লাহোরে এখন আমাদের কাজ হচ্ছ- যথাযত কর্ম কর্তাদের নিকট থেকে প্রি শিপমেন্ট ইন্সপেকশন রিপোর্ট সংগ্রহ করা,কয়েকজন টেক্সটাইল মেশিনারীজ স্পেয়ার্স ও তুলা রপ্তানীকারকদের সাথে ব্যাবসায়ীক আলোচনা করা। নাসেরের অনূরোধে শকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সারহাসপাতালে নিজের চেক আপ করানো এবং লাহোর ঘুরে বেড়ানো। ক্যান্সার হাসপাতালে আমার এপয়েনমেন্ট আরো দুদিন পর। বিন লাদেন হত্যাকান্ডেরপর থেকেই সমগ্র পৃথিবীর কৌতুহলী মানুষের দৃস্টি আকর্ষন করে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহর। আমিও মনের ভিতর সুপ্ত আশা জিয়িয়ে রেখেছি-অ্যাবোটাবাদ যাবো। লাহোর থাকা অবস্থায় আমার মনের ভিতর সেই বাসনা আরো দৃঢ় হয়। নাসের জানালেন-অ্যাবোটাবাদ এখন রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া উপরন্তু ওখানে বিদেশীদের যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে সরকার। তারপরেও নাসের মাহমুদ অ্যাবোটাবাদ নিয়ে যাবার চেস্টা করবেন। আমরা নাসেরের মাতুল পরিবারের সাথে এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখে সময় কাটাই। লাহোর আমার পরিচিত শহর। আগেই দুইবার লাহোর বেড়িয়েছি ৮/১০ দিন করে-কাজেই দেখার অবশিস্ট কিছুই নেই।
লাহোর পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী। লাহোরকে বলা হয় পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক রাজধানী। বিশ্বের অনেক নামীদামি লোকেরা লাহোর ভ্রমন করে লাহোর সম্পর্কে বলেছেন- লাহোর, প্যারিস অব দ্য ইস্ট, পার্ল অব পাঞ্জাব, দ্য গার্ডেন অব মুঘল, সিটি অব গার্ডেন ইত্যাসি। লাহোরের লোকসংখ্যা প্রায় এক কোটি। রাভি নদীর তীরবর্তী এ শহর ঘেষে আরো বিখ্যাত দুটো নদীর নাম ঝিলাম ও চেনাব। এখানে রয়েছে মোগল আমলের অনেক স্থাপত্য নিদর্শন। লাহোর নগরী এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ঐতিহাসিকদের মতে, উপমহাদেশের দু’টি শহরকে মোগল আমলে একই রকম সাজানো হয়। একটি দিল্লি, অন্যটি লাহোর-যার বহিঃমিল লক্ষ করেছেন যারা দিল্লি ও লাহোর দুটো সিটিই নিবির ভাবে ভ্রমন করেছেন। এখানেই রয়েছে ঐতিহাসিক শালিমার গার্ডেন, বাদশাহ আওরঙ্গজেব নির্মিত বাদশাহী মসজিদ, বাদশা জাহাঙ্গীর ও সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সমাধি এবং শিখ ধর্মাবলম্বীদের গুরু দুয়ারা। এর পাশেই আছে লাহোর ফোর্ট, রয়েছে কবি আল্লামা ইকবালের সমাধি সৌধ। ১৯৩৯ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। লাহোর শহরে স্থাপিত মিনার-ই-পাকিস্তানে তুলে ধরা হয়েছে সেই ইতিহাস। উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলায়ও উত্কীর্ণ রয়েছে সেই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব।
১৬৬১ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাদশাহী মসজিদ তৈরি করেন। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই মসজিদকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ মসজিদের ভেতরে ৫ হাজার লোক এবং বাইরে ১ লাখ লোক একসঙ্গে জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটিতে ইসলামিক, পার্সিয়ান, সেন্ট্রাল এশিয়া এবং ভারতীয় কৃষ্টির অদ্ভুত মিল রাখা হয়েছে। এ মসজিদের অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে এখানকার ছোট্ট মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে মহানবী হজরত মুহাম্মদের (স.) ব্যবহৃত লাঠি, পাগড়ি, কম্বল, জুতা এবং চুল। এছাড়া আছে হজরত ফাতেমা (রা.) এবং ইমাম হাসান ও হোসেনের (রা.) ব্যবহৃত জিনিসপত্র-যা আমি আগেই দেখেছি। এসব দুর্লভ জিনিস বাদশা আওরঙ্গজেব তখন সৌদি আরব ও তুরস্ক থেকে সংগ্রহ করেছেন।
লাহোরে দেখারমত অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। যারমধ্যে অন্যতম-শালিমার গার্ডেন। মুঘল সম্রাট জাহাংগীরের স্ত্রী নুর জাহানের জন্য কাশ্মীর, দিল্লি ও লাহোরে তিনটি শালিমার গার্ডেন নির্মান করেছিলেন। লাহোর শহরের ৫ কিঃ মিঃ উত্তরে ভগবানপুরা নামক যায়গায় গ্রান্ড ট্রাংক রোডে লাহোর শালিমার গার্ডেন অবস্থিত। লাহোরের শালিমার গার্ডেন ছিল সম্রাজ্ঞীর গ্রীষ্ম কালীন অবকাশ যাপন কেন্দ্র। ১৬৪১ খৃস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান এই গার্ডেন নির্মান শুরু করেন। শালিমার গার্ডেনে এখনও যেসব দেখারমত ঐতিহাসিক স্থান আছে-তা হচ্ছে-শাওয়ান ভাধুম নামক দর্শনার্থীদের জন্য গ্যালারী, নকরখানা(কর্মচারীদের আবাসিক ভবন),”খোয়াবগাহ”-সম্রাট-সম্রাজ্ঞীর ঘুমানোর ঘর,”হাম্মাম”-গোসলখানা, “আরামগাহ”-বিশ্রামাগার, “বারিধিস”-সম্রাজ্ঞীর বৈকালিক ভ্রমনের ওয়াকওয়ে।
একবার আমি উল্লেখিত দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে দেখতে যখন গভীর রাতে “খোয়াব গাহ”র সামনে গিয়ে দাড়াই-দেখি সম্রাজ্ঞীর রাজকীয় দাসী-বাদীরা তন্ত্রাচ্ছন্ন। খোয়াব গাহ'র চারিদিকে মেশক-জাফরান আর কস্তুরীর সুবাশে আমি আচ্ছন্ন হয়ে যাই। সম্রাজ্ঞীর জমকালো 'খোয়াব গাহ' এর ভিরতে বিশাল বিশাল মোমের আলো জ্বলছে। সম্রাজ্ঞী বিলাশ বহুল বিছানায় বিমর্ষ হয়ে বসে একটা পুড়ে পুড়ে ক্ষয়ে যাওয়া মোমের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মুখে অপেক্ষার ক্লান্তি আর উদ্ববিঘ্নতা-কেনো এখনও সম্রাট ‘হেরেম গাহ’ থেকে সম্রাজ্ঞীর কাছে আসছেননা! আমি হেটে হেটে চলে যাই সম্রাটের 'হেরেম গাহ'। সেখানে গিয়ে আমার চক্ষু চড়ক গাছ! সম্রাটের জন্য উপঢৌকন পারস্য সুন্দরী বাঈজীরা নৃত্য গীত করছে-সম্রাট নিজের গলার মনিমুক্তা খচিত মালা আর স্বর্ণ মূদ্রা বিলিয়ে দিচ্ছেন বাঈজীদের। সুরার নেশায় সম্রাটের দুচোখ ঢুলু ঢুলু...... হঠাত মনে হলো-রাজপ্রহরী আমাকে প্রশ্ন করছে-“তোম কাহা, হট যাও, বহুত দূরমে হট যাও......”-আমার স্বপ্ন ভেংগে যায়!
১৯৬২ সনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আউব খান সালিমার গার্ডেনকে পাকিস্তানের ‘ন্যাশনাল গার্ডেন’ ঘোষনা দেন। ১৯৭২ সনে ইউনেস্কো এই গার্ডেনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষনা করে।
লাহোর অবস্থান কালীন অনেকবার সালিমার গার্ডেন বেড়িয়েছি। একটি পুরনো ঘটনার কথা পাঠকদের সাথে শেয়ার করছি। একদিন ঐ পথে ফেরার সময় দুপুড়েই নাসেরকে নিয়ে সালিমার গার্ডেন ঢুকি। আমরা "শাওয়ান ভাদূম" বসে আছি। শাওয়ান ভাদুম হচ্ছে আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিন প্লাজার সিড়িরমত। এখানে অজস্র দেশ বিদেশী পর্যটকদের ভীড়। দর্শনার্থীরা যে যারমত ব্যাস্ত। আমিও ইতিহাস আর ঐতিহ্য রোমান্থনে মশগুল। হয়ত আমারমতই অনেকে কল্পনার চোখে অনূভব করছে-সম্রাট জাহাংগীর, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান এবং তাঁদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন সালিমার গার্ডেনের ইতিকথা। প্রসংগত একটা কথা নাবললেই নয়- অনেকেরই ধারনা পাকিস্তানী মেয়েরা শুধু বোরখা পরেই থাকে-বাস্তবতা কিন্তু মোটেই তেমন নয়(ওয়াজিরস্তান,আফগান সীমান্ত ও একেবারেই রিমোট এরিয়া ভিন্ন)। পাকিস্তান যতই রক্ষণশীল মুসলিম রাস্ট্র হোকনা কেনো সালিমার গার্ডেন প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য স্বর্গ স্থান, লাইক “মুক্তাংগন”! তাই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগলদের সাথে সকল প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভীর সর্বক্ষণ লেগেই থাকে। তবে লক্ষণীয় এখানেই কেউই শালিণতা অতিক্রম করেনা, কিম্বা চীন-থাই-ফিলিপিনোদেরমত ছাতা মুড়িদিয়ে কুকর্ম করেনা।
এক কপোত কপোতীর খুনসুটি আমি সামাণ্য দূর থেকে লক্ষ করছি। কিছুক্ষণ পূর্বে যুবকটি তরুনী প্রেমিকার আংগুলে একটি আংটি পরিয়ে দেয়-যার স্বাক্ষী আমি আর নাসের মাহমুদ, হয়তবা আরো অনেকেই। ওদের হাসিখুশী মুখ আমার ভালো লাগে। আমি অনূভবকরি-পৃথিবীর সকল প্রেমিক-প্রেমিকাদেরই ভালোবাসার ভাষা একই রকম। একই উচ্ছলতা একই খুনসুটি। ওদের খুনসুটি একসময় ঝগড়ায় পরিণত হয়। কিছুক্ষণ পরেই প্রেমিক যুবকটি প্রেমিকাকে একা রেখে হনহন করে অন্যত্র চলে যায়। প্রেমিকা বারবার বলছে-“বায়জীদ রোখো-বায়জীদ রোখো, বায়জীদ প্লীজ মেরা বাত শুনিয়ে”। কিন্তু প্রেমিক বায়জীদ চলেযায়! প্রেমিকা রাগে দূ;খে নিঃশব্দে কান্না করছে-আমি অনূভব করছি প্রেমিকার কস্ট!একটু পরেই প্রেমিক বায়জীদ ফিরে আসে। এবার প্রেমিকার ন্যায্য অভিমান রাগে পর্যবশিত হয়। প্রেমিকার মান নাভাংগীয়ে প্রেমিক বায়জীদ প্রেমিকার আংগুল থেকে কিছুক্ষণ আগে পরিয়ে দেওয়া আংটিটি কিছুটা জোড় করেই খুলে নিয়ে ছুড়ে মারে! অনেকগুলো সিড়ি ভেংগে আংটিটা যেখানে পরেছে-তা আমি নাসের দুজনেই দেখি। কিছুক্ষণ পর দুজনের মান-অভিমান শেষ হয়। আবার সুন্দর করে হাসে-খুনসুটি করে উচ্ছলতায়। ওরা তন্ন তন্ন করে আংটি খুঁজছে-কিন্তু পাচ্ছেনা। দুজনেরই মন খারাপ!
আমি আংটিটা তুলে নেই। আংটি হাতে নিয়ে প্রেমিক প্রেমিকার কাছে গিয়ে দাড়াই। মেয়েটি আমার হাতে আংটি দেখে মাথা নীচুকরে বলে-“দেখিয়ে জ্বী,ইয়ে আংগুঠি মেরি হ্যায়। কিসি না কিসি ওয়াক্ত ইয়ে মেরি আংগুলিসে ঘির চুকি। জরা দেখিয়ে ইসকা বিচমে মেরি নাম লিখ্যা হুয়া-মারজানা”। হ্যা, আমি দেখতে পাই-আংটির উপর খোদাই করে লেখা ‘মারজানা’।
(এই ঘটনাটা নিয়ে একটা গল্প অধূনালুপ্ত এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় লিখেছিলাম)
(পরের পর্বে.........)