এমন একটা পোষ্ট দিচ্ছি, যাতে অনেকগুলো ঘটনার যোগসূত্র মেলাতে হবে এবং সময়ের ব্যপ্তিকাল ৪০০শত(১৬০৫-বর্তমান) বছর। তো, সেই ৪০০বছর পূর্বে এমন কি হয়েছিল, যার ধারা এখনো অব্যাহত?? এক্ষেত্রে আমরা অতীত থেকে শুরু না করে বরং বর্তমান থেকেই ধীরে ধীরে অতীতে ফিরে যাব।
প্রথমেই আমাদের সবার পরিচিত, ব্লগে এবং ফেসবুকে অনেকের প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহৃত একটি মুখোশের বর্ণনা দিয়ে শুরু করছি।
ইতিপূর্বে চলচিত্রে, নেটের নানা জায়গায় এই মুখোশটি চোখে পড়লেও সবার মাঝে খুব একটা সাড়া পড়েনি, একটা সুন্দর সাধারণ মুখোশ হিসেবেই ভেবে এসেছি সবাই। কিন্তু ‘আমরা যখন হ্যাকার হলাম’ , মানে ভারতের সাথে যখন আমাদের সাইবার যুদ্ধ শুরু হল; এই মুখোশটি তখন থেকেই যেন এক ভিন্ন মাত্রা ধারণ করল। বিশ্বখ্যাত হ্যাকারগ্রুপ ‘অ্যানোনিমাস’ যখন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বলে একটি ইউটিউব ভিডিও প্রচার করা হোল, সবার মাঝে এই মুখোশটি হয়ে উঠল মনোবলের প্রতীক; যেটি হয়তো সমাজের চোখে বৈধ নয় কিন্তু অশুভ শক্তির ভয়ঙ্কর যম এই মুখোশ। সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠল ‘অ্যানোনিমাসের মুখোশ’ হিসেবে।
এরই মাঝে যাদের বিখ্যাত চলচিত্র ‘V for Vendetta’ দেখা ছিল, তারা স্মরণ করল রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দুর্ধর্ষ এক শক্তিকে; যে ঝাপসা স্ক্রিনে একের পর এক ভয়ঙ্কর হুমকি দিয়ে যাচ্ছে আর যেভাবেই হোক সেগুলো সম্পন্ন করছে।
আসলে এটিকে ‘মাস্ক’ বা ‘মুখোশ’ না বলে ‘এফিগি’(Effigy) বলাই উত্তম। সাধারণ অর্থে মুখোশের অন্তরালে মূর্তিসদৃশ ব্যক্তিকে ‘এফিগি’ বলা হয়। গির্জার মূর্তিগুলোও এই নামে ডাকা হয়।
‘V for Vendetta’ কমিকস
আমাদের আলোচ্য এই এফিগি’র জন্ম হয় ১৯৮২সালে, যখন কমিক লেখক এলান মুর ‘V for Vendetta’ গল্পটি লেখা শুরু করেন এবং কমিক আঁকিয়ে ডেভিড লয়েড জন্ম দেন এই বিখ্যাত ‘এফিগি’ বা মুখোশটির। আর সেই থেকে ‘V’ এর মুখোশটি যুক্তরাজ্যের ‘Bonfire Night’ (৫ই নভেম্বর) এ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেই হিসেবে এই মুখোশটির নাম ‘গাই ফকস মাস্ক’(Guy Fawkes)।
সেই ১৮শতক থেকে ইংল্যান্ডের ছোট বাচ্চারা বছরের ৫ই নভেম্বর মুখোশ পড়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দেয় আর চকোলেট, টাকা-পয়সা তোলে। একই সাথে পুড়ানো হয় আতশবাজি। তো কি কারণে এই Bonfire Night এবং কে এই গাই ফকস, তা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েকশ বছর।
বনফায়ার নাইট
পুরো ১৬শতক জুড়েই ইংল্যান্ড রাজনীতি আর ধর্মের সংঘর্ষে ছিল উত্তাল। প্রথাগতভাবেই ইংল্যান্ড স্পেন আর ফ্রান্স কেন্দ্রিক পোপের বিরোধী ছিল। কিন্তু সমাজের উঁচুস্তরে রোমান ক্যাথোলিক, প্রটোস্ট্যান্ট দুই জাতের রাজনীতিবিদরাই থাকত। একারণে কখনো তাদের সহায়তায় কুইন মেরি বা ব্লাডি মেরি এসে প্রটোস্ট্যান্টদের নিধন করেছে আবার পরমুহূর্তেই তার বোন এলিজাবেথ এসে প্রটোস্ট্যান্টদের তাদের হারানো ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছে, ফলে ক্যাথোলিকরা হয়েছে বিতাড়িত। এমনই আভ্যন্তরীণ সঙ্কটের মধ্যে ইংল্যান্ডের ক্ষমতায় আসে স্কটিশ রাজা জেমস I। পারিবারিকভাবে রক্তের সম্পর্ক থাকা ছাড়াও নিঃসন্তান রাণী এলিজাবেথের মনোনীত উত্তরাধিকারী ছিলেন জেমস। রাজার শাসন ছাড়াও পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তখন ইংল্যান্ডের রাজনীতিতে।
স্বভাবতই গোঁড়া ক্যাথোলিকরা এটি নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট ছিলনা। তারা পুনরায় তাদের হৃত ক্ষমতা উদ্ধারে প্ল্যান করতে লাগল।
কিং জেমস I
এরই মাঝে ক্যাথোলিক গাই ফকস স্পেন রাজার অধীনে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে দেশে ফিরে এল। মনেপ্রাণে গোঁড়া ক্যাথোলিক সে, পরিচিত হল তারইমত আরেক কট্টর মনোভাব পোষণকারী টমাস উইন্টোউর এর সাথে। নানা জায়গায় ঘুরে বিভিন্ন জনের সাথে মিলিত হল তারা এবং দলে ভারী হতে থাকল। ১৬০৪সালের মে মাসে টমাস পরিকল্পনা দেয় ইতিহাস বিখ্যাত ‘Gun Powder Treason’ এর, উদ্দেশ্য রাজাসহ পার্লামেন্টের সদস্যদের বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়া হবে; আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় গাই ফকসের উপর। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার পরিকল্পনা সম্ভবত এটিই; চিন্তা করে দেখুন যদি ২০০১ এর টুইন টাওয়ারে হামলা না চালিয়ে আমেরিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসে হামলা চালিয়ে বুশসহ সবাইকে হত্যা করা হত, তাহলে আরও কত ভয়ঙ্কর হত সেটি।
গাই ফকস
তো যাই হোক, এই উদ্দেশ্যে ১৬০৫এর মার্চে পার্লামেন্ট ভবনের নীচেই একটি সেলার ভাড়া নেয় তারা; বলা হয় সেখানে 'আলু' মজুদ করা হবে। দলের অন্যদের সহায়তায় ৩৬ব্যারেল গান পাউডার এনে মজুদ করে গাই ফকস। মাঝে কিছু ব্যারেলে বারুদ ভিজে গেলে, সেগুলো পাল্টে আবার নতুন ব্যারেল নিয়ে এল ফকস। এরপর সবকিছু পরিকল্পনামতই এগুচ্ছিল। ঘটনার ৫দিন আগেও অক্টোবরের ৩০তারিখ ফকস সেলারে গিয়ে সব পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট মনে ঘরে ফিরে এল।
১৮শতকের ওয়েস্টমিনিস্টার পার্লামেন্ট ভবন
কিন্তু এর পরেই ঘটনা পাল্টে গেল, এক ক্যাথোলিক জমিদার মন্টিআগলে’র কাছে হঠাৎ করে একটি চিঠি পৌঁছাল, উল্লেখিত দিনে তাকে পার্লামেন্ট ভবন হতে দূরে থাকার অনুরোধ করা হয়েছে সেই চিঠিতে। সেই চিঠি মন্টিয়াগলে পৌঁছে দিল রাজার কাছে। চিঠি পেয়ে সাথে সাথে শুরু হল ব্যাপক অনুসন্ধান। এদিকে ক্যাথোলিকরাও সবাই মিলিত হল; তারা সিদ্ধান্ত নিল, যেহেতু এখনো তাদের প্ল্যান ফাঁস হয়নি, তাই পরিকল্পনা বহাল থাকবে। এদিকে সার্চ পার্টি খুঁজতে খুঁজতে সেলারে পৌঁছে গেল কিন্তু সেখানে উপস্থিত ফকসে’র মাঝে সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে ফিরে গেল। উদ্বেগ বাড়তে লাগল, অধিবেশনের আগের দিন রাতে টহল আরও বাড়ানো হল এবং তল্লাশি চলতে থাকল। ১৬০৫এর ৪ঠা নভেম্বর রাতে টহলদল যখন আবারো তল্লাশি চালাতে এল, তখনি আবিষ্কৃত হল যে ব্যারেলের ভিতর বারুদ ঠাসা আছে। ব্যস আর যায় কোথায়, সাথে সাথে পাকড়াও করা হল গাই ফকস’কে। ধরে নিয়ে ব্যাপক জেরা করা হল তাকে, ক্যাথোলিকদের গোপন আস্তানায় অভিযান চালানো হল। অনেকে ধরা পড়ল, অনেকে গুলাগুলিতে মারা পড়ল।
ফকস’কে বন্দী রেখে বিচার করা হল এবং ১৬০৬এর ৩১শে জানুয়ারি অন্য সহযোগীদেরসহ ফকস’কে ঝুলিয়ে দেওয়া হল ফাঁসিতে। উপস্থিত জনতা উৎফুল্লস্বরে এই দৃশ্যকে স্বাগত জানাল।
কিন্তু এই ভয়াবহ পরিকল্পনা মানুষের মাঝে চির-স্মরণীয় হয়ে থাকল এবং এর বহু বছর পর তাদের ধরা পড়ার সেই দিনটি(৫ই নভেম্বর) রাষ্ট্রীয় উৎসবের দিনে পরিণত হল ইংল্যান্ডে। ভয়ঙ্কর সব মুখোশের আড়ালে থেকে তারা স্মরণ করত গাই ফকস’কে, এরই ধারাবাহিকতায় বাজারে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণটি হল ‘V’ বা অ্যানোনিমাসের এই বিখ্যার এফিগি। আর কারও যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় আফসোস হয়, তাহলে 'V for Vendetta' এর শেষ দৃশ্যে পার্লামেন্ট ভবন উড়িয়ে দেবার দৃশ্যটি দেখে নিতে পারেন ।
ইতিহাসটি আপনাদের সাথে শেয়ার করে ভালো লাগল, আপনারাও আশা করি পড়ে জানাবেন, কেমন লাগল?
বিদ্রঃ আর সবার মত আমিও আমার প্রিয় লেখকের মৃত্যুতে শোকাহত। আমার এই লেখাটি তাই প্রিয় লেখক ‘হুমায়ুন আহমেদ’কে উৎসর্গ করলাম। তবে, যিনি আমাদের জন্য শত শত বইয়ের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার রেখে গেছেন, সামনে উনার জন্য একটা পোষ্ট হলেও দিব। আল্লাহ উনার আত্মাকে শান্তি দিক।
সুত্রঃ
View this link
View this link
View this link
View this link
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ৯:২৭