----------‘ওপেন সিক্রেট!’
ইংরেজিতে ‘ওপেন সিক্রেট’ বলতে বোঝায়-এমন কিছু যা নামেমাত্র গোপন কিন্তু প্রকাশ্য-সেটাকেই আমরা বলি- ‘ওপেন সিক্রেট’। বাংলাদেশে ওপেন সিক্রেটের এতটাই ছড়াছড়ি যে, দৈনন্দিন কথাবার্তায়ও প্রায়শ এটির ব্যবহার করতে অভ্যস্থ। বাংলাদেশে ওপেন সিক্রেকেটর সংখ্যা কত তার কোন পরিসংখ্যান জানা নেই। ওপেন সিক্রেট বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে অন্যতম জাতীয় সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার কারণ কী? অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দুর্নীতি,অনৈতিকতা,স্বেচ্চাচারিতা,হিংসা,পরশ্রীকাতরতা সর্বপরি মানবিক মুল্যবোধের অবক্ষয় এর প্রাথমিক মূল কারণ।
‘ওপেন সিক্রেট’এর কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। প্রথমেই বলি-ঘুষ প্রথা। আমরা জানি বেশীরভাগ সেবা প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রাপ্তি সবার মৌলিক অধিকার।কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন-ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া অকল্পনীয়। অথচ ‘ঘুষ’ দেয়া-নেয়া ব্যাক্তি নৈতিকতা,সামাজিকতা বিরুদ্ধই নয়- আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু আমরা বাধ্য হই ঘূষ দিতে। ঘুষ দেনা-নেয়াটা এখন প্রতিষ্ঠিত ওপেন সিক্রেট। দেখুন-রাজধানীতে বিশাল বিশাল ভবন নির্মিত হবারপর মিডিয়া এবং রাজউক সমস্বরে চিৎকার করেন-অমুক ভবনের বৈধ অনূমোদন নেই! যথারিতী "কর্তিপক্ষ যথাযথ ব্যাবস্থা” নেয়ার হুংকার। ভবন মালিক হাইকোর্টে রিট করে-তারপর বহুল আলোচিত 'চেম্বার জজ' সাহেবদের ‘স্টে অর্ডার’ ফ্যাকরায় যথা পূর্বং তথা পরং!
আবার দেখা যায়-কোনো কোনো ফাঁসীর আসামী রাস্ট্রপতির ক্ষমায় 'সাধু পুরুষ' বনে যান, আবার কেউ মামলা হবার আগেই গ্রেফতার রিমান্ড ভোগ করে জানপেহচান! উদাহরণ- আলোচিত মেয়র লোকমান হত্যায় হত্যা মামলার মূল আসামীরা “বাঘাবাঘা গোয়েন্দা”দের নজর এড়িয়ে দুইমাস পর আত্মসমর্পণ করারপর নামকাওয়াস্তে একদিনের রিমাণ্ড নাটক,পরদিনই জামিন মঞ্জুর! অপরদিকে খায়রুল কবীর খোকন সেই মামলার আসামী নাহয়েও দুই পর্বে ৮ দিনের রিমান্ডসহ ১৪দিন হাজতবাস!
কেউ লক্ষ কোটি টাকার রাস্ট্রীয় সম্পদ আত্মস্বাত করেও উপদেস্টা হয়, মন্ত্রী হয়, অন্যদিকে বস্তীর টোকাই বাবুইল্লা/কুদ্দুইচ্চারা রিকশার ঘন্টি চুরি মামলায় জেলের ঘাণী টানে।একজন সিএনজি অটোর ড্রাইভার লাইসেন্স/পার্মিট পায়না-অন্যদিকে কেউ ঘরে বসেই ৫০টা সিএনজির লাইসেন্স বাগায়! একই অবস্থা রিকশার ক্ষেত্রেও। রিকশার পেছনে লাইসেন্সের যে প্লেট দেখা যায় তার ৮০ ভাগই আইনানুগ কর্তৃপক্ষের দেয়া নয়। এই সমস্ত প্লেট নানা ধরনের সমিতির। রিকশা মালিক সমিতি থেকে শুরু করে রিকশা চোর প্রতিরোধ সমিতি পর্যন্ত রিকশার নম্বর প্লেট দিয়ে থাকে। সামুতেই দেখেছি-কেউ মটর বাইকের নম্বর প্লেটে একটি ছাত্র সংগঠেরন নাম লিখেই পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে চলে! আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এইসব বিষয় দেখেও দেখেন না-যা ওপেন সিক্রেট!
এবার দেখুন ছাত্র রাজনীতি। দেশের সকল শিক্ষাংগন এখন সন্ত্রাসের পীঠস্থান। কিন্তু স্বরাস্ট্র মন্ত্রী বলেন- ১০/১২ বছরের মধ্যে দেশে এখন সব চাইতে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ভাল! সরাকারী দল সমর্থক সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠন সন্ত্রাসী ভিসির মদদে প্রতিপক্ষকে খুন করলে মামলাও হয়না। কিন্তু দৈবক্রমে একজন ছাত্রলীগ কর্মী মারাগেলেও প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের ‘চিরুনী অভিযান’ চালিয়ে ধরে যতরকম ফৌজদারী মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে রিমান্ডের নামে নাতসী স্টাইলে নির্যাতন, বিনা বিচারে আটকিয়ে রাখে আবার জেল গেইটেই একটারপর একটা মিথ্যা মামলা দিয়ে আবারও জেলে ঢোকানো হয়।
বাংলাদেশে ওপেন সিক্রেটের তালিকা করলে-সেই তালিকা হবে অফুরন্ত। ওপেন সিক্রেট দেখা না গেলেও সেগুলোর উপস্থিতি সম্পর্কে সবাই অবগত। যেমন ধরুন, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, প্রশাসনে ঘুষ-দুর্নীতি, সরকারি অর্থ লোপাট, পণ্যে ভেজাল, ধর্মের নামে অনাচার, সেকুলারিজম ও অধর্মের নামে বিশেষ একটা ধর্মের প্রতি একশ্রেনীর বিদ্বেশ সৃস্টি, চাঁদাবাজি, আয়কর ফাঁকি,র্যা বের ক্রস ফায়ার/এনকাউন্টার,নব্য সংস্করণ গুপ্ত হত্যা, গুম-সবই ওপেন সিক্রেট। খালেদা জিয়া-শেখ হাসিনা একই মামলার আসামী হয়েও একজন প্রধানমন্ত্রী আর একজন কোর্ট কাচারী করতে করতে হয়রান-এগুলোও ওপেন সিক্রেট! শেখ হাসিনা বংগবন্ধু ফাউন্ডেশনের নামে কোটিকোটি টাকা চাঁদা নিয়ে নির্দোষ কিন্তু খালেদা জিয়া “জিয়া চ্যারিটি ফান্ডে” বিদেশ থেকে ফান্ড নিয়ে এখন মামলায় শাস্তিভোগ করতে চলছেন। সবাই জানে এগুলোর রহস্য প্রকাশ্য, কিন্তু বিশয়টায় গোপনীয়তার একটা ছদ্মাবরণ থাকে। যা সবাই জেনেও প্রকাশ করতে পারেনা-সেটাই ওপেন সিক্রেট!
ওপেন সিক্রেট বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশাল মানচিত্র! এইযে আমরা সামু ব্লগে পাঠক-লেখক হিসেবে জড়িয়ে আছি-এখানেও আছে 'ওপেন সিক্রেট'! ভার্সুয়াল ওপেন প্লাটফর্ম সামুতে ভিন্নমত এবং পথের লেখক,পাঠক ব্লগার থাকবেন-সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে কেউ গালাগালি দিয়ে হয় সুশীল আবার কেউ গালাগালির প্রতিবাদে গালাগাল করে হয় জেনারেল, কমেন্টস ব্যান কিম্বা সামু থেকে আখেরী ব্যান। অথচ এই সামহোয়্যাইনব্লগ প্লাটফর্মেই অসংখ্য ব্লগারদের মানবিক-আর্থীক সহয়তায় আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শ্বাশত, রাহেলা, ব্লগার নীল আকাশের দুঃখ’র মায়ের পাশে দাড়িয়েছিলাম।ব্লগার কবির চৌধূরীর একটি লেখায় ও সামুর বদান্যতায়ই আমরা একজন জীবন্ত কিংবদন্তী সর্ব্জন শ্রদ্ধেয় আযম খানকে সম্মান জানাতে পেরেছিলাম। সামুর কতিপয় তরুন ব্লগারের উদ্যোগেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাধারন মানুষের বিবেক জাগ্রত করতে সহায়ক হয়েছিলাম, একই প্লাটফর্ম থেকে ইভ টিজিং’র বিরুদ্ধে স্বোচ্চারিত হয়েছিল এবং ব্লগার সবাকের একক চেস্টায়ই ইভ টিজিং বিরোধী আন্দোলন সকলের নজর কেড়েছিল।
সামুতে এখন কি সেই আগেরমত পারস্পরিক সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ বজায় আছে? এখন যেপরিবেশ বিরাজ করছে-তাকি আমাদেরকে আত্মীক বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারছে-নাকি সামাজিক, ব্যক্তি বিভেদ আরো প্রকট আকার ধারন করাতে উস্কে দিচ্ছে? সামু কি সকল মত ও পথের ব্লগারদের সুস্থ্য ধারার দিকে এগিয়ে নিয়ে প্রজন্মের তারুন্যশক্তি বিকশিত করতে ভূমিকা রাখতে পারছে(অবশ্য সামু দাবী করেনি-তারা জ্ঞানদানের স্কুল খুলেছেন)?এটাও ওপেন সিক্রেট-যা সকল জ্ঞানী গুণী পাঠকগনও জানেন, বোঝেন। সামুর সদস্য সংখ্যা এখন এক লক্ষ! এনিয়ে নিয়েও আমরা গর্বিত। প্রসংগত সামুর একজন তরুন ব্লগার-যিনি রম্য লেখায় সকল ব্লগারদের দৃস্টি কেড়েছেন তিনি এক লক্ষ পরিসংখ্যান নিয়ে একটি মন্তব্য করেছিলেন-“সামুতে যদি রেজিস্টার্ড নিক এক লক্ষ হয়ে থাকে তাহলে সেই একলক্ষকে কত দিয়ে ভাগ করলে সঠিক সদস্য সংখ্যা বের হবে সেটাই প্রশ্ন”!-ইহা ওপেন সিক্রেট।
এই সমস্ত ওপেন সিক্রেট সমাজকে ধংশ করেদিচ্ছে। পরিণামে মানুষের সৎ, সুস্থ, সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা অর্জনের আকাঙক্ষা নষ্ট হয়েযায়। ভাল মানুষগুলোও আস্থাহীনতায় ভুগে মানষিক কস্ট পায়। “ওপেন সিক্রেট” নামক সামাজিক এই অসুস্থ্যতা, অবক্ষয়, দুরাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কী কোন উপায় নেই? আমার ধারনা- সম্ভব। কিন্তু ছোটখাট চিকিৎসা করে এই কঠিন রোগ সারানো যাবে না। এগুলোর উতস বুঝতে হবে। কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার মূল কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং সমস্যা চিনহিত করে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। তাহলে একটা খোলামেলা সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পারস্পরিক আস্থার মনোভাব সৃষ্টিতে তা সহায়ক হবে। ব্যাক্তি,পরিবার, সমাজ,রাস্ট্রীয় সেক্টরেরমত একই কথা সামুর ক্ষেত্রেও প্রজোয্য।
ব্যাক্তি,পরিবার, সমাজ, রাস্ট্রের সকল ওপেন সিক্রেট এবং তারুন্যের বর্তমান ক্রেজ সামুকেও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ‘অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ’ থাকে না। বরং সম্ভাব্য প্রলয় তখন আরো বড় আকারে ধ্বংসযজ্ঞ সাধনের শক্তি সঞ্চয় করে। চুপচাপ বসে থাকলে সমস্যা আরো কঠিন রূপ ধারণ করবে। কাজেই এখনই সতর্ক হতে হবে।
আমাদের স্বার্থপর মনোভাব, আত্মকেন্দ্রিক জীবনবোধ, ছলনাময়, আত্মভোলা সামাজিকতা ক্রমেই পারস্পরিক সম্মানবোধ ও ভালোবাসার উপলব্ধি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর অজানায়। ফলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাস্ট্রীয় জীবনে সীমাহীন দুর্ভোগ, হতাশা ও অশান্তির বিষকল্প ছড়াচ্ছে সংক্রামক ব্যাধীরমত! সব ওপেন সিক্রেট একদিনে বিদায় করা যাবে না, এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েও ব্যাক্তি নৈতিক চরিত্রের উতকর্ষতা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিকতা, প্রশাসনিক ও কারিগরি নেতৃত্বের নিষ্ঠা ও দক্ষতা আরো বেশী সচেতনতা একত্রিত হলে যে-কোন সমস্যাই আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারব। সর্বোপরি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কঠিন সমস্যাগুলোকে দেখেও না দেখার সংস্কৃতি থেকে আমাদের যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে আসতে হবে। তেমন সুন্দর চেষ্টায় আমরা নিরলস থাকব-সেটাই হোক আমাদের কার্য্যক্রম।
ধন্যবাদ সবাইকে।