভাইদের স্বপ্ন। এটা আমি বিক্রি করতে পারবোনা। একটা ফুলও না। এটা নিয়ে ভাইয়ার সাথে ছেলেগুলো অনেক রাগারাগি করলো। ভাইয়া দিলোনা। আমরা যে যার মতো রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে প্রতিদিনকার মতো বাগানে পানি দিতে গিয়ে দেখি বাগান পুরো খালি। ভাইয়াতো আকাশ থেকে পড়লো। কোথায় গেল সব ফুল। কে করলো আমাদের এত বড় সর্বনাশ। কে আমাদের স্বপ্নটাকে এভাবে ধুলিশ্যাত করে দিলো? ভাইয়ার চোখের পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো তাহারই লালিত বাগানে।
পরে খবর পাওয়া গেল যে, তারা ভাইয়ার কাছে ফুল চেয়ে না পেয়ে আমার সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাতের অন্ধকারেই চুপি চুপি সব ফুল চুরি করে নিয়ে যায়। তাদের যেটুক ফুল দরকার তার চেয়ে ৫গুন বেশি ফুল ছিড়ে নিয়ে গেল। এমনকি ফুল ছিড়ায় তারা একটুও আন্তরীকতা দেখায়নি, ফুল ছিড়তে গিয়ে গাছগুলোর বেহালাবস্থা করে দিয়েছে। গোলাপ আর গাঁদা ছিড়েছো ঠিক, কিন্তু আমাদের সুর্যমুখী আর রজনীগন্ধা কি দোষ করলো? তাদের এভাবে ভেঙ্গে দিয়ে গেলে কেন?
ভাইয়া তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইতে গেলে তারা ভাইয়াকে মারবে বলেও হুমকি দিতে লাগল। তখন পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ, তাই মুরব্বীরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে ভাইয়াকে চুপ করালেও উনার চোখের পানিতো কেউ থামাতে পারেনি। কেদেঁ বুক ভাসিয়েছিলো নিরবে নিভৃতে।
কয়েকটি শিশুমনের সুন্দর পবিত্র স্বপ্নকে দলে মুছড়ে তাদেরই স্বপ্নে গড়া বাগানের ফুল চুরি করে, সেই ফুল দিয়ে একজন এমপিকে বরন করে নেয়ায় কি এমন গৌরবের ? এমপি সাহেব সেই চুরি করা ফুল দিয়ে মৃত ব্যক্তির কবরে শুভেচ্ছা জানিয়ে কি এমন সাওয়াবের কাজ করলো?। কয়েকটি শিশুর স্বপ্ন ভেঙ্গে, তাদের মনে কুড়াল মেরে কবরে ফুল দেয়ার মাঝে কি এমন স্বার্থকতা? কি লাভ? কি সৌখিনতা? কয়েকটি শিশুর চোখের পানি মিশ্রিত ফুলের সুভাসে সেদিন হয়তো মৃত ব্যক্তিটিও লজ্জিত ছিলো। সে লজ্জা যদি তারা দেখতো পেতো। কিন্তু আপসুস দেখলোনা।
নাহ, সবাই বলা সত্বেও ওই বাগানের আর কোন রুপ যত্নে নেয়নি ভাইয়া। আমরাও না। আর কখনোই করা হয়নি ফুলের বাগান।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:৪৯