১.
আজ আমি বাবা হয়েছি। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন। আমার এখন খুশিতে আনন্দে সপ্তম আকাশে থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমার মনে কোন আনন্দ কাজ করছেনা। আমার নিজের বাবা একটু আগে ফোন করেছিলেন খুশির খবরটা জানতে। হসপিটালের ওয়েটিং চেয়ারে বসে একমনে মোবাইল স্ক্রিনের উপর তাকিয়ে ছিলাম শুধু। কখন যে একবার কলটি কেটে দ্বিতীয় বারের মত বাজা শুরু করল খেয়ালই করিনি। এবারও রিসিভ করিনি। আমার এখন কারও সাথেই কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছেনা। আমি শুধু নিধির কথাটি ভাবছি। বাবা হয়ে আমি যেমন চুপ হয়ে আছি সে কি পারবে মা হয়ে আমার মত চুপ থাকতে? নাকি নিজেকে সামলাতে পারবেনা? নিধির এখনও জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তার বলল আরও ঘন্টাখানেক লাগবে জ্ঞান ফিরতে। মা কে নিধির কাছে রেখে এসে আমি এখন আমার সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের কথা ভাবছি।
.
২.
অবশেষে নিধির কথাই ঠিক হল। প্রথম দেখতে অনেকটা আমার মতই হয়েছে। চেহারার মিল আমি অতটা বুঝতে পারিনা। নিধি হলে হয়ত বলত,
-এইযে দেখেছ, চোখ টা হুবহু মিলে গেছে। আর তোমার মত প্রথমের কানের লতির নিচটাও ভারি। কপালটা তো মনেহচ্ছে তোমার থেকে একটু বড়ই হবে। আমরা আল্ট্রাসোগ্রামের মাধ্যমে জেনেছিলাম যে আমাদের অনাগত সন্তানটি একটি ছেলে। আমার একটি মেয়ের বড় শখ ছিল, আর নিধির ছেলের। ছেলে হলে প্রথম আর মেয়ে হলে প্রথমা এমনটাই নাম আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ওটাও নিধির কল্যানেই। আমি বলেছিলাম,
-প্রথমা নাহয় মানা যায়, কিন্তু ‘প্রথম’ নামটা কেমন হয়ে যায়না? কারও নাম প্রথম হতে পারে এটাই এই প্রথম শুনছি।
-আচ্ছা, প্রথমা মানা গেলে তোমার প্রথম মানতে সমস্যাটা কোথায় বলত শুনি? প্রথম শব্দটা না থাকলে তো প্রথমাই হতে পারতনা!
-না, সে ঠিক আছে কিন্তু, কেমন শুনাবে...।
-কেমন শুনায় তা দেখে আমার কাজ নেই। আমি আমার ছেলের নাম প্রথম ই রাখব। আর এমন করে ওকে গড়ে তুলব যেন সব কিছুতে সবসময় প্রথম হয়।
.
৩.
আমাদের প্রথম সন্তান প্রথম পৃথিবীতে এসেছে। তবে চারদিক আলো করে আসতে পারেনি। সৃষ্টিদেবতা প্রথমের আলোটুকু পৃথিবীর জন্যে যথার্থ মনে করেননি। নিধির গর্ভ থেকে প্রথম নিজে চুপ থেকে বেরিয়ে উল্টো আমাদের সবাইকে কাঁদিয়েছে। নিধি একটি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছে। হ্যা, আজ নিধিও প্রথমবারের মত মা হওয়ায় স্বাদ পেয়েছে। তবে সেই স্বাদ খুব কষ্টের। কোন মা ই এমন মাতৃত্ব চাইবেনা। আমার কথা আমি ভাবছিনা । কিন্তু নিধিকে কেমন করে সামলাব ভাবছি। জ্ঞান ফেরার পরই তো সে প্রথম কে দেখতে চাইবে। কোলে নিয়ে পরম মমতায় আদর করে দিতে চাইবে। কি করে বুঝাব। আল্ট্রাসোগ্রাম করার পর রিপোর্টে কালো রঙের পেপারে যে ছবি থাকে সেই ছবিটা নিধি আমাদের ঘরের দেয়ালে টানিয়ে রেখেছে সেই পরীক্ষার দিন থেকেই। আমি জেজ্ঞেস করেছিলাম,
-এটার মানে কি? এটা টানাচ্ছো কেন?
-কেন আবার, আমাদের সন্তানের ছবি টানাব না!
-তুমি আবার ওর ছবি দেখলে কোথায়। এটাতো জাস্ট বাচ্চার পজিশন এর একটা ছবি। তাও কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা।
-ধুর, তুমি বুঝবেনা কিছু। এইযে সাদা সাদা ছোপ ছোপ দাগ দেখতে পাচ্ছ না? এটাই আমাদের সন্তান। একদম তোমার মতই দেখতে হবে দেখে নিও আমি বলে দিচ্ছি। একটা মায়ের চোখে মুখে কতটা মায়া মমতা থাকতে পারে সেদিন নিধিকে কথাগুলো বলার সময় না দেখতে পেলে আমি কখনই জানতে পেতাম না।
.
৪.
হঠাৎই কার যেন কন্ঠ শুনতে পেলাম মনেহল।
-এক্সকিউজ মি স্যার, আপনি কি ৩০৪ এর পেশেন্টের লোক না?
-জি হ্যা, কি হয়েছে?
-আপনার পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আপনি তারাতারি আসুন। নার্সের কথায় আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। কিন্তু আমার পা চলছে না। নার্স আমাকে তারাতারি যেতে বলে সে নিজেই তারাতারি চলে গেছে। কিন্তু আমি কেন যেতে পারছিনা? নিধির জ্ঞান ফিরেছে। তারমানে সে কি সব সত্যি জেনে গেছে এতক্ষনে? সে কি তবে চিৎকার করে কান্না করছে? সব ভেঙ্গে চুরে ফেলছে? আমি স্তব্ধ আর ভিতু পায়ে কেবিনের সামনে আসলাম। বাইরে থেকে কোন শব্দ শুনা যাচ্ছেনা। সব খুব শান্তই আছে। তবেকি নিধি সত্যি শুনার পর আবার জ্ঞান হারাল! আমি রুমে প্রবেশ করলাম। নাহ, ওর জ্ঞান আছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। সারারাত শীতে চুপসে যাওয়া গোলাপের মত দেখাচ্ছে ওর মুখটি। আমি নিধির পাশে এসে দাড়ালাম। নিধি আমার হাতটি ধরে বলল, বসো। আমার মুখে কোন কথা নেই। আমি শুধু ভাবছি কি দিয়ে শুরু করব। আমি মাথা নিচু করে আছি। আশ্চর্য, আমার মনের চোখে তখন দেয়ালে টানানো সেই আল্ট্রাসোগ্রাম রিপোর্টের কালো ছবিটাই ভাসছে! আর ঐ সাদা ছোপ ছোপ দাগ গুলো ওখান থেকে কেমন অদৃশ্য হয়ে গেছে । তার বদলে সেখানে আমি প্রথমের মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!
.
৫.
আমি বুঝতেও পারিনি কখন আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। নিধির হাতে পানির ফোটা পড়তেই সে আমার মুখ উচিয়ে ধরে হাত দিয়ে চোখ মুছে দিল। অবাক হয়ে দেখলাম যে, নিধির চোখ মুখ সব শুকনো! তবে কি সত্যিটা সে এখনও জানেনা?
-আমি সব জানি।
নিধি বলল। আমি দ্বিতীয় বারের মত অবাক হয়ে নিধির দিকে তাকালাম।
-হুম, ডাক্তারই আমাকে সব বলেছে। প্রথম কখনও আমায় মা বলে ডাকতে পারবেনা। তুমিও বাবা ডাক শুনা থেকে বঞ্চিত হলে। আমার খুব খারাপ লাগছে জানো? কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিনা। মনেহচ্ছে, প্রথম তার প্রথম কান্না কাঁদতে পারেনি তাহলে আমি কেন কাঁদব? তুমিও কেঁদোনা প্লিজ। আমাদের প্রথম তবে রাগ করবে। প্লিজ কেঁদোনা।
নিধির এত মনোবল ভরা কথা দেখে আমার ভিতরটা কেমন কিছুটা গুছিয়ে গেল। অবশিষ্ট পানিটুকু মুছে নিধিকে বুকে টেনে নিলাম। সে চুপ করে মিশে গেল আমার বুকে। একটু টু শব্দও করলনা। শুধু খানিক পরে বুকের চারপাশটা ভিজে অনুভব হল।
.
৬.
কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে। নিধির সুস্থ হতে মাসখানেক লেগেছিল। এর মাঝে সে খুব একটা কথা বলেনি কারও সাথে। আমিও আগের মত অত জালাইনি ওকে। দেয়ালে টানানো সেই আল্ট্রাসোগ্রামের ছবিটা নিধি নিজেই নামিয়ে ফেলেছে। আমি একবার মানা করেছিলাম। বলেছিলাম, থাকুক না।
-নাহ, এই ছবি চোখের সামনে থাকলে আমার থেকে বেশি তুমি কষ্ট পাবে। তারচে এটা সরিয়েই রাখি।
কষ্টটা আমার বেশি ছিলনা। আমি নিধির দিকে তাকাতে পারছিলাম না। তবুও চাইছিলাম সে যেন একটু স্বাভাবিক হয়। আনন্দ না হোক অন্তত কিছুটা হলেও কষ্টের বোঝাটা যেন কমে। একদিন ওকে বললাম,
-আচ্ছা, আমাদের আবার যদি ছেলে সন্তান হয় তার নাম ‘প্রথম’ রাখলে কেমন হয়?
-না, তা হয়না। প্রথম কখনও দ্বিতীয় বার জম্ন নিতে পারেনা। এটা বলেই নিধি চুপ করে রইল। আর আমিও কিছু বলতে পারলাম না। নিধিকে এত নিশ্চুপ দেখে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না কখনও। আমার কিছুই ভাল লাগছিল না। প্রথম যেন না এসেই চলে গেছে। সেই সাথে নিয়ে গেছে নিধির আনন্দটুকু। আমি আবার নিধির কাছে গেলাম।
-নিধি, চল কোথা থেকে বেরিয়ে আসি। তোমারও ভাল লাগবে হয়ত।
-কোথায় যাবে?
-আরে, যাবার জায়গার কি অভাব আছে নাকি। দিনাজপুরে আমার এক বাল্যবন্ধু থাকে। ওখানে ওর একটা খামারবাড়ি আছে। অনেকদিন থেকেই যাবার জন্যে বলছিল। আমিই যাচ্ছিলাম না। তুমি চাইলে ওখানে যাওয়া যায়। যাবে?
-ঠিক আছে, তুমি যা ভাল মনেকর। তবে বেশিদিন কিন্তু থাকা যাবেনা।
-আচ্ছা, আগে যাই তো। পরে দেখা যাবে।
.
৭.
পরদিনই আমরা দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম। একদম অজপাড়াগায়ের ভিতর বিশাল এক খামারবাড়ি। চারদিকে সবুজের বাইরে অন্য কোন রং মিলা ভার। বিশাল এক পুকুরও আছে সেখানে। পুকুরপাড় টা বেশ সুন্দর। নানা রকম গাছে ভরা। সন্ধার পর আমি আর নিধি সেখানে গিয়ে বসলাম। পুকুরের পানি তখন আয়না হয়ে গেছে। আকাশের চাঁদকে আমরা নিচে তাকিয়েও দেখতে পাচ্ছি। আশপাশে প্রচুর জোনাকি পোকা উড়ছে। আমি নিধিকে ডাক দিলাম।
-নিধি
-হুম?
-জোনাক গুলো কেমন লাগছে?
-খুব সুন্দর।
-আচ্ছা, এখন এখান থেকে একটা জোনাক পোকা যদি মারা যায় তোমার খারাপ লাগবে নিধি?
-হ্যা তাতো লাগবেই। কিন্তু এটা জিজ্ঞেস করছ কেন হঠাৎ?
-না এমনি। আচ্ছা নিধি, ধর যে জোনাক টা মারা গেল তার কথা ভেবে তো খারাপ লাগবেই। কিন্তু সে যখন আলো জালিয়ে নিভিয়ে উড়ে যাচ্ছিল সেই দৃশ্যটা ভাবলে কি সেই খারাপ লাগাটা থাকবে তোমার মনে?
-নাহ, তখন তো শুধু সেই আলোর সৌন্দর্যটাই মনে ভাসবে। খারাপ লাগবেনা।
-তাহলে কেন তুমি সারাক্ষন কষ্টে থাক নিধি? প্রথম তোমাকে কখনও মা ডাকতে পারেনি এর কষ্ট আমি হয়ত কমাতে পারবনা। কিন্তু প্রথমের আগমনের আগেই আমরা যে ওকে কতটা লালন পালন করেছিলাম তা কি তুমি ভুলে গেছ নিধি? সেই সুখের দিনগুলোর কথা ভেবে একটুও কি তুমি হাসতে পারনা? আমি আর এমন তোমাকে মেনে নিতে পারছিনা । প্লিজ তুমি আগের নিধি হয়ে যাও।
.
৮.
-এই নাও।
-এটা কিসের কাগজ?
-খুলেই দেখ।
দেয়ালে টানানো আল্ট্রাসোগ্রামের সেই রিপোর্টের কাগিজটি হাতে নিয়ে নিধি আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম,
-নিধি, আমাদের সংসারে আর কেউ আসুক না আসুক, প্রথম সারাজীবনই আমাদের সাথেই থাকবে । আর আমি কখনও চাইবনা আমার প্রথমের মা, আমার লক্ষি বউটা মনমরা হয়ে সারাটা জীবন কাটাক। আমি এই ছবিটা আবার দেয়ালে টানাতে চাই। আমাদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সব সন্তানদেরই এই ছবি দেখাতে চাই। তুমি অনুমতি দাও যদি।
-আমি আর কি বলব, তোমার খারাপ লাগার কথা ভেবেই তো আমি ওটা নামিয়ে রেখেছিলাম। টানাতে চাইলে টানাবে।
-সত্যি বলছ? তোমার খারাপ লাগবেনাতো?
-নাহ, আমার কিছু হবেনা। তুমি টানিও।
-আচ্ছা ঠিক আছে চল তবে।
-চল মানে কোথায় যাব? এখানে তো ভালই লাগছে।
-না না, চল। অনেক কাজ পরে আছে। পরের বাচ্চার জন্যে নাম ঠিক করতে হবে। ওর আসার জন্যে টিকিট কাটতে হবেনা? চলতো!
-হুম, এই ছিল তোমার দুষ্টুমনে। এখানে এসব করতে এসেছ?
-কিসব করতে এসেছি বুঝিনা। আমি এখন আমার বউ এর সাথে মিটিং করে আমাদের পরের সন্তানের নাম ঠিক করব। আহা আস তো, আজ ভরা পূর্নিমা। মাঝ রাতে আবার এসে চাঁদকে আমরা বিদায় জানিয়ে যাব।
তবে সে রাতে আর চাঁদ দেখা হয়নি আমাদের। বহুদিন পর দুজন দুজনকে কাছে পেয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম দুজনেই। মনে হয়েছিল অন্য কোন আলো খুজে পেয়েছি আমরা। যে আলোর কাছে চাঁদের আলো তুচ্ছ মনেহয়। যে আলোয় কখনও আমাবস্যা আসেনা। সারাজীবন আলোর জোৎস্নায় জীবন ভরিয়ে রাখে সেই আলো। নিধি আমার বুকে মাথা রেখে সারারাত ঘুমিয়ে ছিল। আর সুখের তাপে আমার বুকটাও শুকনাই ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৪৬