জাপানিরা কাজপাগল জাতি। আর সময়ের কাজ সময়ের মধ্যেই করার জন্যেও এরা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। কিছুদিন আগেও নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৭ মাস আগেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দির দ্বিতীয় মেঘনা-গোমতী সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া নিয়ে একটা খবর ইন্টারনেটজুড়ে ভাইরাল হল। একটা ব্যাপার ভেবে আমার অবাক লাগে যে, এরা সময়ের কাজ সময়েই কিভাবে শেষ করে। এই ৩ বছরের জাপানে অবস্থানরত জীবনে আমি এ পর্যন্ত কাউকে তাড়াহুড়ো করে কখনও কোন কাজ করতে দেখিনি। আপনি বরং কারও কারও কাজের গতির মন্থরতা দেখে বিরক্তও হতে পারেন! এরপরও এদের কাজ সময়ের মধ্যেই শেষ হয়। এবং শুধু শেষ বললে ভুল হবে, খুব ইফেক্টিভ এন্ড এফিসিয়ান্টলি শেষ হয়। কারন ওরা যখন যা করে সমগ্রচিত্তে নিজেকে উজার করে দিয়ে সেটা করে। প্রচন্ড ভালবেসে কাজটা করে বলে তার আউটপুট কিংবা ফলাফলও হয় আশানুরূপ।
সকাল বেলা অফিস টাইমের সময় কনভেনিয়েন্স শপ গুলো প্রচন্ড ব্যাস্ত থাকে। মানুষ সকালের নাশতা, বা দুপুরের খাবার এসব দোকান থেকে কেনে। সকালে বাংলাদেশের একটা হোটেলের চিত্র কল্পনা করুন। সেখানে যেমন ভীড় থাকে এখানে অতটা না হলেও মোটামুটি ভালই ভিড় থাকে ক্রেতাদের। যার ফলে ক্রেতাদের লাইন হয়ে যায় প্রায় সময়ই। আমি এ পর্যন্ত এসব অপেক্ষার লাইনে কাউকে কোন দ্বন্দ করা এমনকি উচ্চস্বরে কথাও বলতে শুনিনি। একটা উদাহরণ দেই, একদিন দোকানে একটি লাইনে প্রায় ৮-১০ জন হয়ে গেছে। সবাই হাতে পন্য নিয়ে বিল পে করার জন্যে অপেক্ষা করছে। এর মাঝে এক ভদ্রলোক বিল পে করতে এসে দোকানের কাউন্টার এর লোককে বলল, একটু অপেক্ষা করুন। এই বলেই সে আবার দৌড়ে গিয়ে আরও দু তিনটা জিনিস খুজে নিয়ে আসল কেনার জন্যে। কিন্তু সে লাইন থেকে দূরে সরে গেলেও সেই সময়ে কেও লাইন ভঙ্গ করেনি। কিংবা যার জন্য আরও আট দশজন মানুষের দেরি হচ্ছে তাকে কেউ একটা টু শব্দটিও বলেনি। অথচ তখন ছিল রাশ আওয়ার। সবারই অফিসে ঠিক সময় না পৌছালেই নয়। কিন্তু তবুও তারা অপেক্ষা করেছে নিজের সিরিরাল কখন আসবে সে সময়ের জন্যে। এবং এর পরও এরা সময়মতই অফিসে পৌছায়। কারন এরা অপেক্ষাটাও মন থেকে করতে জানে।
আমি এই ঘটনাটা বাংলাদেশের হাট মাঠ ঘাট যেকোন জায়গাতেই হলে কি অবস্থা হত তা ভেবে কূল পাইনা। আপনি জানেন? এক সমীক্ষায় (কোন সমীক্ষা জানতে চেয়েন না আবার!) দেখা গেছে বাংলাদেশে লোকালয়ে যত ঝগড়া বিবেদ হয় তার ১৮ ভাগ হয় অপেক্ষারত লাইন থেকে।
-ভাই সোজা হয়ে দাড়াইতে পারলে লাইনে থাকেন নইলে পিছে যান।
-ক্যান আমি পিছে যামু কেন? আপনার বাপের জায়গা নাকি এইডা?
----+-------+----
-ধুরু মিয়া আপনে দূরে যান তো! আপনার শরীরে পাডার গন্ধ।
----+-------+----
হুম, এভাবেই হয়।
সময়ের কাজ সময়ে করতে হলে শুধু তাড়াহুড়া করলেই হয়না। মাঝে মাঝে থামতেও হয়। অপেক্ষা করাটাও একটা বড় গুন। বাঙালি সব কাজেই তাড়াহুড়ো করে আর ফার্স্ট হতে চায়, কিন্তু বাঙালির কয়টা কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়? কতজন মানুষ প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে আসেন (আসতে পারেন)? ছাত্র-ছাত্রিরা কি ঠিক সময়ে ক্লাশে উপস্থিত হতে পারছে? এই রোজায় কি সবাই ঠিক সময়ে নিজ বাড়িতে বসে ইফতার করতে পেরেছে? জরুরী রোগী বহনকারী কতগুলো গাড়ি অঘটন ঘটার আগেই হাসপাতালে পৌছাতে পারে? আপনি কি মানেন যে, সবগুলোই সময়ের কাজ সময়েই হত যদি সবাই অল্প একটু করে অপেক্ষা করত। সিগনালে লাল বাতি জললে আপনি যদি ৫ মিনিট অপেক্ষা করতে রাজি থাকেন, তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি আপনার ৫০ মিনিট বেচে যাবে এই ৫ মিনিট অপেক্ষার জন্যে।
আমাদের দেশে তো মেয়েদের কাছে বয়স আর স্টেশন মাস্টারের কাছে ট্রেনের সময় জানতে চাওয়া নিষেধ। কারন এতে প্রশ্নকারী ও যাকে প্রশ্ন করা হয় দুজনই লজ্জায় পরে যায়। নয়টার ট্রেন কয়টায় আসবে এই প্রশ্ন করতে করতে আমাদের বেড়ে উঠা। অথচ নয়টার ট্রেন তো নয়টাতেই আসা উচিত ছিল! কখনও আসেনি। তারপরও আমাদের বড্ড তাড়াহুড়ো। এইযে আর দুদিন পর ঈদ, সবাই ব্যাগ ভর্তী স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি পোঁছানোর তাগিদে ছুটছে। সারাটা বছর কত কষ্ট, কত গ্লানি, প্রিয়জন প্রিয়মুখগুলো ছেড়ে কত দুরে। বছরের এই একটা দিনের জন্যে সবাই কত অপেক্ষা করে। কিন্তু এত অপেক্ষার পরেও কি সবার স্বপ্ন বাড়ি পৌছাতে পারে? কারও কারও স্বপ্ন বাড়ির বদলে গাড়ির চাকার নিচে চলে যায়, কেউ ভেসে যায় ঘোলা পানিতে, কেউ পুড়ে যায় আগুনে। কি কষ্ট! কি বিভৎস! অথচ সবই খুব সুন্দরভাবে সম্পন্ন হতে পারে যদি সবাই সবার জন্যে নিজের মূল্যবান সময়ের একটুখানি ব্যয় করে। যেখানে অপেক্ষা করার সেখানে অপেক্ষা করে। শুধু শুধু তাড়াহুড়া না করে। কারন তাড়াহুড়া করে এখন পর্যন্ত কোন কিছুই ভালোভাবে হয়নি, আর ভবিষ্যতেও হবেনা।
সবার ঈদের ভ্রমনগুলো হোক নিরাপদ এই কামনা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০১৯ সকাল ৯:৪৫