দেখে এলাম 'হাওয়া' সিনেমা.....
দীর্ঘ বছর দেশীয় সিনেমা দেখা হয়না সিনেমা হলে গিয়ে। চলমান আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে বন্ধু দেবনাথের সাথে "হাওয়া" দেখা হলো হঠাৎ করেই। সমুদ্রযাত্রা বা সমুদ্রকেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি সিনেমা আমি দেখেছি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জগতবিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’, ‘লাইফ অফ পাই’, কোরিয়ান সিনেমা ‘সি ফগ’, বাংলা সিনেমা ‘গাঙচিল'। এছাড়াও নদী ভিত্তিক/জেলে জীবন নিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা ‘ধীরে বহে মেঘনা’, 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'তিতাস একটি নদীর নাম', ‘চিত্রা নদীর পারে’, 'বিদ্রোহী পদ্মা' ইত্যাদি। এবার আমাদের দেশে খুব আলোচিত সিনেমা 'হাওয়া' দেখলাম। আমি যখন হাওয়া দেখলাম- তখন এদেশের সিনেমা দর্শকদের কাছে- হাওয়ার স্মৃতি অনেকটাই হাওয়া হয়ে গিয়েছে বললে ভুল বলা হবেনা।
হাওয়া সিনেমার গল্পঃ মাঝ সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া আটজন জেলেকে নিয়ে। ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’র নায়ক সান্তিয়াগোর জালে যেমন ধরা পড়েছিল এক বিশাল মাছ, তেমনি 'হাওয়া' সিনেমার গল্পে হঠাৎ করে ‘নয়নতারা’ ধরা পড়ে ফিশিং বোটের চান মাঝির জালে। সিনেমার ইব্রাহিম (ইবা) প্রথমে দেখে এটি বড় এক মাছ, পরে বোঝা যায় এটা সুন্দর এক মেয়ে। বোটের সবার মাঝে এক চাঞ্চল্য ভর করে। এই চাঞ্চল্য আর আর প্রচুর মাছ পাওয়ার আশায় মাঝ দরিয়ায় দুই নৌকার জেলেদের মদ কিংবা গাজা সহযোগে ‘পিনিক’ ছড়িয়ে গান-‘তুমি বন্ধু কালা পাখি’ দর্শকদের নিয়ে যায় ভিন্ন আবহে....
গত কয়েক মাস যাবত হাওয়া সিনেমা নিয়ে এতো এতো আলোচনা, সমালোচনা পড়ে মাথায় অনেক পূর্ব ধারণা নিয়ে ঢুকেছি। এই যেমন হাওয়া সিনেমার রিভিউ লিখতে যেয়েও গত দুই মাস যাবত পত্রিকায় পড়েছি, লোকমুখে শুনেছি- 'মাইন্ড সেট' হয়ে যাওয়া সেগুলোই ঘুরে ফিরে লেখায় চলে আসছে। তবুও আমি চেষ্টা করছি- আমার দৃষ্টিভংগি তুলে ধরতে। প্রথমবারের বলবো যে গানটা নিয়ে হাওয়ার হাইপ, "তুমি বন্ধু কালা পাখি....."- অনেকে গানটার মধ্যে রুচিহীনতা খুঁজে পেলেও আমি অরুচিকর কিছু খুঁজে পাইনি, বরং যথাযথ বলেই মনে করি। তবে সিনেমার প্রথম ভাগ হচ্ছে ধীর গতির, সংলাপে বেশ কিছু অশ্লীল গালি আর হাস্যরস ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই।
'চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় প্রতিভার অবমূল্যায়ন করে অন্যকেউ তার জায়গায় আরো ভালো করতো বলে মন্তব্য করেছিল, আমার তা মনে হয়নি। নায়িকার 'মডেলের মতো হাঁটাচলা প্রাসঙ্গিক লাগেনি'- বলেছিল কেউ। এসব আমার মাথায় গেঁথে ছিলো। ছবি দেখতে গিয়ে ঘটে অন্যরকম। প্রথম দৃশ্যতেই আমি স্টাক হয়ে গেলাম মুভির সাথে! আক্ষরিক অর্থেই বললাম- অনেক মুগ্ধতা!
মেজবাউর রহমান সুমন- এই ছবির ডিরেক্টর, রাইটারও তিনি, তার সম্পর্কে আমার আগে কোনো ধারণাই ছিল না। অথচ এই মুভি পরিচালনায় সর্বত্রই মুন্সিয়ানা খুঁজে পেয়েছি। ছবির কস্টিউম, সেট, অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, কোনোকিছুতে ভুল ধরার কিছু পেলাম না। বরং যেখানে যা দরকার তেমনই, কমও না, বেশীও না, যথার্থ। অতি দরিদ্র জেলে জীবনের যুদ্ধ, বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার গল্প। তারা হয় বাঁচে নাহলে মরে- আর কিছু নেই মাঝে। কাজেই রুচি আর শিল্পের ধার ধারতে হয়না তাদের, রেখেঢেকে বলতে হয়না কিছু।
তবে এই ছবি জুড়ে আছে বিভ্রম! শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভ্রম থেকে গেছে। মাছ ধরা জালে আটকে পড়া নায়িকাকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে পুরো চলচ্চিত্র।
নয়নতারা'র আবির্ভাবের পর থেকেই আমার মতো দর্শক বুঝতে পারেনি- ওভাবে তার আগমনের হেতু কি? সে মৎস্য কন্যা, নাকি মনসার কোনো রূপ, সেটা স্পষ্ট না। মেয়ের (গুলতি) সংলাপে জানা যায়, মাছ থেকে মানুষ হয়ে আসার কেচ্ছা অনেক! এই মেয়ের জবানিতে আরও জানা যায়, সে মাছ থেকে মানুষ হয়ে এসে অনেক মানুষ দেখে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল! সবাই ধরে নিয়েছিল সে বোবা। চান মাঝি তাকে নিরালায় ডেকে নিতে চাইলে সে বাধা দেয়। চান মাঝি গুলতি নামের অসহায় এই মেয়েটার প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারে না। অন্যদিকে ইঞ্জিন রুমের মিস্ত্রি যে আলাদাভাবে মাছ বিক্রির প্রতিবাদ করে, চান মাঝি যাকে দেখতে পারে না, মেরে ফেলতে চায়, তাকে ভালো লেগে যায় মেয়েটার অর্থাৎ গুলতির। মাঝ সমুদ্রে ভাসতে থাকা, ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়া আর তেল ফুরিয়ে যাওয়ার দুঃসময়ে গুলতির প্রতি নজর থাকে সবার। তবু চিরাচরিতভাবে দোষ দেওয়া হয় নারীকে, 'নয়নতারা' নামের নারীই বোটের সব অমঙ্গলের কারণ। যে অঅশ্লীল নোংরা অকথ্যগালি তাকে বারবার দেওয়া হয়, সেটা উল্লেখ করার রুচি হয়না। সিনেমার গালি এতো নোংরা হতে পারে তা এই সিনেমা না দেখলে কল্পনাও করতে পারতাম না।
গুলতির চরিত্রটা হয়ত পরাবাস্তব, হয়ত রূপক কিংবা সেই আদিম বিশ্বাসের অথবা প্রচলিত বাংলা লোক সিনেমায় বহুবার দেখানো ধারণা- সাপ থেকে বা মাছ থেকে মানুষ হওয়া যায়! এই সিনমার গুলতি তেমনই। কিন্তু সে আসে চান মাঝিকে খুন করতে। গুলতির ভাষ্যমতে, চান মাঝি আগে ডাকাত ছিল, সে গুলতির বাবাকে হত্যা করেছে। নয়নতারা বোটের সবাই কি ডাকাত বা চানমাঝির সহযোগী ছিল? তাহলে একের পর এক আটজনকেই নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হল কেন? চান মাঝি যে দুজনকে খুন করে (ইবা ও নাগু) তার বাইরে তিনজনের খুনও অতিপ্রাকৃতিকভাবে দেখানো হয়েছে, যা স্পষ্ট না। চান মাঝিসহ আরও দুজনের খুন সাপের কামড়ে! গুলতি এখানে মনসার রূপক? নাকি প্রতিশোধ স্পৃহাটাই আসল? যা আমার বোধগম্য হয়নি।
এই সিনেমার চঞ্চল চৌধুরী ছাড়া আর কারোর নাম আমি জানিনা, চিনিও না। তবে নায়িকার নাম 'তুষি' বলে জেনেছি। চঞ্চলের অভিনয় নিয়ে বলার কিছু নেই। এমনকি অন্য কারো অভিনয় নিয়েও কিছু বলার নেই। নায়িকা তুশিকে যখন একজন রেইপ বা সেক্সুয়াল আক্রমণ করতে এলো, আর তুশি হাঁটু দিয়ে ঐ লোকের মিডলস্ট্যাম্পের দফারফা করে দিলো, লোকটা হাভাতের মতো বরফ হাতড়ে সেখানে বরফ লাগাতে উদ্যত হলো- এই ঘটনার উপস্থপনায় ভালগার কিছু ছিলো না। মানিয়ে গেছে ছবির সাথে।
তারপর সেই গান। এই গানটা ইচ্ছেয় এবং অনিচ্ছেয় বহুবার শোনা হয়েছে আগে। কিন্তু মুভিতে দেখে বোঝা গেল এর চেয়ে পারফেক্ট কিছু হয়না। সমুদ্রে ঝড়ে-জলে জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করা মানুষদের হঠাৎ ঐ বিনোদন একদম তাদের মতোই ছিলো, তাদের জন্যই ছিলো, খুব জরুরীও ছিলো। ঐ পরিবেশে গানটা অসাধারণ লাগছিল যা মুভি ছাড়া দেখলে বা শুনলে কিছুই বোঝা যায় না।
এখন আসি নায়িকার কথায়। একদল জংলা বিধ্বস্ত বিরক্ত ক্ষুধার্ত আদিম ধরণের মানুষের মাঝে সে একপশলা শান্তির বারিষের মতো। তাকে দেখতে ভালো লাগছিলো। তার গেটআপ, ফিগার, মুভমেন্ট ভালো লাগছিলো। যদিও পত্রিকায় এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল যে, নায়িকার উপস্থাপন পরিবেশের সাথে খাপ খায়নি। আমি ভিন্ন দৃষ্টিতে বলবো- আমার মনে হয় ছবি দেখতে বসলে একটু গ্ল্যামার লাগেই! মুভির ভালো দিক হলো, নায়িকা তুশি যখন মডেলের মতো হেঁটে যায়, আর আমরা পেছন থেকে ক্যামেরার দৃশ্যে তা দেখি, সেই দেখা কিন্তু নৌকায় উপস্থিত একজন পুরুষ চরিত্র মেয়েটার গমণ পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখ দিয়ে পুরুষের চোখে রমনীকে দেখি। তখন মেয়েটাকে মডেল মনে হতেই পারে।
নায়িকার বিপরীতে যে অভিনেতা থাকেন, তাকে আমরা সবসময় জিতে যেতে দেখি, সে একাই একশো, তামাম দুনিয়াকে সে হারিয়ে দিতে পারে। এই ছবিতে তেমন অবাস্তব কিছু নেই। নায়িকাকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন দেয় ছেলেটা। খুবই হৃদয়বিদারক ব্যাপার যে, তাদের প্রেম প্রেম ভাব আর দেখা যাবেনা। তবে তারপরই শুরু হয় ছবির মূল নায়ক নেগেটিভ চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়ের কারিশমা। সে কী অভিনয়!
নৌকা, সাগরের পানি, মাছের কারুকার্য, জাল, ঝড়, বিদ্যুতের ঝলক, জেলেদের রাজনীতি-দূর্নীতি-বিক্ষুব্ধদের মধ্যে একজনকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে হাত করে বিক্ষোভ দমন করা, দিনের পর দিন পানিতে ভাসতে ভাসতে হ্যালুসিনেশন হওয়া ও অন্য অলীক জাহাজের দেখা পাওয়া, ইত্যাদি সবকিছু চমৎকার ভাবে চিত্রায়িত করেছেন ছবির পরিচালক।
বিভ্রমের ছবি বলে শেষের সাপের বিষয়টা বেশ পৌরাণিক ও অলৌকিক হয়ে গেছে, যা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে। বাকি সবকিছু পারফেক্ট। মোদ্দা কথা, হাওয়া সিনেমাটা আমার কাছে সার্বিকভাবে ভালো লেগেছে। 'হাওয়া'র নৌকাকে বাংলাদেশের একটুকরো জেলে পাড়া মনে হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২৩