somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

আবারও “বাঙালনামা“......

১৯ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আবারও “বাঙালনামা“......

সাহিত্য নির্ভর পত্রিকা পড়তে আমার বাসায় যেসব বিদেশী পত্রিকা-ম্যাগাজিন নিয়মিত কেনা হয় তার মধ্যে অন্যতম কলকাতার পাক্ষিক 'দেশ' পত্রিকা।

খুব সম্ভবত ২০০৬ সালের মার্চ মাস থেকে পাক্ষিক দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় “বাঙালনামা“ বলে একটি সুবিখ্যাত উপন্যাস; লেখক সাহিত্যিক ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরি। আমি নিয়মিত পাঠক ছিলাম “বাঙালনামা“ উপন্যাসের। ২০০৭ সালে যা বই আকারে বের হয়। “বাঙালনামা“ উপন্যাস সম্বন্ধে প্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন…”গ্রন্থটি অতিশয় সারবান। রচনার গুণে একটানা পড়ে যাবার আগ্রহ যেমন জাগিয়ে রাখে তেমনই মাঝে মাঝেই আবার আগের অংশ আবার পড়ে নিতে ইচ্ছে হয়“।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য এই জন্য উদ্ধৃত করলাম কারণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই হলেন সেই বিরল গোত্রের একজন সাহিত্যিক, যিনি পাঠকদের মনের কথাগুলো বুঝতে পারতেন! সে যা-ই হোক, দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক পড়েই আমি সামহোয়্যারইন ব্লগে বাঙালনামা উপন্যাসটির রিভিউ লিখেছিলাম- ২০০৮ সালে। ২০১২ সনে একজন ব্লগার বন্ধু আমাকে বাঙালনামা উপন্যাসটি উপহার দিয়েছিলেন! কী এক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অনেকবার আমি “বাঙালনামা“ পড়েছি। যতবার পড়ি ততবারই নতুন কিছু আবিস্কার করি। এই বইয়ের প্রতি আমার বাড়তি আকর্ষণের আরও কিছু আত্মীক টান আছে- যা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি...... তাই বাংগালনামা নিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় রিভিউ লিখেছি অন্তত পাঁচ প্রশস্থ্য! কারণ, যতবারই “বাঙালনামা“ পড়ি ততবারই নতুন কিছু উন্মোচিত হয়, আবিস্কার করি নতুন এক অধ্যায়!



তপন রায়চৌধুরি ( ১৯২৬- ২০১৪ ) পড়াশোনা করেছেন যথাক্রমে বরিশাল জেলা স্কুল, স্কটিশচার্চ কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লী স্কুল অফ ইকনমিক্স, হার্ভার্ড, পেনসিলভেনিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ও অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো, ফ্রান্সের মত দেশে পর্যন্ত অধ্যাপনা করেছেন। পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত এই বরিশালের বাঙ্গাল, ভারতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের অন্যতম খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

যারা এই দুর্ধর্ষ বইখানি পড়েছেন, তারা জানেন যে- লেখককে ছোটবেলায় তাঁর পরিবারের সবার সাথে বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় আসতে হয়েছিল বিশেষ কারণে। এই প্রসঙ্গে লেখক লিখছেন…..”কলকাতা প্রবাসের কাহিনীতে একটি মানুষের কথা না লিখে শেষ করলে অসমাপ্ত থাকবে। তিনি আমার প্রথম গৃহশিক্ষক পিতৃবন্ধু অনন্তকুমার সেন, বর্তমানে খ্যাতনামা নট রুদ্রপ্রসাদ সেনের বাবা।” তপনবাবু তাঁর অনবদ্য স্টাইলে আরো বলছেন ….”সম্পূর্ণ শুদ্ধচরিত্র মানুষ কাকে বলেে, তেমন মানুষ আছেন কি না বা সম্ভব কি না আমি জানিনা। কিন্তু সেই ইউক্লিড- কল্পিত সরলরেখার কাছাকাছি যদি কেউ বা কারা পৌঁছে থাকেন, তাঁদের একজন প্রয়াত অনন্তকুমার সেন।”

তপনবাবু অনেকটাই লিখেছেন অনন্তকুমার সেন সম্পর্কে…………“অনন্তবাবু ছিলেন গাঁধীবাদী, পরিধানে স্বহস্তে কাটা সুতোয় তৈরি খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি। বহুদিন বরিশাল জেলায় নিজের গ্রামে অন্তরীণ থাকার পর ছাড়া পেয়ে উনি সপরিবারে কলকাতা আসেন। সেখানে তিনি এক স্কুলের হেডমাস্টার হন। দুর্নীতি অনন্তবাবুর সহ্য হত না এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে বরাবরই দুর্লভ। ফলে কোনও স্কুলেই তিনি বেশিদিন টিকতে পারতেন না। কিন্তু শিক্ষক এবং প্রধানশিক্ষক হিসাবে খ্যাতি হওয়ায় ওঁর চাকরির অভাব হয়নি। ওঁর বন্ধুদের কাছে ওঁর এক স্কুলে শেষ দিনটার একটি উল্লেখযোগ্য বর্ণনা শুনেছি। প্রধানশিক্ষক অনন্তবাবু তাঁর অফিসে উপবিষ্ট। রাগে দুই চোখ রক্তবর্ণ। সামনের চেয়ারে অতিশয় বজ্জাত মালিক তথা সেক্রেটারিবাবু। অনন্তবাবুর আদেশমতো দশম শ্রেণীর দুই ছাত্র সেক্রেটারির দুই কান মলে দিচ্ছে- বেশ সম্যকভাবেই মলছে। কর্ণমর্দনপর্ব শেষ হলে অনন্তবাবু ওই সেক্রেটারিরই হাতে পদত্যাগপত্রটি দিয়ে বিদ্যালয়ভবন ত্যাগ করলেন। সাত-আট বছর বয়সে মানুষের চরিত্রমাহাত্ম্য বোঝার ক্ষমতা থাকেনা। কিন্তু মাষ্টারমশাই যে অন্য পাঁচজনের থেকে স্বতন্ত্র সেটা বুঝতে পারতাম। সদাহাস্যময় মানুষটি যে অফুরন্ত স্নেহের আধার সেটা ও বুঝতে কষ্ট হতো না।“

…….
তপনবাবু আরো কিছু আকর্ষণীয় ঘটনার উল্লেখ করেছেন। আমি সেই সব বিষয়ে আর চর্চা করলাম না। তবে আমি থেমে থাকিনি। বরিশালের আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অনেক প্রবীণ জ্ঞাতী স্বজনদের কাছে খোঁজ নিতে শুরু করি- অনন্তকুমার সেন সম্পর্কে। আমার এক আত্মীয়- যার বয়স এখন নব্বই পেরিয়ে তাঁর কাছে জানতে পারি অনন্তকুমার সেন সম্পর্কে- ওনার বেশ কয়েকঘর নিকট স্বজন এখনও এই দেশে নিজেদের অস্তমিত অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন, যা নিয়ে ভবিষ্যতে আর একপ্রস্ত লেখার প্রস্তুতি আছে।

এরপরেই তপনবাবু লিখছেন, কোন খবর না দিয়েই পর পর কদিন গৃহশিক্ষক অনন্তবাবু, তপনবাবুদের পড়াতে এলেন না। তখন সব বাড়িতে টেলিফোন ও ছিলনা। অনন্তবাবুর একটা খোঁজ নেওয়া দরকার। তাই বাবার সাথে বালক তপনবাবু, উত্তর কলকাতায় এক সরু এবং অন্ধকারময় গলিতে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে, অনন্তবাবুর বাড়ির হদিশ পেলেন। ডাকাডাকি করতে, দোতলা থেকে বোধ হয় অনন্তবাবুর ভাই নেমে আসলেন। তপনবাবুর বাবা সেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন- “উনি আছেন কেমন?
“আত্মীয় ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, …”শেষ হইয়া গ্যাছে কাইল।”

এই ভয়ঙ্কর সংবাদ শোনার পরে তপনবাবুর ভাষায় ….”বাবা অনুবাদ করলেন- তোমাদের মাষ্টারমশাই আর নেই। নিতান্ত প্রিয়জনের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কথাটা বুঝে কান্না আসতে বোধ হয় কয়েক মিনিট সময় লেগেছিল। সমস্ত চেতনা জুড়ে একটা তীব্র অভাববোধ শরীরমন আচ্ছন্ন করে ফেলল……”!

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বাঙালনামা উপন্যাসটি বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে যথেষ্ট সমাদৃত হলেও কলকাতার হিন্দুদের মধ্যে অনেক দ্বিধাবিভক্ত সমালোচিত হয়েছে। কারণ, লেখক দুই বাংলার আপামর বাঙালির মনমানসিকতা তথা মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা নির্মোহ দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন, যা হিন্দুত্ববাদের উগ্রবাদী মানুষের কাছে অসহ্য।

অতি সাধারণ একজন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার সৌভাগ্য হয়েছে অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষের সাথে দু-এক মিনিট কাটানোর। আমার আব্বার সহপাঠী শ্রদ্ধেয় তপন রায়চৌধুরীর সাথে আমারও একবার দেখা করার সুযোগ হয়েছিলো...... সেই সব মুহুর্ত স্মরণীয় করে রাখবার জন্য মোবাইলে সেল্ফি বা কোন মহৎহৃদয় ব্যক্তির দেখা পাইনি যিনি ফটো তুলে দেবেন …. আসলে সেইরকম দিনকালই তখন ছিলনা। দু-একটা ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে।

পরিশেষে এটাই বলতে চাই; এত প্রাঞ্জল ভাষায় এতো কৌতুকের ভঙ্গীতে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি ভারত সহ ইংল্যান্ড- আমেরিকা ও আরো বিভিন্ন দেশের শিক্ষাজগতের ছবি …. লেখক কি সুন্দর ভাবে যে এঁকেছেন, তা না পড়লে বোঝা যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৭
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিমকে বিভিন্ন নিয়মে ইবাদত করতে কে বলেছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৪৭



সূরাঃ ৬ আনআম, ১৫৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১৫৩। আর এপথই আমার সিরাতাম মুসতাকিম (সরল পথ)। সুতরাং তোমরা এর অনুসরন করবে, এবং বিভিন্ন পথ অনুসরন করবে না, করলে তা’... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ার রক্তচোখ: ক্রোধের নগর

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৫২


ষড়ঋপু সিরিজের দ্বিতীয় কাহিনী ”ক্রোধ”

রাত্রি নেমেছে শহরের উপর, কিন্তু তিমির কেবল আকাশে নয়—সে বসেছে মানুষের শিরায়, দৃষ্টিতে, শ্বাসে। পুরনো শহরের এক প্রান্তে, যেখানে ইট ভেঙে পড়ে আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রিয় কন্যা আমার- ৭৪

লিখেছেন রাজীব নুর, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:৪২



প্রিয় কন্যা আমার-
ফারাজা, তুমি কি শুরু করেছো- আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! রাতে তুমি ঘুমানোর আগে ঘুমানোর দোয়া পড়ে ঘুমাতে যাও। প্রতিদিন তোমার মুখে ঘুমের দোয়া শুনতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নববর্ষের শোভাযাত্রা নাম বদল করছি না, পুরোনো নাম–ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি: ঢাবি উপাচার্য

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:০৪



পয়লা বৈশাখে ফি বছর চারুকলা অনুষদ আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেছেন, ‘আমরা নাম পরিবর্তন করছি না। আমরা পুরোনো নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

'৭৪ সালের কুখ্যাত বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল এখন সময়ের দাবী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৫


বিগত আম্লিক সরকারের আমলে যে কুখ্যাত আইনের অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করে গায়েব করার চেষ্টা চলতো তা হলো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। এই আইন ব্যবহার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×