এক.
১৮ এপ্রিল। বিকাল পাঁচটা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরছিলাম। ক্লাশ শেষ হয়েছিল দুপুরের দিকেই। আড্ডা দিতে দিতে বিকেল হল। টিএসসি থেকে রিক্সা নিলাম। আমি আর আমার বন্ধু সামি। দু'জনের বাসা কাছে হওয়ায় একসাথে যাওয়া হয়। রিক্সা নিয়ে বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। রিক্সাওয়ালা বাংলা একাডেমির দিকে হাত তুলে জিজ্ঞেস করে, "মামা এই মেলা কতদিন চলবে?"
আমরা আসলে জানি না বাংলা একাডেমীতে কি মেলা হচ্ছে। এখনতো এপ্রিল। ফেব্রুয়ারি না। তবে কিছু একটা হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম। জানি না দেখে আমরা দু'জনেই চুপ করে রইলাম।
এরপর রিক্সাওয়ালা আবার বলল, "মামা, আমার এখান থেকে একটা বই কেনার শখ। আমি পহেলা বৈশাখের সময় বাড়িতে ছিলাম বই কিনতে পারি নাই। তবে বৈশাখ নিয়া একটা কবিতা লিখছি।"
আমি বুঝতে পারলাম না কি বলব! কি বলে এই লোক? সামি আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা না শোনে মত শব্দহীন হাসতে লাগল। একটু পর লোকটা কবিতার মত কি যেন অনবরত আওড়ে যাচ্ছিল আর আমরা তার পিছে বসাতে কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
সামি পল্টন নেমে গেল। আমি আরাম করে রিক্সার মাঝখানে বসলাম আরামবাগ যাব বলে।
ঠিক নামার কিছুক্ষণ আগে রিক্সাওয়ালা আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, "মামা শুনবেন আমার লেখা কবিতা?"
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ শোনান।
তিনি কবিতাটা আবৃত্তি করে শুনালেন। অপূর্ব! আমি নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে একটা রিক্সাওয়ালা এত ভাল আবৃত্তি পারে। আর কবিতার লাইনগুলোও ছিল অসাধারণ!
তার কবিতার দুইটা কথা মনে আছে শুধু, যা সে কবিতা আবৃত্তি করার সময় আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছি,
একটা হল - "আমি ক্ষুধার্ত গোলাপের মত ডেকেছি তোমায়",
আরেকটা হল - "সূর্য মলিন হয় তোমার ছায়ায়..."
এ দুইটা লাইন শুনে আমি তাকে বাহবা দিয়ে বলেছিলাম, "আপনিতো অনেক সুন্দর লিখেন!"
তিনি হাসলেন। এরপর বললেন, "মামা, আমি টিএসসিতে আবৃত্তির একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম, কিন্তু উচ্চারণে একটু সমস্যা ছিল তাই বাদ পড়ে গেছি।"
শুনে খারাপ লাগল। এরপর রিক্সা থেকে নেমে তাকে অনেক উৎসাহ দিলাম। বললাম, "আপনার মধ্যে যে প্রতিভা আছে তা নষ্ট হতে দিবেন না। চালিয়ে যান। লিখতে থাকুন। মনে রাখবেন, অনেক কবির জীবদ্দশায় তাদের লেখা প্রকাশিত হয়নি। চিন্তা করবেন না। লিখতে থাকুন।" কথাটা শুনে তিনি খুশি হলেন।
পরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম এটা নিয়ে। আতিক নামের একজন বলেছিলেন যে, একজন রিক্সাওয়ালা আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, তার নাম রাজ্জাক। যিনি অনেক ভাল আবৃত্তি পারেন। আতিক নাকি টিএসসির ঐ প্রতিযোগিতায় দর্শক হিসেবে ছিলেন এবং উনার আবৃত্তি শুনেছেন। আতিক আরো বলল, প্রতিযোগিতার বাইরেও রাজ্জাকের সাথে তার কথা হয়েছে কয়েকবার এবং আতিক তার নাম মনে রেখেছে দেখে তিনি নাকি অনেক খুশি হয়েছিলেন।
দুই.
ফয়সাল খন্দকার রুবেল নামের একজন বলছিলেন, একদিন তিনি একজন রিক্সাওয়ালার দেখা পেয়েছিলেন। যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছিলেন। পরে তিনি নাকি একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন কিছুদিন। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে উনার কাঁধে অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হলে তিনি পালিয়ে বেড়ান এবং রিক্সাওয়ালার বেশ ধারণ করেন। খুব খারাপ লাগল শুনে।
এরকম আরো কিছু অজানা প্রতিভাবান মানুষের কথা নিয়ে এই পোস্ট চালিয়ে যেতে চাইছি। তাই পোস্টের শুরুতে "প্রথম পার্ট" লেভেল দিয়েছি।
বাকীগুলো নিয়ে আসছি শীঘ্রই...
হেলায় পড়ে থাকা প্রতিভাবান ও মেধাবীদের গল্প (দ্বিতীয় পার্ট)
হেলায় পড়ে থাকা প্রতিভাবান ও মেধাবীদের গল্প (তৃতীয় পার্ট)