রাইস ব্রান অয়েল!
তেল নিয়ে তেলেসমাতি শুরু হয়ে গিয়েছে। সায়াবিন তেল ঘোষিত দাম প্রতি লিটার ১৯৮/- বলা হলেও ২২০ টাকার নিচে সায়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছেনা। সর্বপরি বাজার থেকে সায়াবিন তেল উধাও! সায়াবিন তেলের দাম বেশী বলে ইতোমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাদাম তেল খেতে বলেছেন। আমাদের বাসার পাশেই একটা এগোরার আউটলেট আছে। ওখানে খোঁজ নিয়ে দেখলাম প্রতি লিটার বাদাম তেলের দাম ৮৫০ টাকা! জানিনা, সায়াবিন তেলের বদলে বাদাম তেল খেতে বলা ভূক্তভোগী আমজনতার সাথে মশকরা কিনা! উল্লেখ্য যে, এলিফ্যান্ট রোড ভোজ্যতেল মিলের ব্যবস্থাপক আবদুর রশিদের কাছে জেনেছি- এক কেজি সরিসার দাম ৭০/৮০ টাকা। কিন্তু এক কেজি কাচা বাদামের দামই ১৮০ টাকা! তিন কেজি সরিসায় এক লিটারের সামান্য বেশী তেল পাওয়া যায়। অন্যদিকে সাড়ে তিন কেজি বাদামে এক লিটার বাদাম তেল পাওয়া যায়। বাদ দেই এসব আজাইরা প্যাচাল। রাইস ব্রান অয়েল নিয়ে দশ বছর আগে কি লিখেছিলাম- সেটা আরও একবার প্রচার করছিঃ-
ব্যাক্তিগত ভাবে আমার নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানার কৌতুহল যেমন অনেক, তেমনি সুযোগ পেলেই সেই শিল্প প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে দেখার সুযোগ খুব একটা মিস করিনা। ব্যাক্তিগত উদ্যোগে দেশীয় বিভিন্ন রকমের অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান দেখার সুযোগ পেয়েছি।
'কেবিসি এগ্রো প্রোডাক্টস প্রাঃ লিঃ' নামের একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তিপক্ষের আমন্ত্রনে ১লা জানুয়ারি রূপসী বাংলা হোটেলে গিয়েছিলাম।'কেবিসি এগ্রো প্রোডাক্টস প্রা: লিঃ' জাঁকজমক অভিষেকের মাধ্যমে চালের কুড়া থেকে ভোজ্যতেল(Rice bran oil )উৎপাদন করে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাজারযাত শুরু করে। চমতকার একটি অনুষ্ঠানে সিনে প্রজেক্টরের মাধ্যমে আমন্ত্রিত অথিতিদের রাইস ব্রান অয়েল উতপাদন প্রক্রিয়া এবং উতপাদিত তেলে রুপসী বাংলা হোটেলে আমন্ত্রীত অতিথিদের জন্য ডিনারের মেন্যুর যাবতীয় আইটেমে রাইস ব্রান অয়েল ব্যাবহারের ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনী শেষে ডিনার পার্টি। বিদায় বেলা সকল আমন্ত্রীত অতিথিদের জন্য ছিল গিফট হ্যাম্পার। যাতে ছিল রাইস ব্রান অয়েলে হোটেল রুপসী বাংলার সেফদের রান্না কিছু খাবার ও একবোতল রাইস ব্রান অয়েল!
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রাজকুমার আগরওয়াল এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুধীর চৌধুরী আমার পূর্ব পরিচিত। আমি রাজকুমার আগরওয়াল সাহেবকে তাঁদের ফ্যাক্টরী ভিজিট করার আগ্রহ প্রকাশ করি। আমার সাথে আরো কয়েকজন একই আগ্রহ প্রকাশ করলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের আমন্ত্রন জানান। ঐ অনুষ্ঠানেই জানতে পারি-বাংলাদেশে একই ধরনের আরো একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরী হচ্ছে শেরপুরে। শেরপুরে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডাস্ট্রীজের নাম এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ। এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর চেয়ারম্যান সৈয়দ মনোয়ারুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গনি গালিব, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দা ফারহানা গালিবও এই অনূষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন। আমরা তাঁদের সাথেও পরিচিত হই এবং ওনাদের ইন্ডাস্ট্রীজও ভিজিট করার আগ্রহ প্রকাশ করি-উনারাও সানন্দে আমাদের আমন্ত্রন জানান। মার্চ-এপ্রিল মাসে আমরা চার জন ব্যাবসায়ী উল্লেখিত দুটি ইন্ডাস্ট্রীজ দেখেছিলাম-সেই অভিজ্ঞতাই আজ পাঠকদের সাথে শেয়ার করছি।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ভোজ্যতেলের চাহিদা ১২/১৩ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু দেশে সরিষাসহ বিভিন্ন তেলজাতীয় শস্য থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন হয় মাত্র ৪ লাখ মেট্রিক টন। বাকি ৮/৯ লাখ মেট্রিক টন ভোজ্যতেলই বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়। 'কেবিসি এগ্রো প্রোডাক্টস প্রাঃ লিঃ' চালের কুড়া থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন প্রতিষ্ঠান এর অবস্থান ঢাকার ধামরাই। প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যায়ে চার একর জায়গা জুড়ে এই ইন্ডাস্ট্রীজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারত ও থাইল্যান্ডের যৌথ কারিগরি প্রযুক্তিতে। ২৩০ জন লোকের কর্ম সংস্থানের প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মেট্রিক টন চালের কুড়া থেকে ১০০ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল এবং ৪০০ মেট্রিক টন ডি-অয়েল্ড রাইস ব্র্যান(পোল্ট্রি, ফিশ,ডেয়ারী ফুড) উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এদের উতপাদিত তেলের ব্রান্ড নেম “রাইস ব্রান অয়েল" ।ভোজ্যতেল উৎপাদনের পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠান গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি এবং মাছের খাদ্য উৎপাদন করছে।
অন্যদিকে শেরপুর জেলায় প্রতিষ্ঠিত এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর উদ্যোক্তারা জানান, বেসিক ব্যাংকের অর্থায়নে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তাঁরা এই তেল কারখানা স্থাপন করেছেন। এতে তেল উৎপাদনের জন্য প্রতিদিন দেড়শ মেট্রিক টন ধান/চালের কুঁড়া প্রয়োজন হয়, যা থেকে ২৫ মেট্রিক টন তেল উৎপাদিত হচ্ছে। এটি দেশের দ্বিতীয় ভোজ্যতেল উৎপাদন কারখানা। সম্পূর্ণ ভারতীয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি দিয়ে বেসিক ব্যাংকের অর্থায়নে শেরপুর জেলা শহরের শেরীপাড়া এলাকায় তিন একর জমির ওপর কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই কারখানায় উৎপাদিত তেল “স্পন্দন” নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হচ্ছে।
এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর রিফাইনারি ইনচার্জ এন্ড চীফ কেমিষ্ট ভারতীয় নাগরিক শাহিজ পি টি’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান-রাইস ব্রান অয়েল প্রাকৃতিক ভিটামিন ও খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ এবং শতভাগ কোলেস্টেরলমুক্ত। এতে ভিটামিন এ, ডি, ই ও ওমেগা ৩ আছে, যা রক্তের LDL(মন্দ কোলেস্টেরল) মাত্রা কমিয়ে এবং HDL (ভালো কোলেস্টেরল) মাত্রা বাড়িয়ে হূদেরাগের ঝুঁকি প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে।’ মিলের গবেষণাগারেও চলছে উৎপাদন-প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এ সময় কারখানার সহকারী কেমিস্ট সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম জানান, রাইস ব্র্যান অয়েল বা ধানের কুঁড়ার তেল উৎপাদনে ফসফরিক এসিড, সাইট্রিক এসিড, অ্যাক্টিভেটেড কার্বন, ব্লিচিং আর্থ, কস্টিক সোডা, কমন সল্ট প্রভৃতি রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়।
এই প্রতিষ্ঠানে ১৪ জন ভারতীয় নাগরিকসহ প্রায় ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। কারখানায় ব্যবহূত মোট কাঁচামালের ৯০ শতাংশই স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত ক্রুড অয়েল, গাম ও ফ্যাটি এসিড সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গণি বলেন, ধান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ/পঞ্চম। সে জন্য দেশে যে পরিমাণ ধানের কুঁড়া উৎপাদিত হয়, তার সঠিক ব্যবহার করতে পারলে ভবিষ্যতে বিদেশ থেকে হয়তো আর ভোজ্যতেল আমদানি করতে হবে না। এতে দেশীয় শিল্প বিকাশের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। তবে হতাশার কথা-দুটো প্রতিষ্ঠানেরই উদ্যোক্তা মালিক জানালেন কারখানা দুটির একটিও অদ্যাবধি নির্দিষ্ট উতপাদন লক্ষ্যমাত্র তিন শিপট চালু রাখা সম্ভব হয়নি শুধু মাত্র বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নাপাবার জন্য।জাতীয় গ্রীডের বিদ্যুতে মাত্র এক শিপ্ট কারখানা চালু রাখা হয়, আর এক শিপ্ট নিজস্ব জেনারেটরের পাওয়ারে উতপাদন করার কারনে উতপাদন ব্যয় ২০% বেশী হচ্ছে!
দুটি কারখানাতেই সম্পূর্ণ উতপাদন প্রক্রিয়ায় কঠোর মান নিয়ন্ত্রন করা হয়। উতপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত সব শ্রেনীর লোকদেরই ডিস্পোজাবল/ লেজার পিউরিফিকেশন ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক। রাইস ব্রান অয়েল সাধারণ ভোজ্যতেলের চেয়ে ২০% সাশ্রয়ী এবং কোলস্টেরলমুক্ত। স্বাদে-গন্ধে যেমন ব্যতিক্রম, তেমনি মানের দিক দিয়েও এটি অতুলনীয়। বাজারের সাধারণ ভোজ্যতেল উচ্চ রক্তচাপ, পার্কিনসনস ডিজিজ, লিভারের জটিলতা, ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগের উপসর্গ তৈরি করে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান, শিল্প ও গবেষণা পরিষদ (BCSIR) কর্তৃক পরীক্ষিত এবং BSTI কর্তিক মান উত্তীর্ণ ও অনূমোদিত। কারখানার সহকারী কেমিস্ট সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম জানান-আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন (AHA) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক নির্ধারিত স্বাস্থ্যসম্মত তেলের সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী মাত্রায় অবস্থান করছে রাইস ব্রান অয়েল। ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারের তাইওয়ান, থাইল্যান্ড এবং কোরিয়াতে প্রধান ভোজ্যতেল হিসেবে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকা ইউরোপসহ অনেক উন্নত দেশের ভোক্তারা অতি উচ্চমূল্যে এই তেল ব্যবহার করছে।
রাইস ব্রান অয়েল এবং আমার অভিজ্ঞতাঃ প্রথম দৃষ্টিতে এই তেল দেখতে সরিশা তেলের রঙ থেকে কিছুটা কালচে রঙ। অন্য যেকোনো তেল থেকে হালকা, তেল চিটচিটে নয়(নন স্টিকি)। সদ্য তাঁজা চালের মিষ্টি সুবাস। উতপাদি তেলের রঙ উজ্জ্বল করার জন্য কিম্বা তেলের ন্যাচারাল ফ্লেভার রক্ষার জন্য রাসায়নিক কোনো কিছু ব্যাবহার হয়না। এই তেলের রান্না খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু এবং অল্প তেলে তুলনামূলক বেশী রান্না করা যায়। বাজারে প্রচলিত অনেক ভোজ্য তেলের(সায়াবিন, পাম)চাইতে দাম একটু বেশী হলেও রাইস ব্রান অয়েল এখন পর্যন্ত ভেজাল মূক্ত।
(২০১২ সনের মে মাসের দুই তারিখ এই ব্লগে লিখেছিলাম। এখানে পুরনো ছবিগুলো এড করা হয়নি)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৩