সেই ছোট বেলায় হঠাৎ একদিন আমাদের ঘরে এক স্যার এসে হাজির। উনাকে থাকতে দেয়া হলো কাচারী ঘরেই। বাবা অফিসে গেলেই আমরা হয়ে যেতাম মুক্ত স্বাধীন। এখন তা আর হবেনা, না স্কুল ফাকি দেয়া হবে? না ডাঙ্গুলি মারবেল ডুব সাঁতার কিংবা কাদামাঠে সারাদিন ফুটবল খেলা। না ভর দুপুরে কাঁচা আম চুরি করে খাওয়া। আসার সাথে সাথেই স্যারটির প্রতি রাগ হতে শুর হলো। কি আর করা স্যারের প্রতি প্রচন্ড রাগ নিয়েই আমাদের বন্ধী জীবনের শুরু।
স্যার যেখানে থাকতেন, মানে আমরা যেখানে পড়তাম সে কাচারী ঘরের সামনের খোলা জায়গাটিতে উঠে আসা আগাছা গুলো আর নিত্যকার ময়লা স্যার আমাদের দিয়েই প্রতিদিন নিয়ম করে পরিস্কার করাতেন। স্যারের প্রতি রাগটা আরো কয়েকগুন বেড়ে গেল। একদিন কি মনে করে জানি আম জাম কুল ও শিম সহ আরো কয়েকটি চাড়া গাছ তিনি যত্ন করে রেখেই দিলেন। তখন কিন্তু এসব গ্রামঞ্চলে প্রতি পদে পদেই দেখা যেত। তাই আম জাম লতা পাতায় তিনি কাচারী ঘরের সামনে আলাদা কোন সৌন্দর্য ঠিক ঠাক খুঁজে পেলেন না। একদিন সেসব মুলোতপাঠন করে বিনাশ করা হলো। আবারও সুনসান পরিস্কার উঠোন। বিকেলে চেয়ার পেতে বসে বই পড়তে একটু আরাম অনুভব করতেন সেই খোলা জায়গায়।
স্যার ছিলেন খুবিই পরহেজগার। আমাদের বাবার মতোই। অন্য সময় আমরা হাতের নাগালের বাইরে থাকলেও ঠিক সন্ধ্যায় মাগরিবের নামযটা উনার সাথেই পড়তেই হতো। উফ এ আরেক ঝামেলা। শুধু নামায পড়া পর্যন্ত হলেই হতো। সেখানে আবার ক্বেরাত গুলো ঠিকঠাক করে উচ্চস্বরে উনাকে শুনিয়ে পড়তে হবে। রুকু সিজদাও এদিক ওদিক করা যাবেনা। নামায শিক্ষা পর্যন্ত ঠিকিই ছিলো। একদিন উনি আযান শিখানোই মনোযোগী হলেন। উফ অসহ্য।
তাও আবার বাইরে দাড়িয়ে দিতে হবে। পড়লাম আরেক বিপত্তিতে। কি আর করা? কাচারী ঘরের বাইরে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কানে আঙ্গুল দিয়ে উচ্চস্বরে মাগরিবের আযান দিতে লাগলাম। পুরো আযান দিতে হলোনা, অর্ধেক দিয়েই ভাগলাম। কারণ, হঠাৎ আযান শুনে পাড়া প্রতিবেশি সবাই দৌড়ে এসে হাজির। সবাই কানা ঘুষা করতে লাগল আরে আরে কার বাচ্চা হলোরে ? ছেলে না মেয়ে? (কারণ তখন কারো বাচ্চা হলেই বড় করে আযান দেয়া হতো।) পাড়ার এক দুষ্টু আপুতো বলেই বসলো, কিরে তোদের স্যারের মেয়ে হলো না ছেলে? সবাই হেসে কুটি কুটি। সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা। সে কি লজ্জা পেয়েছিলাম। কিন্তু স্যার দমবার পাত্র নন। উনি কে কি বলে সে সবের তোয়াক্কা না করে আমাদের আযান শিখানোয় ব্যস্থ। পাড়ার এক জন মুরব্বি এসে জড়ো হওয়া সবাইকে তাড়িয়ে দিলেন।
তখন ছোট্ট মনে যেটা দেখতো সেটাই ভালো লাগতো। তার ফলেই হয়তো আমাদের আযান দেয়া, নামায পড়াটা দেখে আরো কিছু ছেলেফুলে তাদের ঘরের সামনে দাড়িয়ে পূব পশ্চিমের তোয়াক্কা না করেই মাগরিবের সময় উচ্চস্বরে আযান দেয়া আরম্ভ করতো। এটা একটা আযান আযান খেলায় পরিনত হলো। প্রথম প্রথম সবাই হাসলেও পরে আর হাসতোনা। একদিন স্যার সবাইকে ডেকে বল্লো, শোন প্রতিদিন একজন করে আযান দেবে, আর সবাই একসাথে এখানে নামায পড়বে কেমন? সবাই খুশি। যেদিন যার পালা আসতো আযান দেয়ার, তার সেকি প্রস্তুতী । সারাদিন খালি আযান আর আযান। কার থেকে কে সুন্দও করে আযান দেবে সেটাই ছিলো চেষ্টা। মাগরিবের সময় হলেই পাড়ার পিচ্চিপাচ্চা সব মাথায় টুপি দিয়ে হাতে মাদুর নিয়ে হাজির। ছোট মেয়ে বাবুরাও কান্নাকাটি করতো। স্যার তাদেরকেও দাঁড় করিয়ে দিতেন। আহ সেকি এক মধুর দিন ছিলো। একটি বার যদি ফিরে পেতাম সেসব দিন।
এভাবে ক,দিন যেতে না যেতেই স্যার আমাদের এতটাই আপন করে নিলো যে, স্যারের প্রতি প্রচন্ড রাগ আর ভয় কখন যে উধাও হয়ে গেল ঠেরই পেলাম না।
হঠাৎ একদিন দেখি কি একটা ফুলের গাছ নিয়ে হাজির। ঠিক কোন জায়গায় লাগাবেন সেটা নিয়ে অনেক সময় ধরেই সিন্ধান্ত নিতে হলো। পরে স্থির হলো উনি যেখানটায় চেয়ারে বসে বই পড়েন, ঠিক তার ডান পাশেই গাছটি লাগানো হবে। চাড়া গাছে ফুল ফুটবে, একটু ডানে হেল্লেই সুগন্ধ দোলা দিয়ে যাবে। কিন্তু উনার সেসব স্বপ্ন আমরাই নিশ্বেঃষ করে দিলাম ফুলের গাছটি লাগানোয় ভুল করে। ফুলের শিশু গাছটির গোড়ায় পলিথিনে মোড়ানো যেসব উর্বর মাটি ছিলো সেসব ছুড়ে ফেলে শক্ত মাটি খুড়ে সেখানটায় পুতে দিয়ে সে শক্ত মাটি আরো শক্ত করে ঠেসে দিলাম।
এরপর চারিদিকে মাটির ছোট্ট দেয়াল বানিয়ে সেখানে ডুবু ডুবু করে পানি জমা করে দিলাম। ফলে দুদিনেই ফুলগাছ মরে কাইত। সে সময় খেলাচ্ছলে কতো গাছের চাড়া তুলে ছুড়ে ফেলতাম, কতো ঢালপাতা ছিড়ে ছিড়ে খেলতাম তার কোন হিসেব নেই। কিন্তু এবার এ একটি ফুল গাছের জন্য আমাদের কেন জানি অনেক কষ্ট হলো। কতো কি না করেছিলাম সেই ফুল গাছটির জন্য। মরে যাওয়া গাছটির উপর বারবার পালি ঢালতাম এ আশায় যে, হয়তো সে আবার জেগে উঠবে। বড় কলাপাতা দিয়ে রোদ থেকে বাঁচানোর জন্য গাছটির উপর ছায়া দিতাম। কিন্তু না সে আর ফিরে এলোনা। সে চলে গেল আমাদের ছোট্ট শিশু মনে কষ্ট দিয়ে। সে হারানোর দুঃখ কেন জানি এখনো ভুলতে পারিনি, ভুলতে পারিনি সেই চাড়া গাছটির ধীরে ধীরে মরে যাওয়ার দৃশ্যও। গাছ বলে তাই বলতেও পারিনা ”ভাল থাকিস তুই যেখানেই আছিস”