এতকাল যা ঘরে-বাইরে সবার চোখের আড়ালে ছিল, গোপনে গোপনে যেমন চলছিল, এ ঘটনার ভেতর দিয়ে সামনের দিনগুলোতেও নিশ্চিন্তে দায়হীনভাবে চালিয়ে যাবার সম্ভাবনাটা নষ্ট হয়ে গেল। কোনো কোনো কাজের দায় এমনই ভারী আর বিশাল হয় যে, তাতে লেগে থাকতে গেলে সমাজ আর পরিবারের কাছে তো ছোট হতেই হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বন্ধু মহলেও হাস্যাস্পদ হতে হয়। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সুশান্ত মল্লিক তার নিজের মাথার চুলহীন অংশটায় আস্তে ধীরে হাত বোলাচ্ছিল।
জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘিঞ্জি ঢাকা শহরের অসম্পূর্ণ বিল্ডিংগুলোর নোংরা চেহারা পর্যবেক্ষণ করতে করতে এক সময় নিজের ভেতরেই যেন নিমজ্জিত হয় সে।
পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু আগালেও কোথাও যেন খানিকটা ভুল থেকেই গিয়েছিল। যশোরের পার্টিটা আগাম পেমেন্ট করলেও শেষ মুহূর্তে অর্ডার বাতিল করে নিজেকে গুটিয়ে নেবে এমনটা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি সে। টাকাটা পেয়ে যেতেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, পার্টিকে পুরো টোপটাই গেলানো গেছে। কেবল ট্রান্সপোর্ট নিয়ে ঝামেলার সন্দেহটা ছিল। আগেও এ নিয়ে আলাপ হয়েছিল। তবু ধরে নিয়েছিল কোনো রকমে ভুজুং ভাজুং দিয়ে মানিয়ে নেবে। কিন্তু তাই বলে পুরো অর্ডারটাই বাতিল! যার মানে পুরোপুরিই মাথায় হাত। এখন এমন প্রায় বাতিল মাল নিয়ে কী করবে সে? কাউকে গছানোর যে সম্ভাবনা ছিল, এখন সে আশাও শূন্য হয়ে গেছে।
কেন যে, বৃথা নেয়ামত উল্লাহর পক্ষে দালালীটা করতে গিয়েছিল সে। এমন তো না যে, নেয়ামত উল্লাহ তাকে বিশাল লাভ জনক কিছু একটা করে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে দুজনে লুকিয়ে চুরিয়ে গেস্ট হাউজে মৌজ-স্ফূর্তি করতো। খরচাপাতি বলতে নেয়ামত উল্লাহর এক পয়সাও লোকসান হয়নি কখনো। বরং এটা ওটা নানা অজুহাতে অনেক কিছুই হাতিয়ে নিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে নেয়ামত উল্লাহ তার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নেয়ামত উল্লাহর রদ্দি মাল নিয়ে তো নিজের গুদামে তুলতে পারবে না। সেখানে ভালো ব্রান্ডের মাল স্টক করা আছে আগে থেকেই। আরেকটা গুদাম ভাড়া নিলেও নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে। অনেক ভেবেচিন্তে সুশান্ত মল্লিক যার মাল তার গোডাউনেই ফেলে রাখতে মনস্থ করে। যা হবার হয়েছে। মাঝখান দিয়ে তার ভালো রকম কানমলা হয়ে গেছে একটা। বেঁচে থাকতে কারো জন্যে এমন দরদ দেখাতে যাবে না আর।
একদিক দিয়ে নেয়ামত উল্লাহর পার্টির বাতিল মালের ভর্তুকি বাবদ পুরোটা টাকাই দিতে হবে তার নিজের গাঁট থেকে। তা ছাড়া মাসে মাসে গুণতে হবে গুদাম ভাড়াও। রুমে এসি চালু থাকলেও তার শরীরে মিহি ঘাম ফুটে উঠতে আরম্ভ করেছে। একটা টিসু দিয়ে গলার কাছটা মুছে নিয়ে টেবিলের ওপর থেকে ক্যালকুলেটরটা তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ টেপাটেপি করে একটি দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় আছড়ে ফেলে টেবিলের ওপর। মনে মনে একটি নোংরা গালি দিয়ে বিড়বিড় করে বলে, এই শালার সঙ্গে কায়-কারবারে জড়িয়ে দিনদিন কেবল লুজার হচ্ছি!
পুরোনো ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে পলিসি বদলে পড়েছে আরেক যন্ত্রণায়। এখন নতুন নতুন পার্টি খুঁজে বের করতে নানা জেলায় ছুটোছুটি করে প্রাণ যায় যায় দশা। সেদিন তো আর একটু হলেই মারাই যাচ্ছিল। ভাগ্যিস পুরোটা রাস্তায় নিজে ড্রাইভ করেনি। দীর্ঘ পথ বলে মতিকে সঙ্গে নিয়েছিল। কুমিল্লার বিরতিতে দুজনে খেয়ে বের হয়ে আসতেই মতি বলেছিল, সার আপনে পিছনে গিয়া জিরান। আমি স্টিয়ারিঙে বসি।
এই বলে গাড়িটা স্টার্ট দিয়েই হয়তো যাদু দেখানোর শখ হয়েছিল তার। যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে গাড়িটা। ফেনী পার হতেই বাঁশ ভর্তি একটি ট্রাকের পেছনে ঢুকে গেল আচমকা। সেই সঙ্গে বল্লমের ঘাই হয়ে উইন্ড-শিল্ড ভেঙে তার বুক এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিয়েছে একটি বাঁশের সরু মাথা।
মতির বাপের সঙ্গে আপস রফা, গাড়ির মেরামত, থানা ম্যানেজ করা সব মিলিয়ে তার পাগল পাগল লাগছিল। এখন নয়া উপদ্রব হয়ে গলায় আটকেছে নেয়ামত উল্লাহ। শেষ পর্যন্ত নেয়ামত উল্লাহর কারণেই কিনা পথে বসতে হয় তাকে। চাচা আপনা জান বাঁচা। ভাবতে ভাবতে তার ঘামের পরিমাণও যেন বেড়ে গেল। পিঠের আর পেটের দিকে সার্টের অংশ ভিজে লেপটে গেছে শরীরের সঙ্গে। আর তখনই সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সব দিক দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে হলে নেয়ামত উল্লাহর সঙ্গ ছাড়তে হবে।
হঠাৎ ফোনটা তুলে নিয়ে একটি নাম্বারে রিঙ দিয়ে প্রায় ফিস ফিস স্বরে বলল সুশান্ত মল্লিক, মতিন খালাসীর রেট কত রে?
(সমাপ্ত)
উৎসর্গ: বইঞ্জান (রাবেয়া রব্বানি)।