হেরা গুহায় প্রথম কিছু আয়াত নাযিলের পর অনেক দিন হয়ে গেল কিন্তু নতুন কোন ওহী নাযিল হচ্ছিল না। আল্লাহর বাণী নিয়ে জীবরাইল (আঃ) অনুপস্থিত। এ ব্যাপারে মুহম্মদ (সাঃ) ভীষণ যন্ত্রণায় ভুগছিলেন (ইবনে জারীর)। এমনই একদিন তিনি যখন মক্কার রাস্তা দিয়ে হাটছিলেন, তখন হঠাৎ আওয়াজ শুনে উপরের দিকে তাকালেন। দেখলেন এই তো সেই ফেরেশতা যিনি হেরা গুহায় ওহী নিয়ে এসেছিলেন। এভাবে আকাশে ভাসমান ফেরেশতাকে দেখে ভয় পেয়ে মুহম্মদ (সাঃ) তড়িঘড়ি বাড়িতে ফিরে গেলেন এবং বাড়ির লোকজনকে বললেন তাকে গরম কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ধরতে। তখনই ওহী নাজিল হল:
১. হে বস্ত্রাচ্ছাদিত।
২. উঠ, সতর্কবাণী প্রচার কর। (মানুষকে সতর্ক করে দাও যে তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না।)
৩. এবং তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর।
৪. তোমার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখো। (অবাধ্যতা, বিশ্বাসঘাতকতা থেকে দূরে থাকো। নৈতিক চরিত্রকে পবিত্র রাখো।)
৫. অপবিত্রতা হতে দূরে থাকো। (প্রতিমা বা মূর্তি হতে দূরে থাকো।)
৬. অধিক পাওয়ার প্রত্যাশায় দান কর না। (তুমি যার প্রতি অনুগ্রহ করবে, নিস্বার্থভাবে করবে। মহানুভবতার বিনিময়ে কোন প্রকার পার্থিব স্বার্থ হাসিলের চিন্তা কর না।)
৭. এবং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণ কর। (দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তুমি নানারকম বাঁধা বিপত্তির সম্মুখীন হবে। এতে বিচলিত হলে চলবে না। ধৈর্য্য ধারণ করবে।)
৮ যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। (কিয়ামতের সময় প্রথম ফুৎকারে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। সকল জীবিত প্রাণ হারাবে। দ্বিতীয় ফুৎকারে আবার তাদেরকে জীবন দান করে একত্রিত করা হবে। এখানে দ্বিতীয় ফুৎকারের কথা বলা হয়েছে।)
৯ সেই দিন হবে সংকটের দিন। (সেই দিন হবে খুব ভয়াবহ একটা দিন।)
১০ যা কাফিরদের জন্য সহজ নয়। (কাফিরদের জন্য দিনটি খুব কঠিন হবে।)
নির্দেশনা অনুযায়ী ধীরে ধীরে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) ইসলাম প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন হজ্জ্বের মৌসুম সমাগত প্রায়। এসময় বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজ্বীরা এসে সমবেত হবেন মক্কায়। তারা যদি হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর কথা শুনে, কোরআনের বাণী শুনে তাহলে সমগ্র আরবে তার বাণী পৌছে যেতে পারে। অনেকেই এতে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে। এ চিন্তা কুরাইশদের আতংকিত করে তুলল। তাই তারা স্থির করল সবাই মিলে মুহম্মদ (সাঃ) এর বিরূদ্ধে এমন রটনা রটাবে যাতে সবাই মুহম্মদের থেকে দূরে থাকে। এ বিষয়ে তারা একটি সম্মেলনের আয়োজন করল। সব কিছু যখন ঠিকঠাক চলছিল তখন বাঁধ সাধল ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা নামক এক সম্পদশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি যে প্রথম থেকেই হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর ঘোর বিরোধী ছিল। সে হঠাৎ করে কোরআনের বাণীর প্রশংসা করে বলে উঠল, আমরা মুহম্মদের ব্যাপারে ব্যাপারে এমন উল্টাপাল্টা কথা বললে তা ধোপে টিকবে না। সে কবি না, পাগল না, জাদুকরও না। তার কথা শুনে আবু জেহেল আতংকিত হয়ে পড়ল। মুগীরা কি তবে ইসলাম গ্রহণ করে ফেলবে? তাহলে তো সর্বনাশ! এ হলে তো তার সাথে সাথে অন্য অনেক কুরায়েশরা বিনা বাক্যে ইসলাম গ্রহণ করবে। যেভাবেই হোক মুগীরাকে পথে আনতে হবে। সে মুগীরাকে বুঝিয়ে বলল, তুমি যতক্ষণ না পর্যন্ত মুহম্মদের বিরূদ্ধে কোন কথা বলছ ততক্ষণ তোমার কওমের লোকজন তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। একথায় মুগীরা চিন্তিত হয়ে পড়ল এবং কিছুক্ষণ পর সম্মতি দিয়ে বলল, আমরা তাকে জাদুকর বলে আরবের লোকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেব। বলব, সে এমনই এক জাদুকর যার জাদু পরিবারের লোকদের মধ্যেও বিভেদের সৃষ্টি করে দেয়। নাযিল হল:
১১ আমাকে ছেড়ে দাও এবং তাকে যাকে আমি সৃষ্টি করেছি অসাধারণ করে। (যে ব্যক্তি সমগ্র আরব জাতির কাছে তোমাকে জাদুকর হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল তাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও। এ বিষয়ে তোমার চিন্তা করার দরকার নেই। )
১২ আমি তাকে দিয়েছি বিপুল ধনসম্পদ। (তার সকল সম্পদ আমারই দান।)
১৩ এবং নিত্য সঙ্গী পুত্রগণ। (তার সকল ছেলে সন্তান সবসময় তার সাথেই থাকতো। তাকে প্রচুর ধন-সম্পদ দিয়ে আমিই তাকে তার পুত্রদের পাশে রাখার এ সুযোগ করে দিয়েছি।)
১৪ এবং তাকে দিয়েছি স্বচ্ছন্দ জীবনের উপকরণ।
১৫ এরপরও সে কামনা করে যে আমি তাকে অধিক দেই। (সে আরো সম্পদ ও ভোগ বিলাসের সামগ্রী অর্জনের চিন্তায় বিভোর থাকে।)
১৬ না, তা হবে না। সে তো আমার নিদর্শন সমূহের উদ্ধত বিরূদ্ধচারী। (না, তাকে আর কিছুই দেব না। সে আমার আয়াতসমূহ বিশ্বাস করে না।)
১৭ আমি অচিরেই তাকে ক্রমবর্ধমান শাস্তি দ্বারা আচ্ছন্ন করব।
১৮ সে তো চিন্তা করল এবং সিদ্ধান্ত করল। (সে অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটা ফন্দি বের করল- মুহম্মদ (সাঃ) কে জাদুকর বলে পরিচয় করিয়ে দেবার।)
১৯ অভিশপ্ত হোক সে। কেমন করে সে এ সিদ্ধান্ত করল!
২০ আরো অভিশপ্ত হোক সে। কেমন করে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল।
২১ সে আবার চেয়ে দেখল। (সে উপস্থিত সকলের দিকে তাকাল।)
২২ অতঃপর সে ভ্রুকুঞ্চিত করল।
২৩ অতঃপর সে পেছন ফিরে তাকালএবং দম্ভ প্রকাশ করল। (সে পিছু হটল ঈমান আনয়ন থেকে।)
২৪ এবং ঘোষণা করল এটা তো লোক পরম্পরায় জাদু ছাড়া আর কিছু নয়।
২৫ এটা তো মানুষেরই কথা।
২৬ আমি তাকে দোযখে নিঃক্ষেপ করব।
২৭ তুমি কি জান দোযখ কী?
২৮ ওটা তাদেরকে জীবিত রাখবে না এবং মৃত অবস্থায় ছেড়ে দিবে না। (যাকেই দোযখের আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে তাকেই সে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তিটি মারা যাবে না। তাকে অনবরত দোযখের আগুনে পুড়তে হবে।)
২৯ এটা তো গায়ের চামড়া ঝলসিয়ে দিবে।
৩০ এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে উনিশজন প্রহরী।
উনিশ জন! জাহান্নামের মতো ভীষণ ভয়ানক এক স্থানের পাহাড়ায় বুঝি মাত্র উনিশজন ফেরেশতা নিযুক্ত? কুরায়েশরা এ বিষয়ে রীতিমতো হাসিঠাট্টা শুরু করল। আবু জেহেল বলল, হে কুরায়েশদের দল! তোমরা তোমাদের দশজন কি তাদের একজনের উপর জয়লাভ করতে পারবে না। আবুল আশদাইন নামের একজন বলে উঠল, হে কুরায়েশদের দল! তোমরা দুজনকে প্রতিহত কর, বাকী সতেরোজনকে প্রতিহত করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। নাযিল হল:
৩১. আমি ফেরেশতাদের করেছি জাহান্নামের প্রহরী; কাফিরদের পরীক্ষাস্বরূপই আমি তাদের এই সংখ্যা উল্লেখ করেছি যাতে কিতাবীদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে, বিশ্বাসীদের বিশ্বাস বর্ধিত হয় এবং বিশ্বাসীরা এবং কিতাবীগণ সন্দেহ পোষণ না করে। এর ফলে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, তারা ও কাফিররা বলবে: আল্লাহ এ উক্তি দ্বারা কি বুঝাতে চেয়েছেন? এইভাবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ ভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথ নির্দেশ করেন। তোমার প্রতিপালকের বাহিনী সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন। জাহান্নামের এই বর্ণনা তো মানুষের জন্য সাবধান বাণী। (উনিশজন ফেরেশতাকে জাহান্নামের প্রহরী হিসেবে নিযুক্ত করে তাদের সংখ্যা উল্লেখ করেছি কাফেরদের পরীক্ষা করার জন্য। এ সংখ্যা শুনে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হবে আর কাফেররা প্রশ্ন করা শুরু করবে। এভাবেই আমার বাণী শুনে ইমানদাররা সঠিক পথ ধরে আর কাফেররা সেই সরল সহজ কথাটাকে বাঁকা চোখে দেখে ন্যায় ও সত্য পথ থেকে দূরে সরে যায়। ফেরেশতাদের সংখ্যা ও শক্তি সম্পর্কে একমাত্র তিনিই জানেন।)
৩২.কখনই না। চন্দ্রের শপথ। (চাঁদের শপথ এটা কখনোই সম্ভব না। মানুষের দ্বারা ফেরেশতাদের মোকাবেলা করা কখনোই সম্ভব না।)
৩৩. শপথ রাত্রির। যখন এর অবসান ঘটে।
৩৪. শপথ প্রভাতকালের, যখন ওটা হয় আলোকোজ্বল।
৩৫. এই জাহান্নাম ভয়াবহ বিপদসমূহের অন্যতম।
৩৬. মানুষের জন্য সতর্ককারী।
৩৭. তোমাদের জন্য যে অগ্রসর হতে চায় কিংবা যে পিছিয়ে পড়ে তার জন্য। (জাহান্নাম দ্বারা মানুষকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। কেউ ইচ্ছে করলে এর ভয়ে কল্যাণের পথে আরো এগিয়ে যেতে পারো, আবার চাইলে কল্যাণ থেকে দূরে সরে যেতে পার।)
৩৮. প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের দায়ে আবদ্ধ। (প্রত্যেক ব্যক্তিই তার পাপের জন্য শাস্তি পাবে।)
৩৯. তবে দক্ষিণপার্শ্বস্থ ব্যক্তিরা নয়, তবে মুমিন ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হবে না।
৪০. তারা থাকবে উদ্যানেএবং তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে।(তাদেরকে স্বর্গীয় উদ্যানে রাখা হবে। তারা জাহান্নামের শাস্তিপ্রাপ্তদের জিজ্ঞেস করবে।)
৪১. অপরাধীদের সম্পর্কে, (তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে তাদের অপরাধ সম্পর্কে।)
৪২. তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে।(কী কারণে তোমাদের জাহান্নামে রাখা হয়েছে।)
৪৩. তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। (তারা উত্তর দিবে, আমরা নামায আদায় করি নি।)
৪৪. আমরা অভাবগ্রস্তদেরকে আহার্য দান করতাম না। (অভাবগ্রস্তকে সাহায্য করতাম না।)
৪৫. এবং আমরা আলোচনাকারীদের সাথে আলোচনায় নিমগ্ন থাকতাম।(আমরা ইসলাম ধর্মের ছিদ্রান্বেষণ করতাম।)
৪৬. আমরা কর্মফল দিবস অস্বীকার করতাম। (কিয়ামতের দিন অস্বীকার করতাম।)
৪৭. আমাদের নিকট মৃত্যুর আগমন পর্যন্ত। (মৃত্যু পর্যন্ত আমরা এমনটাই করেছি।)
৪৮. ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। (তাই তাদের পক্ষে করা কোন সুপারিশ কাজে আসবে না।)
তবু মক্কার বেশিরভাগ লোকজন কোরান বা তার নির্দেশকে মেনে নিতে পারল না। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ চলতেই থকল। তারা বলতে থাকল, রসুলগণকে যা দেয়া হয়েছে তা আমাদের না দিলে আমরা কখনই কুরআনকে মানব না। কেউবা বলল, ‘আপনি আমাদের সম্মুখে আকাশে আরোহণ করুন এবং সেখান হতে একটি সম্পূর্ণ লিখিত কিতাব এনে আমাদেরকে দিন, যা আমরা পাঠ করব’(বনী ইসরাইল, আয়াত-৯৩)। তাই নাযিল হল:
৪৯. তাদের কী হয়েছে যে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় উপদেশ হতে?(তাদের কি এমন হয়েছে যে তারা কোরআন মানতে পারছে না?)
৫০. তারা যেন ভীত, ত্রস্ত, গর্দভ-(তাদেরকে ভীত সেই গর্দভের মতো মনে হচ্ছে-)
৫১. যারা সিংহের সম্মুখ হতে পলায়নপর। (যে গর্দভ সিংহের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।)
৫২. বস্তুত তাদের প্রত্যেকেই কামনা করে যে, তাকে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ দেয়া হোক। (তাদের প্রত্যেকের ইচ্ছা আমি যেন তাদের প্রত্যেককে একটি করে আমার নিদর্শন দেই। তবেই নাকি তারা বিশ্বাস করবে।)
৫৩. না, এটা হবার নয়, বরং তারা তো আখিরাতের ভয় পোষণ করে না। (না, এটা কখনোই হবে না। তারা কোন অবস্থাতেই বিশ্বাস করবে না। কারণ তারা আখিরাতকে ভয় করে না।)
৫৪. না, এটা হবার নয়, কুরআনই সকলের জন্য উপদেশ বাণী। (তাদের এ দাবী কখনো পূরণ করা হবে না। কুরআনই সকলের জন্য উপদেশবাণী।)
৫৫. অতএব যার ইচ্ছা সে এটা হতে উপদেশ গ্রহণ করুক। (যার ইচ্ছা সে কোরআন মেনে চলুক।)
৫৬. আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কেউই উপদেশ গ্রহণ করবে না, একমাত্র তিনিই ভয়ের যোগ্যএবং তিনিই ক্ষমা করার অধিকারী। (আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কেউ কুরআনের উপদেশ মানবে না। একমাত্র আল্লাহকেই ভয় করা যায়। তিনিই ক্ষমা করার অধিকারী।)