"পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন/ফিরে আর আসবে কি কখনো"___
না। ফিরে আসবে না।
শুধু পৌষ নয়। বৈশাখ থেকে চৈত্র'র মাস-ঋতু কিভাবে যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে। সেই ৫০ বছর আগে ফেলে আসা দিন শত আকুতিতেও ধরা দেবে না জানি। তাই বলে কি "দেখা আর না দেখার মাঝামাঝি কোন রং"- চোখে আঁকা বারণ?
তাই বিনা নোটিশে পৌঁছে গিয়েছিলাম আমার ভালোবাসার ধনের কাছে। আমার রাখালের বাঁশির কাছে। আমার নীল উচ্ছাসের আঙিনায়। আমার বাসন্তী রঙের জীবনের কাছে। আমার নীল দরিয়ার ছেলেবেলায়- আমার দাদা বাড়ি। উত্তরাধিকার সূত্রে যে বাড়ির মালিক এখন আমি.....
সেই বাড়িতে এখন আর কেউ থেকেনা, তবুও বাড়ির মেন্টেনেন্স করার জন্য কেয়ার টেকারকে বলা হয়। ফি বছর কেয়ার টেকার সামনের দিকটায় কিছু চুনকাম করে মোটা অংকের একটা বিল পাঠিয়ে দেয়....। পাশাপাশি দুটি বাড়ি (দালান ঘর, একটা শতবর্ষী, অন্যটার বয়স আমার চাইতে দশ বছর বেশী), দুই বাড়িই তিন যুগের বেশী সময় ধরে পরিত্যক্ত। কিন্তু স্মৃতি কি কখনো পরিত্যক্ত হয়! সেই ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়িতে আজও আমার চঞ্চল পায়ের ছাপ অনুভব করি। যেখানে হাওয়া কেঁদে ফেরে এখনো জীবনের খোঁজ করতে গিয়ে। সেই চলটা উঠে যাওয়া সিমেন্টের সিঁড়িটাকেই আমি এখনো স্বর্গের সিঁড়ি ভাবি। সেই বড় বড় থাম্বাগুলো আমার অহংকার। ব্যালকনি আমার 'এলোমেলো' লেখার প্রথম প্রেরণা। লোহার নকশা করা বারান্দার রেলিংটা আজও যেন সেই প্রেমের পরশ মাখানো নেশায় ভরপুর।
পুরনো ঘরটা এখনো একই রকম মন কেমন করা রয়ে গিয়েছে। ঘর আর কমন প্যাসেজের মাঝের অংশটায় একটা মোটা তারের চারকোনা জালি দিয়ে আলাদা করা থাকতো। সেই তারের জালি ধরে আমি তাকিয়ে দেখতাম ভিতরে কি আছে। ছোট দাদার ব্যস্ততা, স্টাফ দাদুদের অলস আড্ডা, বড় ভাল লাগতো দেখতে। আজ আর কেউই নেই। স্তূপাকৃত হয়ে পরে রয়েছে নানাবিধ বইয়ের জঞ্জাল, অকেজো সব সামগ্রী। আমি সেই তারের জালিতে হাত রেখে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম ফেলে আসা সময়কে ধরবো বলে। কিছু পেলাম, কিছু স্মৃতিতে ধরা দিল না।
পেছনে ছিল একটা বড় জানালা। সেখান থেকে পাশের ফাঁকা জমির পলাশ গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আনমনে- কি ভাবতাম জানি না। তবে খুব ভাল লাগতো সেখান থেকে আকাশ আর পলাশ গাছটাকে দেখতে। পাশে আরেকটা ছোট পুকুর ছিল।
সেদিন পুরনো ঘরটায় এভাবেই আবার স্মৃতিরা পাখনা মেললো। বারেবারেই খুব একা হতে চাইছিল মন। নিজেকে একটু তফাতে রাখলাম। আড়াল চাইছিল ৫০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একটা স্বপ্ন। সময় যেন থমকে গিয়েছে ওই দরজায়। আমি কোন এক অদৃশ্য জাদুকরের অঙ্গুলি হেলনে স্থির হয়ে রয়েছি।
সব স্মৃতির সৌরভের মত পুরনো বাড়িরও একটা গন্ধ থাকে। তার সারা শরীর জুড়ে অজস্র কথা থাকে। ফিসফিসানি থাকে। কান পেতে রইলে তারা বোঝে সব ভাবনাগুলোকে। এত বছর ধরে তার হৃদয়েও উদ্দাম কথারা জমেছে, আমার মতই। আমি একা নিচ থেকে ছাদে উঠলাম। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রইলাম বিনা কারণেই। মনে হচ্ছিল, ছোট দাদী যেন ডাকছে আমায় নাম ধরে। সিঁড়ির রেলিংয়ে হাত বুলালাম। আমার সামনে কেউ নেই। তবুও সবাই রয়েছে। সেই ৫০ বছর আগের মত। আমি কাঁদছি আনন্দে, আমি কাঁদছি অঝোর ধারায়।
দরজা বন্ধ, ভাংগা জানালার ঘরে কি খুঁজছি আমি জানি না। কি অনুভূতি কাজ করছে বুঝতে পারছি না। আমার সময় থমকে গিয়েছে। আমি ঘুমিয়ে পরছি যেন আমাদের পুরনো দালানের মধ্যে। পুরোনো মেঝের ঠান্ডায় বড় আরাম লাগছে আমার। কেউ কোনোদিন যেন আমায় না ডাকে এখান থেকে, আমি অস্ফুট চিৎকার করে জানিয়ে দিতে চাইছি সেটা সবাইকে।
ছবিতে একজোড়া টিনের ঘর আছে। বাম পাশের টিনের ঘরটার বয়স ১৭০ বছর- যা আমাদের মরহুম দাদার আমলে তৈরী। সেই ঘরের পাশে টিনশে্ড সকল প্রকার অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন বাংলো বাড়িটা আমি তৈরী করেছিলাম ১০ বছর আগে। আমরা যখন গ্রামের বাড়িতে যাই- তখন ঐ বাড়িতেই থাকি। অন্যদিকে পাশাপাশি দালান বাড়ির একতলা বাড়িটাও আমার আমার দাদা ১৯২১ সনে বানিয়েছিলেন। তার পাশের দোতলা বাড়িটা আমার আব্বা বানিয়েছিলেছেন ১৯৫৮ সনে।
এখন অনেক রাত। ঘুমে ঢুলে আসছে চোখের পাতা। কিন্তু ঘুমোতে পারছি না। আমার সারা চোখ জুড়ে স্মৃতিরা লুকোচুরি খেলছে। সেই প্রাণখোলা বন্ধুরা, সেই পুকুর পাড়ের পলাশ গাছ, সেই রাজু কাকু, বন্ধু শৈলেন, পরিমল, জামাল, লালু সবাই আমায় জাগিয়ে রেখেছে।
আমি ভয় পাচ্ছি ঘুমোতে।
"দেখা আর না দেখার কাছাকাছি কোন রং চোখে আর ভাসবে কি কখনো?"- সেই আশঙ্কায় আমি ভয় পাচ্ছি।
আমি কষ্ট পাচ্ছি।
"খুশী আর লজ্জার মাঝামাঝি সেই হাসি, শ্রাবণের ধারার মত" কতরাত যে মিস করেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এখন সে মুখ আর মনে পরে না শত চেষ্টাতেও।
"বোঝা আর না বোঝার কাছাকাছি কোন গান"- ওই দিনগুলোর মত করে ভাল আর বাসবে না হয়তো কেউই জানি। তাই তো আবার ফিরে ফিরে আসবো আমার দাদার বাড়ি। জানি, চুপি চুপি বাতাস বাঁশি বাজাবে প্রতিবার- যখনই আসবো তার কাছটিতে। তার আবেশ মনে মনে সাজাবে জীবন বোধকে।
কিন্তু ফিরবো না বললেই তো আর থেকে যাওয়া যায় না.....
(দুই বছর আগের লেখা)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২