somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ nnএক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

একটি জাতির কান্না......

২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি জাতির কান্না......

স্বাধীন সিকিম রাষ্ট্রের ভারত ভুক্তির নেপথ্য!
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ওই সময় উপমহাদেশে ৫৬৫ টি "Princely States" বা "সতন্ত্র দেশিয় রাজ্য" ছিল। তার মধ্যে বৃহৎ রাজ্যগুলি ছিল 'হায়দ্রাবাদ, 'মহীশুর', 'জম্মু ও কাশ্মীর' এবং 'বরদা'।
পরবর্তীতে সম্প্রসারণবাদী ভারত ছলে-বলে-কূটকৌশলে এই সকল রাজ্যগুলিকে ভারতভুক্ত করে। সর্বশেষ ভারত ১৯৭৫ সালে স্বাধীন হিমালয়েন রাষ্ট্র সিকিমকে গ্রাস করে। এই সবগুলি ক্ষেত্রেই তারা ওই সকল রাজ্য বা রাষ্ট্রের কিছু সংখ্যালঘু মানুষ রুপি ঘৃণ্য লোভী বারাহ-জাতক, সারমেয়-সাবকদের সুকৌশলে ব্যবহার করেছিল। আর ব্যবহার করেছিল তাদের চাণক্য কূটকৌশল। অধুনা তাদের তথাকথিত বৃহত্তর ভারত বা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা কল্পে তাদের সুকৌশলে প্রণীত দীর্ঘ নীলনকশায় যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছিল বা আছে এটা তাদের ক্রমাগত কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ বিষয়ে পাকিস্তান যথেষ্ঠ সতর্ক ও সচেতন হলেও আমরা মোটেও সতর্ক নই। আমাদের দেশের কিছু তথাকথিত আতেলরা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। আবার আমরা জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ নই। এটা আমাদের বড় জাতীয় দূর্বলতা। আমরা আমাদের পারিবারিক ও দলিয় স্বার্থে আমারা আমাদের দেশকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে রেখেছি।

যাইহোক, সিকিমের ভারতভূক্তির নেপথ্য কাহিনী নিয়ে নেপালের বিশিষ্ট সাংবাদিক সুধীর শর্মা সহ বেশ কিছু সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক বেশ কিছু বই ও নিবন্ধ লিখেছেন। সাংবাদিক ও লেখক সুধীর শর্মা ২০০৭ সালে তাঁর গবেষণা লব্ধ নিবন্ধ The Pain of a Losing Nation প্রকাশ করেন। সেই নিবন্ধটি অবলম্বনে আমার এই লেখাটি উপস্থান করলাম।

স্বাধীনতা হারানো জাতির বেদনা।
(The Pain of a Losing Nation) ----------------------------------

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর কোণে, কালিম্পং নামে একটি হিল স্টেশন আছে, যেখানে একসময় সারা বিশ্বের পর্যটকগণ আসতেন। এই পার্বত্য শহরে বেশিরভাগ বসতি স্থাপনকারীগণ ছিল নেপালি বংশোদ্ভূত। কিন্তু পরবর্তীতে শহরটি তার অতীত আকর্ষণ হারায়। কিন্তু স্বাধীনতা হারানো একটি দেশের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি এখানে বসবাস করতেন এবং ২৮ জুলাই ২০০৭ সালে ১০৩ বছর বয়সে অবহেলিত অবস্থায় এখানেই অসম্মানজনকমৃত্যু বরণ করেন। তিনি সিকিমকে ভারতে সাথে একীভূত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মিষ্টার দর্জিকে সমসাময়িক ইতিহাসে একজন 'বিশ্বাসঘাতক' সরকার প্রধান নিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই অসম্মান নিয়ে বেঁচে ছিলেন এবং অসম্মানিত হিসেবে স্বাধীন "হিমালয়ান কিংডম অফ সিকিমের"(Himalayan Kingdom of Sikkim) শেষ প্রধানমন্ত্রী, লেন্ডুপ দর্জি তার দেশ তথা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য তার জন্মস্থান থেকে বহুদুরে নীরবে নিভৃতে অত্যন্ত অসম্মানজনক মৃত্যু বরণ করে।

তার ভাষ্য ছিল, “সবাই আমার বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ করে। এমনকি যদি এটা সত্য হয়, তাহলে কি শুধু আমাকে একাই দোষ দেওয়া উচিত?"
তিনি সাংবাদিক সুধীর শর্মাকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন, ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে কালিম্পংয়ে তার সাথে যখন সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু নিজের মাতৃভূমির প্রতি 'বিশ্বাসঘাতকতার' অভিযোগ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে লেন্দুপ দর্জি আর সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি। কয়েক দশক ধরে কালিম্পংয়ের ‘চাকুং হাউসে’ (‘Chakung House’) নির্জন জীবন কাটিয়েছেন। তার মৃত্যু কালে খুব কম লোকই তাকে স্মরণ করেছিল বা সমবেদনা জানিয়েছিল।
এমনকি লেন্দুপ দর্জিকে দিল্লিও উপেক্ষা করেছিল।

তিনি সাংবাদিককে বলেছিলেন, "আমি ভারতে সিকিমের একীকরণ নিশ্চিত করতে আমার পথের বাইরে ( out if the way) গিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পরে, ভারতীয়রা আমাকে উপেক্ষা করেছিল।"
লেন্দুপ দর্জি প্রায় ১১ বছর আগে "জন আস্থা" নামক একটি সাপ্তাহিকে একটি সাক্ষাৎকারে সময় জনাব শর্মাকে বলেছিলেন, “আগে, আমাকে ‘রেড কার্পেট’ স্বাগত জানানো হত। এখন আমাকে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়, একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর নেতার সাথে সাক্ষাৎ করতে।"

২০০০ সালে যখন সাংবাদিক শর্মা দ্বিতীয়বার কালিম্পং যান, তখন দিল্লির প্রতি লেন্ডুপের ক্ষোভ এমন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে তিনি বলেন, এক সময়ে, জওহরলাল নেহেরু এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সহ ভারতীয় নেতারা তাকে উষ্ণভাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এমনই রাজনৈতিক অপাংতেয় অভিনেতা হয়ে ওঠেন যে তার উপযোগিতা শেষ হয়ে যাওয়াতে তাকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়।

সংকটের উৎপত্তি
–-------------------
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, নেহরুর কূটকৌশল অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত সিকিম রাজ্য কংগ্রেস (SNC) রাজা বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। সিকিম তখন সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, ছোট্ট হিমালয় রাজ্যটিকে এমন একটি সংকটে নিপতিত করা হয়, যেখান থেকে তারা আর কখনও মুক্ত হতে পারেনি। ১৯৭৩ সালে লেন্ডুপ দর্জির নেতৃত্বে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (এসএনসি) মাধ্যমে শুরু হওয়া রাজা-বিরোধী আন্দোলন একটি সার্বভৌম জাতিকে সফল ভাবে মৃত্যুর পথে পরিচালিত করা হয়।
ভারত প্রকাশ্যে রাজা চোগিয়াল পাল্ডেন থন্ডুপ নামগ্যালের ( Chogyal Palden Thondup Namgyal.) বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। রাজার তৎকালীন এডিসি ( ADC) ক্যাপ্টেন সোনম ইয়ংদা (Sonam Yongda) দাবি করেছিলেন যে সিভিল পোশাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যরা বিক্ষোভে অংশ নিত। দার্জিলিং এবং আশেপাশের এলাকা থেকে কিছু ভাঁড়াটে লোক আনা হয়েছিল রাজা বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিতে। এই বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সিকিমিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।
লেন্ডুপের এই দেশ বিরোধী আন্দোলন মূলত ভারতীয় আর্থিক সহায়তার উপর নির্ভর করে। ভারতের তদানিন্তন গোয়েন্দা সংস্থা, "গোয়েন্দা ব্যুরোর" ( IB) মাধ্যমে অর্থ পাওয়া যেত। এই প্রসঙ্গে লেন্দুপ দর্জি বলেন, “আইবি-র লোকজন বছরে দু-তিনবার আমার কাছে আসতেন। একজন আইবি এজেন্ট, তেজপাল সেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে টাকা হস্তান্তর করতেন”, দর্জি আমাকে একটি রেকর্ড করা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, 'মিশন সিকিম'-এর পিছনে প্রধান অভিনেতা ছিল ভারতের বহিরাগত গোয়েন্দা সংস্থা, RAW (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং)। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত, RAW তিন বছরের মধ্যে পাকিস্তানকে (এবং বাংলাদেশ গঠন) ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সিকিমের অধিভুক্তি ছিল তাদের আরেকটি 'ঐতিহাসিক' সাফল্য। RAW-এর কৌশলীরা সিকিমে ভুটানের পুনরাবৃত্তি করতে চাননি। ভুটান ১৯৬৮ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন করতে সক্ষম হয়। তাই, তারা লেন্ডুপ দর্জির নেতৃত্বে একটি আন্দোলন শুরু করে, যা বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক অশোক রায়না তার বই ইনসাইড "RAW: দ্য স্টোরি অফ ইন্ডিয়া’স সিক্রেট সার্ভিসে" ব্যাপকভাবে বর্ণনা করেছেন।
রায়না লিখেছেন যে নয়াদিল্লি ১৯৭১ সালে সিকিমকে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং RAW পরবর্তী দুই বছর সিকিমের অভ্যন্তরে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে ব্যবহার করেছিল যতে এই ছুতায় তারা সিকিমকে গ্রাস করতে পারে। RAW সংখ্যালঘু নেপালি বংশোদ্ভূত প্রধানত-হিন্দু সিকিমিজদের এই দুরভিসন্ধিতে ব্যবহার করে। যারা বৌদ্ধ রাজা এবং অভিজাতদের কাছ থেকে বৈষম্যের অভিযোগ করতে উদ্ভুদ্ধ করে। তাদের ভাষ্য ছিল, "তখন আমরা অনুভব করেছি যে চোগিয়াল আমাদের প্রতি অন্যায় করছিলেন"।

এমন একজন ব্যাক্তি, গ্যাংটক টাইমসের সম্পাদক এবং প্রাক্তন মন্ত্রী সিডি রাই বলেন "আমরা ভেবেছিলাম রাজার দ্বারা নিপীড়িত হওয়ার চেয়ে ভারতীয় হওয়া ভাল।" লেন্ডুপ দর্জি যিনি কাজী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত - সিকিমের শাসক চোগিয়ালদের সাথে ঐতিহাসিক শত্রুতা ছিল। তিনি বলেছিলেন যে তিনি জনবিক্ষোভের মাধ্যমে রাজাকে চাপ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করে বলেন," অথচ রাজা কখনই সমঝোতার জন্য এগিয়ে আসেননি।" (এখানেও ভারত কূটকৌশলের মাধ্যমে রাজাকে লেন্দুপের সাতগে কোন প্রকার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা থেকে বিরত রাখে।) কিন্তু দিল্লির চাপে সিকিম রাজা SNC এবং ভারতের সাথে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা করতে বাধ্য হন। আলোচনা শুধু রাজকীয় ক্ষমতাই হ্রাস করেনি, এটি সিকিমকে একটি ভারতীয় 'রক্ষক'-এ পরিণত করে। ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, লেন্দুপের SNC সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ( এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ক্ষেত্রে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করে মর্মে জানা যায়।) সরকার এবং রাজা একে অপরকে শত্রু হিসাবে দেখত। শেষ পর্যন্ত, ২৭ শে মার্চ ১৯৭৫ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত হয়। সিকিমের পার্লামেন্ট এটিকে সমর্থন করে এবং রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গণভোট করার সিদ্ধান্ত নেয়। চারদিন পর সারাদেশে ৫৭টি কেন্দ্রে ভোটের ফলাফলের মাধ্যমে ‘রাজতন্ত্রের অবসান’ হয়।
এক সাক্ষাৎকারে সিকিমের তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী "কেসি প্রধান" স্মরণ করেছিলেন যে গণভোট একটি ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই ছিল না । তিনি বলেন "ভারতীয় সৈন্যরা অসহায় ভোটারদের দিকে রাইফেল তাক করে ভোটে কারচুপি করে।" গণভোটের পরপরই, কাজী লেন্ডুপ সিকিমকে ভারতের সাথে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ৩২ সদস্যের সংসদ, যেখানে লেন্ডুপের এসএনসি থেকে ৩১ জন সদস্য ছিল। ফলে এক পলকেই প্রস্তাবটি পাস করে। বলাই বাহুল্য যে সমগ্র পর্বটি ভারত কর্তৃক সাজানো হয়েছিল। সিকিমে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ('রাজনৈতিক কর্মকর্তা' নামে পরিচিত) বিএস দাস তার বই "দ্য সিকিম সাগাতে" লিখেছেন, "ভারতীয় জাতীয় স্বার্থে সিকিমের একীভূতকরণ প্রয়োজনীয় ছিল। এবং আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করেছি। হয়তো চোগিয়াল যদি আরও বুদ্ধিমান হতেন, এবং তার তাস আরও ভাল খেলতেন, তাহলে এটি এমনভাবে পরিণত হত না।"

কিন্তু চোগিয়াল তার তাস ভালো খেলতে পারেননি। সিকিম যখন অশান্তির মধ্যে ছিল, তখন চোগিয়াল ১৯৭৪ সালে রাজা বীরেন্দ্রের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কাঠমান্ডু যান। অভ্যন্তরীণ সূত্রের মতে, রাজা বীরেন্দ্র, চীনা উপ-প্রধানমন্ত্রী চেন লি ইয়ান এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, চোগিয়ালকে সিকিমে ফিরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। "তারা সিকিমকে ভারতের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একটি 'মাস্টার প্ল্যান' বর্ণনা করেছিল কিন্তু রাজা গ্রহণ করেননি", ক্যাপ্টেন ইয়ংদা বলেছিলেন। "কারণ রাজা তার স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে ভারত সিকিমকে সংযুক্ত করতে শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।"
ভারতের দ্বৈত খেলা
–------------------
আসলে, ভারত একটি " দ্বৈত খেলা" খেলছিল। একদিকে, এটি রাজার বিরুদ্ধে সাধ্যমত লেন্ডুপকে সমর্থন করছিল। অন্যদিকে, এটি রাজাকে আশ্বস্ত করছিল যে সিকিমে রাজতন্ত্র টিকে থাকবে। রাজা চোগিয়ালকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অনারারি মেজর জেনারেল করা হয়েছিল। তিনি কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি যে তার ‘নিজস্ব বাহিনী’ তার বিরুদ্ধে কাজ করবে। এটা ছিল একটি বিভ্রম মাত্র।
১৯৭৫ সালের ৬ এপ্রিল সকালে সিকিমের চোগিয়াল তার প্রাসাদে ছিলেন, যখন গ্যাংটকের খাড়া রাস্তায় উঠে আসা ভারতীয় সেনা ট্রাকের গর্জন শুনে তিনি জানালার কাছে ছুটে আসে দেখেন। এবং দেখেন ভারতীয় সৈন্যরা তারা প্রাসাদটি ঘিরে ফেলেছে এবং মেশিনগানের গুলির শব্দ শোনা যায়। প্রাসাদের প্রধান ফটকের ১৯ বছর-বয়সী প্রহরী বসন্ত কুমার ছেত্রী গুলিবিদ্ধ হন এবং নিহত হন। এটি ভারতীয় দখলের প্রথম হতাহতের ঘটনা। ৫০০০ -শক্তিশালী ভারতীয় বাহিনী প্রাসাদ রক্ষীদের বশ করতে ৩০ মিনিটের বেশি সময়ও নেয়নি, যাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৪৩ । দুপুর ১২:৪৫ নাগাদ সব শেষ হয়ে যায়। সিকিম একটি স্বাধীন রাজ্য হিসাবে চিরতরে অস্তিত্ব হারায়।

দ্বিতীয় সুযোগটিও হারান চোগিয়াল। সিকিম গার্ডদের ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দুই ঘণ্টা আটকানোর ক্ষমতা ছিল। চোগিয়াল যদি তার প্রাসাদে স্থাপিত ট্রান্সমিটার থেকে ভারতীয় আক্রমণ সম্পর্কে বেইজিং এবং ইসলামাবাদকে অবহিত করতেন তবে উভয় দেশই তাকে আশ্বস্ত করেছিল - কাঠমান্ডু বৈঠকের সময় যে তারা তাদের নিরাপত্তা বাহিনীকে ভারতের সীমান্তে গুলি চালানোর নির্দেশ দেবে। এমনকি চোগিয়ালকে উদ্ধার করতে চীনের সেনাবাহিনী গ্যাংটকে যেতে পারে। কিন্তু তিনি তা করেননি। সম্ভবত খুনাখুনি এড়াতে, যাতে বিপুল সংখ্যক সিকিমিজ নিহত হত, এই ভেবে। বন্দী প্রাসাদ রক্ষীদের, হাত উঁচু করে, ট্রাকে ভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা গান গাইছিল: "দেলা সিল, লি গি, গ্যাং চাংকা চিবসো" (আমার দেশ ফুলের মতো ফুটতে থাকুক)। কিন্তু ততদিনে, ভারতীয় ত্রি-রঙা সেই প্রাসাদে সিকিমিজ পতাকা প্রতিস্থাপন করেছিল যেখানে নামগিয়াল রাজবংশের ১২ তম রাজাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। “চোগিয়াল ভারতে একজন মহান বিশ্বাসী বন্ধু ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। তিনি স্বপ্নেও কখনও ভাবতে পারেননি যে ভারত কখনো তার দেশ দখল করবে”, বিষয়টি চোগিয়ালের এডিসি ক্যাপ্টেন সোনম ইয়ংদা স্মরণ করেন। ১৯৬০ সালে নেহেরু নিজেই সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারকে বলেছিলেন: "সিকিমের মতো একটি ছোট দেশকে জোর করে দখল করা রাইফেল দিয়ে মাছি মারার মতো হবে।"

হাস্যকরভাবে এটি ছিল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী যিনি সিকিমকে ভারতীয় ইউনিয়নের রাজ্যে পরিণত করার জন্য 'জাতীয় স্বার্থ' উল্লেখ করেছিলেন।
একটি বৈঠকের সময়, সিকিমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বি.বি.গুরুং জনাব শর্মাকে বলেছিলেন যে রাজা এবং লেন্ডুপ দর্জি কেবল একটি প্রক্সি যুদ্ধে লড়াই করছেন। "আসল যুদ্ধটি ছিল একজন আমেরিকান এবং একজন বেলজিয়ান মহিলার মধ্যে।" যদি তা সত্য হয়, তবে প্রকৃত বিজয়ী ছিলেন তৃতীয় মহিলা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

পাশ্চাত্যের দুই বিদেশি মহিলার দ্বন্ধে
প্রাচ্যের এক মহিলার সুযোগ গ্রহন।

–---------------------------------
চোগিয়াল পালডেন ১৯৬৩ সালে দার্জিলিংয়ে ২৪ বছর বয়সী নিউ ইয়র্কার হোপ কুকের ( Hope Cooke) সাথে দেখা হয়। এবং পরবর্তীতে তাঁকে বিয়ে করেন। কুকের জন্য, এটি একটি স্বপ্ন সত্য হওয়ার মত ঘটনা ছিল। শাংরি-লা-তে একটি স্বাধীন রাজ্যের রানী হওয়া। রানী যখন সিকিমের স্বাধীন সত্তা রক্ষার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন, ঠিক তখন RAW সুকৌশলে সিকিমের তরুণদের কাছে রানীকে CIA এর এজেন্ট হিসেবে প্রচার করছিল। এই বছরগুলি ছিল শীতল যুদ্ধের সবচেয়ে ঠান্ডা বছর, এবং ভারতে সবকিছুর পিছনে একটি 'বিদেশী হাত' দেখার প্রবণতা ছিল তাই আমেরিকান রাণীকে সিআইএ এজেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করা কঠিন কিছু ছিল না। যাইহোক, দিল্লির সাথে হোপ কুকের সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় চোগিয়ালের সাথে তার দাম্পত্য জীবনে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে ১৯৭৩ সালে, তিনি তার দুই সন্তানকে নিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে যান। এরপর তিনি আর কখনও সিকিমে ফিরে আসেনি।
সিকিমের অপর গুরুত্বপূর্ণ মহিলা ছিলন এলিসা-মারিয়া (Elisa-Maria)। তিনি ছিলেন একজন বেলজিয়ান বাবা ও জার্মান মা এর সুন্দরী কন্যা। যিনি তার স্কটিশ স্বামী সহ বার্মায় বসবাস করতেন। তাঁর সাথে তাঁর স্বামীর বিচ্ছেদ হয়। অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্খী এই মহিলা ১৯৫৭ সালে দিল্লিতে কাজী লেন্ডুপ দরজিকে বিয়ে করেন। এলিসা-মারিয়া সিকিমের ফার্স্ট লেডি হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হোপ কুক বাধা দিয়েছিলেন। তিনি শুধু একজন ভারতীয় মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী হতে চাননি; তিনি স্বাধীন সিকিমের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য যে সিকিম এর ভারত-ভুক্তিতে এই দুই উচ্চাকাঙ্খী মহিলার আশা পুরন.....

এদিকে নয়াদিল্লিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দিন দিন তাঁর শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে থাকেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধ এবং ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। ফলে তিনি সিকিমকে ভারত-ভুক্ত করার কাজে হাত দেন। ইন্দিরা গান্ধী উদ্বিগ্ন ছিলেন যে সিকিম স্বাধীন প্রবণতা দেখাতে পারে এবং ১৯৭১ সালে ভুটানের মতো জাতিসংঘের সদস্য হতে পারে। তাঁর লোভনীয় দৃষ্টি পড়ে তিনটি হিমালয় রাজ্য, ভুটান, সিকিম ও নেপালের প্রতি। এই স্বাধীন রাজ্য গুলির সাথে ভারতের সহবস্থান সুখের ছিল না।
ভারতীয় সৈন্যরা যখন গ্যাংটকে ঢুকেছিল তখন গ্যাংটকের রাস্তায় যে সাধারণ মানুষের উল্লাস দেখা গিয়েছিল, তাও ছিল সম্ভবত ভারতীয়দের পাতানো খেলার অংশ।বেইজিং গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল কিন্তু ভারতীয় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জনগণের দৃশ্যতঃ প্রতিবাদের অনুপস্থিতিতে ও নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নীরব প্রতিক্রিয়া চীন কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তবে এটি নিয়ে খোদ ভারতে, সিকিম আক্রমণ নিয়ে বিপরীত মতামত ছিল। প্রাক্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ১৯৭৮ সালে বলেছিলেন যে একীকরণ একটি ভুল ছিল। এমনকি সিকিমের রাজনৈতিক নেতারা যারা একীকরণের জন্য লড়াই করেছিলেন তারা বলেছিলেন যে এটি একটি ভুল সীধান্ত ছিল এবং এটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু ততক্ষণে, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।

পরবর্তীতে কাজী লেন্দুপ দর্জি ভারতের সিকিম রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। ভারত সরকার ২০০২ সালে তাকে 'পদ্মভূষণ' প্রদান করে এবং ২০০৪ সালে রাজ্য সরকার তাকে 'সিকিম রত্ন' প্রদান করে।
এই ধরনের 'পুরস্কার' সত্ত্বেও, লেন্ডুপ এবং তার স্ত্রী এলিসা তাদের অতীতের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হন ও করে কালিম্পং-এ তাদের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছেন। ১৯৯০ সালে তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর, লেন্ডুপ একাকী জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। তার দেখাশোনা করার জন্য তার কোন সন্তান বা আত্মীয় ছিল না। তাদের ক্রোধ ও বিদ্বেষ এড়াতে তিনি নিজের লোকদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন।

১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, Lhendup's SNC সিকিমের বিধানসভায় একটি আসনও পায়নি। এটি কার্যকরভাবে তার রাজনৈতিক কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটায়। এক সময় তিনি মনোনয়ন জমা দিতে গেলে ভোটার তালিকায় তার নাম ছিল না। সিকিমের ৪০০ বছরের পুরানো ইতিহাসের চোগিয়াল রাজবংশকে সিংহাসনচ্যুত করার সংকল্পে, লেন্ডুপ তার মাতৃভূমিকে ভারতের কোলে পৌঁছে দিয়ে ছিলেন। বিনিময়ে, তিনি যা পেয়েছিলেন তা হল অতীতের ছায়া থেকে ভুতুড়ে জীবন এবং একটি অপমানজনক মৃত্যু। এভাবেই শুধুমাত্র নিজ স্বার্থে নিজ জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তার জাতিকে চিরতরে পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ করে।

ঘটনাটা অবতারণা করার কারণ, বাংলাদেশের লেন্ডুপ দর্জি শেখ হাসিনার আরও করুণ পরিনতি কি হয়- সেটা দেখা.....।

তথ্যসূত্রঃ নেপালের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক সুধীর শর্মা ২০০৭ সালের গবেষণা লব্ধ নিবন্ধ "The Pain of a Losing Nation" থেকে সংকলিত।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৪:১০
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রেসিডেন্ট, সেনাপ্রধান ও ড: ইউনুস কোমলমতিদের লোকজন নন।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৩



কোমলমতিরা কি আন্দোলন করেছিলো শেখ হাসিনার আত্মীয় সেনাপ্রধান ও শেখ হাসিনার নিযুক্ত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় রাখতে? এই রকম বন্ধুত্ব কি উহাদের মাঝে আছে? কোমলমতিরা কি ড: ইউনুসকে স্যার ডাকতো, নাকি... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন শক্তির উত্থান এখন বর্তমান সময়ের দাবী

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ২১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২



গত দুইমাস যাবত আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীতে যাদের দেখছি তাদের মাঝে ডঃ ইউনুস বাদে আসিফ নজরুল , নাহিদ ও আসিফ ছাড়া আর কাউকেই বিপ্লবী ভুমিকায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

হৃদয় সূচকে সরল রেখা...

লিখেছেন কথাকথিকেথিকথন, ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১২:০১

দেয়ালটা টপকে ওপাশে নি:সঙ্গতা
ছায়াহীন দেহ, নেই বিভ্রম
একাকী আলোয়, একাকী আঁধারে
একাকী দাঁড়িয়ে থাকি আমি।

হৃদয় সূচকে সরল রেখা
গন্তব্য শেষে বিস্তৃত বিশ্রামে
একাকী ঘুমিয়ে পড়ি আমি।


....কবরের কোন ছায়া নেই
একাকী জেগে থাকি আমি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি জাতির কান্না......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫২

একটি জাতির কান্না......

স্বাধীন সিকিম রাষ্ট্রের ভারত ভুক্তির নেপথ্য!
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ওই সময় উপমহাদেশে ৫৬৫ টি "Princely States" বা "সতন্ত্র দেশিয় রাজ্য" ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

এসব কিসের ইঙ্গিত?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২২ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১:২৯


ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার দাবিতে হঠাৎ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগ নেতাদের বিক্ষোভ মিছিল! সোমবার (২১ অক্টোবর) সকালে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×