পথে প্রান্তরে-৫
চারু মজুমদারের বাড়ি
স্বাধীনতার পর আমার এক মামা(ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, মুক্তিযোদ্ধা)সিরাজ শিকদারের রাজনীতির সাথে ওতপ্রেত ভাবে জড়িয়ে পরেন এবং এক পর্যায়ে রক্ষীবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে প্রান হারান। সেই মামার সাথে আমার সুন্দর সম্পর্ক ছিল। তিনি বলতেন-শ্রেনী শক্তির বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করে দেশে সুসম সম্পদ বন্টনের মাধ্যমে ধনী দরিদ্রের ব্যাবধান ঘুঁচিয়ে সমতার ভিত্তিতে নতুন একটা বাংলাদেশ গড়বেন।মামার কাছেই আমি প্রথম জানি চেগুয়েভারা-ফিদেল কাস্ট্রো-চারু মজুমদার-কানু স্যাণ্যালদের কথা। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা-সেই মামার মাধ্যমেই একবার সিরাজ শিকদারকে স্বচক্ষে দেখা। তখন চারু মজুমদার জীবিত নেই-কিন্তু মামার কাছে চারু মজুমদার সম্পর্কে জেনে আমিও চারু মজুমদারের ভক্ত হয়ে যাই। মামা নিহত হবার পর, সিরাজ শিকদার হত্যার পরে আমার মনোজগতে সিরাজ শিকদার-চারু মজুমদারদের প্রতি সম্মানবোধ আরো বেশী বদ্ধমূল হয়। আশাছিল-যদি কোনো দিন সম্ভব হয় চারু মজুমদারেরমত কোনো বিপ্লবীর সাথে দেখা করবো। অনেক চেস্টার পরেও আর কোনো বিপ্লবীকে দেখার স্বাধ আমার পূর্ণ হয়নি। কিন্তু মাওবাদী নেতা প্রয়াত চারু মজুমদারের বাড়িটি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে।
বাংলাদেশ- ভারতের প্রথম সীমান্ত হাট শুরু হলো ২৩ জুলাই ২০১১ইং । কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলা ও ভারতের কালাইরচর সীমান্তের এপারে বালিয়ামারী সীমান্তে এই হাট উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান এবং ভারতের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা। সেই অনূষ্ঠানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টর থেকে ২৫০ জনের ব্যাবসায়ীক প্রতিনিধি দল আমন্ত্রীত অতিথি হিসেবে যোগ দেন। আমিও সেই প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলাম। এই উপলক্ষে ভারতীয় বানিজ্য মন্ত্রী ও বেজ্ঞল চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডস্ট্রীজ, অল ইন্ডিয়া চেম্বার্স ফেডারেশন সম্মিলিত ভাবে বাংলাদেশ ব্যাবসায়ী প্রতিনিধি দল থেকে যারা আমদানী ও রপ্তানী উভয় সেক্টরের এসোশিয়েশনের প্রতিনিধিত্ব করেন-তেমন ৩৪ জন ব্যাবসায়ীদের গ্রুপ ভিসায় দার্জিলিং ভ্রমনের ব্যাবস্থা করেন। আমি অনেকবার দার্জিলিং গিয়েছি তাই আমি মূল প্রগ্রামে নাগিয়ে নকশাল বাড়ি দেখার অনূরোধ জানাই। আমার সাথে আরো ৩ জন ব্যাবসায়ী একই ইচ্ছা প্রকাশ করলে "বেংগল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রীজ"-এর প্রেসিডেন্ট মুচকুন্ড সিনহালিয়া এবং "অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অব চেম্বার্স এন্ড কমার্স" প্রেসিডেন্ট রহিত মহাজনের প্রচেস্টায় আমাদের অনূরোধ রক্ষা করা হয়। আমারা ৪ বাংলাদেশীর সহযাত্রী হন- ভারতীয় একজন প্রটোকল অফিসার।
আমাদের নিয়ে টাটা সুমো জীপ গাড়িটি পাহাড়ি উচু নীচু পথ পেরিয়ে জলপাইগুড়ি পাড় হয়ে পৌঁছে মহকুমা শহর শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ির কথা পরে বলবো। একটি হোটেলে খেয়ে আরো ঘন্টা খানেক পর পৌঁছি- বিখ্যাত নকশালবাড়ি! ছোট্ট জীর্ণ একটি টিনশেড ঘর, চারু মজুমদারের বাড়ি। বাড়িতে শুধু একজন কেয়ার টেকার আছেন-যার বেতন ভাতা দেয় রাজ্য সরকার। ঘরটা খুলে দেখালেন। বেশ কয়েকটা ছবিতে চারু মজুমদার, কাণু সান্যালসহ আরো অনেকে। একটা ছবিতে আর এক কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ প্রয়াত জয় প্রকাশ নারায়ন।
ভারতবর্ষ-কাঁপানো মাওবাদী আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার একদা-অখ্যাত গ্রাম নকশালবাড়ি।সেখান থেকেই তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতে। এখনো মাওবাদী আন্দোলন চলছে বিশাল ভারতের ১২টি রাজ্যে। মাওবাদীরা জঙ্গলমহলসহ ভারতের বেশ কিছু এলাকায় নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ দিলেও উৎসভূমি নকশালবাড়িতে তার ছায়াটিও নেই। সেই বিপ্লবের গৌরব হারিয়ে নকশালবাড়ি এখন পশ্চিমবঙ্গের আর দশটি মফস্বলী জনপদেরই একটি। অন্যত্র যা-ই ঘটুক, নকশালবাড়ি গ্রামে চারু মজুমদারের বিতর্কিত আদর্শের ঝান্ডা তুলে ধরার মানুষ এখন নেই বললেই চলে। নেপালের সীমান্তঘেঁষা এই জনপদেই ষাটের দশকের শেষ দিকে ভারতের প্রথম সশস্ত্র কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন বিপ্লবী চারু মজুমদার।
নকশালবাড়ির আদি বাসিন্দা মূলত রাজবংশীরা। ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলে চা-বাগান তৈরির হিড়িক পড়ে। এলাকার জোতদারেরা চা-বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে আসে সাঁওতালিদের। বিহার, ওডিশা ও মধ্য প্রদেশ, পাশের দেশ নেপাল থেকেও আসে শ্রমিক। বাগান মালিকরা ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করত শ্রমিকদের। বঞ্চিত শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যে দার্জিলিং থেকে নকশালবাড়িতে চলে আসেন চারু মজুমদার। সংগঠিত করেন সশস্ত্র বিপ্লব। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে-তুংয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তিনি ১৯৬৭ সালে শুরু করেন সংগ্রাম। সে বছরের ২৪ মে আদিবাসীদের নিয়ে জমি দখলের সংগ্রামের সূচনা করেন। চারু মজুমদারের বিপ্লবের এই তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা পশ্চিমবঙ্গে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী দীক্ষিত হন বিপ্লবের মন্ত্রে। পশ্চিমবঙ্গের পথে পথে আওয়াজ ওঠে—‘লাঙল যার, জমি তার’, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’, ‘নকশালবাড়ির পথ বিপ্লবের পথ’, ‘একটি স্ফুলিঙ্গই দাবানল সৃষ্টি করে’- ইত্যাদি।
শিলিগুড়িতে চারু মজুমদারের একটি কাঠের বাড়ি আছে।এই বাড়িতেই থাকেন তাঁর দুই মেয়ে অনিতা মজুমদার, মধুমিতা মজুমদার ও একমাত্র ছেলে অভিজিৎ মজুমদার। সঙ্গে থাকেন চারু মজুমদারের ছোট বোন। ছেলে অভিজিৎ মজুমদার একটি বেসরকারী কলেজের শিক্ষক। তাঁর সঙ্গে কথা হয় শিলিগুড়িতেই। তাঁদের আদিবাড়ি ছিল রাজশাহীতে। একপর্যায়ে পূর্বপুরুষেরা চলে আসেন শিলিগুড়ি। ডিএল রায় রোডের এই বাড়িটি চারু বাবুই করেছিলেন।
আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা চারু মজুমদারকে ১৯৭২ সালের ১৪ আগস্ট পুলিশ কলকাতার একটি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। বিচারাধীন অবস্থায় ১৯৭২ সালের ২৮ আগস্ট কলকাতার পিজি হাসপাতালে তিনি মারা যান বলে সরকারি ভাষ্য।কিন্তু অভিজিত জানালেন-"বাবা পিজি হাসপাতালে মারা যাননি। তাঁকে লালবাজার পুলিশ লকআপে পিটিয়ে মেরেছে। তার পর পিজি হাসপাতালের গল্প ফেঁদেছে।"চারু মজুমদারের আদর্শকে হঠকারিতা বলে সমালোচনা করেছেন অনেকেই। কিন্তু তাতে সেই আদর্শ ভারতের দিকে দিকে ছড়িয়ে যাওয়া থেমে থাকেনি।
অভিজিৎকে প্রশ্ন করি-নকশালবাদ আজ কেন এবং কোন প্রক্রিয়ায় নকশালবাড়ি থেকে নির্বাসিত? আদর্শ ধরে রাখায় চারু মজুমদারের উত্তরসূরিদের ব্যর্থতাকে তিনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
অভিজিৎ বলেন-"রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে আমাদের নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন। দলীয় কাঠামো ভেঙে গিয়েছে। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ২১ সদস্যই রাস্ট্রীয় হত্যার শিকার। অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলে পুরে রাখা হয়। ফলে আমাদের রাজনীতি হোঁচট খায়।"
পিতার আদর্শ থেকে নিজে এখনো বিচ্যুত হননি অভিজিৎ। তিনি সিপিআইয়ের (লিবারেশন) কেন্দ্রীয় ও রাজ্য কমিটির সদস্য এবং দার্জিলিং জেলা কমিটির সম্পাদক।
নকশালের আরেক বড় বিপ্লবী নেতা কানু সান্যালও এখন বেঁচে নেই। রোগে ভুগে ২০১০ সনের ২৩ মার্চ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে তিনি নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন। নকশালবাড়ি থেকে ফেরার পথে যাই কানু সান্যালের বাড়ি শিবদালা গ্রামে। তাঁর বাড়িতে মাটির দেয়াল আর টিনের ছাউনির একটি ঘর। এ বাড়িতেই মৃত্যু হয়েছিল কানু সান্যালের।
নিমানূযায়ী এখানে যেকোনো বিদেশীরা এলেই স্থানীয় থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। এখানকার থানার নাম- নকশালবাড়ি থানা। সাথে সরকারি প্রটোকল থাকলেও থানায় হাজিরা দিতেই হবে। থানায় পূলিশ অফিসার আমার আগমন হেতু যেনে-সন্ধিগ্ধ চোখে কয়েকবার আমাকে দেখলেন! আমি ড্যাম কেয়ার ভাব দেখিয়ে কথা বলি পুলিশ অফিসারের সাথে। পুলিশ অফিসার প্রসুন খেরা জানালেন- নকশালবাড়ি এখন সম্পূর্ণ শান্ত। শিবদালা গ্রামে গুটিকয়েক সমর্থক থাকলেও তারা সক্রিয় নেই। ফলে এখানে নকশালবাড়ির আন্দোলন নিভেই গেছে।
নাইবা থাকুন আমার স্বপ্নের বীর কমরেড চারু মজুমদার, নাইবা থাকুক তাঁর আদর্শের সৈনিক। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে একজন সাধারন মানুষ, চারু মজুমদারের একজন ভক্ত তাঁকে সম্মান জানাতে এসেছি বাংলাদেশ থেকে-এটা আমার অহংকার।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:২৬