গভীর নীল সাগর যখন হাসের ডিমের কুসুমের মত সূর্যটাকে নিয়ে সকলের চোখের আড়ালে লোফালুফি খেলছে,—লঙ্কার পথে সদ্য ঊষার আলোক তেরছা হয়ে নেমে আসছ্-এমন সময় শান্ত লঙ্কায় ভয়ানক জোরে বেজে উঠল দগড়,কাহাল,ঘন্টা,মৃদঙ্গ,ঝাঁঝরি,কাঁসী,করতাল,দণ্ড,মহরী,ভোরঙ্গ,ডম্ফ,শিঙ্গা –একযোগে।লঙ্কাবাসীর বুক দুরুদুরু করে উঠল।নগরের বাইরে প্রতীক্ষমাণ সেনাদের কয়েকজনের চোখে তখনও তন্দ্রা জড়িয়ে,-তারা এই বাজনা শুনে ধরমর করে উঠে বসল।রামের সেনারা সকলেই পদাতিক,পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করবে,কিন্তু তাদের রণ-কৌশল অন্যরকম।অনেকেই গাছের উপরে আড়ালে বসে প্রাচীরের ভিতরে তির ধনুক তাক করে বসে রইল-- নগরীর মধ্যে বেরিয়ে পড়ল শোভাযাত্রার মত হাতি-ঘোড়া সমে্ত রাবণের সেনারা।প্রথমদিনের যুদ্ধ-ঘোষণার আদেশ দিয়ে রাবণ ডেকে পাঠালেন প্রিয় ছেলে ইন্দ্রজিৎকে।—ইন্দ্রজিৎকে সেদিনের যুদ্ধের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দানের কথা বলে-তিনি বলেন—বাবার মুখ রেখ। ইন্দ্রজিৎ আশীর্বাদ নিয়ে বলে,- তুমি চিন্তা কোর না বাবা,এদের থামাতে কয়েক মুহুর্ত মাত্র লাগবে ।
চারিদিকে বিপক্ষ দলের অস্ত্রের শব্দ শোনা গেল।আড়াল থেকে যুদ্ধ করায় রামের সেনা তুলনামূলক কম আহত হচ্ছিল।ঘোড়ার উপর বসে বাইরে থেকে ধেয়ে আসা তীরের আঘাতে অনেক হতাহত হল রাবন সেনারা।ইন্দ্রজিৎ যুদ্ধের মাঠে এসে পুরো বিষয়টা বুঝে নিল প্রথমে ।দিকে দিকে যুদ্ধ চলছে—হতাহত বেড়ে চলেছে-্রামের সেনাপতি সম্পাতির কাছে রাবন সেনাপতি প্রচণ্ড মারা গেল।হাতির পিঠে বসা সেনা তপনের চোখে বাণ মারলে নীল।রথে যুদ্ধকারী বিদ্যুৎমালিকে হনুমান পরাজিত করলে। শুষেন ও তার দুই ছেলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে এল রাবনের সেনাদের আক্রমনে। যুদ্ধ বেলা বাড়তে বাড়তে প্রবল হয়ে উঠছিল।এই বানর নামক জাতিরা যুদ্ধ কৌশলে অত্যন্ত উন্নত-কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদের সঙ্গে লঙ্কার কোনও বিরোধ নেই।রাবনের ছেলে ইন্দ্রজিৎ ভাবল,যাদের সঙ্গে আসল যুদ্ধ,তাদের মারলেই এই নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যু বন্ধ করা যাবে—ইন্দ্রজিৎ খুঁজতে লাগল—রাম ও লক্ষ্মণকে।
তারা একটু পিছনেই ছিল,ইন্দ্রজিৎ রাম-লক্ষ্ণের উদ্দেশ্যে এক ঝাঁক বিশেষ ধরনের বাণ ছুঁড়ল—অব্যর্থ লক্ষ্যে রাম ও লক্ষ্মণ প্রবল আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেল—তাদের শরীরে কোথাও অক্ষত জায়গা নেই—নিশ্চিত মৃত্যুর পথে পাঠিয়ে ইন্দ্রজিৎ ফিরে গেল লঙ্কা রাজপুরে—আশা করা যায় ,যুদ্ধ শেষ হয়েছে।
রাম-লক্ষ্মণের পরাজয়ের খবর নিমেষে ছড়িয়ে পড়ল সুগ্রীব ও তার সেনাদের মধ্যে—সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজাকেই,কিন্তু কী সিদ্ধান্ত? দেশের থেকে এতদূরে চলে এসেছিল তারা,লঙ্কার রাজা হিসেবে বিভীষণকে মেনে নিয়ে একটা চুক্তিও হয়েছিল,এই অবস্থায় কিই বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে! যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়ে রাম-ও লক্ষ্মণকে ঘিরে সমবেত হল সমস্ত সেনারা-- ইন্দ্রজিৎ রাবণকে গিয়ে প্রনাম করে জানালেন ,রাম ও লক্ষ্মণ পরাভূত হয়েছে,নাগপাশের বাঁধন রাতে আরও চেপে বসবে শরীরে ,পরের দিন সকাল হওয়ার আগেই তারা মারা যাবে--
রাবণ যুদ্ধ জয়ের চেয়েও অন্য কিছু জয়ের আশা করল,সঙ্গে সঙ্গে ত্রিজটা দাসীকে ডেকে পাঠাল রাজসভায়।ত্রিজটা এলে ,তাকে বলল,যাও ত্রিজটা,আমার পুষ্পক রথে চড়ে তুমি আর সীতা দুইজনে দেখে এস যুদ্ধ ক্ষেত্র।ক্ষত্রিয়ের নিয়ম কানুন আমার জানা নেই—সীতাকে নিজে চোখে দেখে,নিজেকেই সব পালন করতে হবে।রাম-লক্ষ্মণ না থাকলে একা একা বিধবা সীতা তো অযোধ্যায় ফিরতে পারবে না কখনও!
ত্রিজটার সঙ্গে গিয়ে সীতা দেখে এল রাম-ও লক্ষ্মণ মাটিতে লুটিয়ে—তাদের দেহ রক্তাক্ত,কিন্তু সমস্ত শরীরে এমন একটা বাঁধন পড়েছে,যা কিছুতেই খোলা যাবে না।যতই সেই দড়ি খোলার চেষ্টা করবে আহতকে তা আরও চেপে বসবে।সমস্ত বানর সেনারা দিশাহারা অবস্থায় বসে—সীতা নিজের চোখে দেখে ভেঙ্গে পড়ে—হায় তার নিজের মাতৃভূমি,শ্বশুড়ভূমি—কোনওদিন আর কারো সঙ্গে দেখাও হবে না—হায় রাম!
ওদিকে দেবতারা কিন্তু পুরো যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে খেয়াল রাখছিল।এরা খুব ভালো যোদ্ধা ছিল না,প্রায়ই নিজেদের রাজ্য অন্যেরা কেড়ে নিত,এদের রাজাকে বলা হত ইন্দ্র।তাই দরকার হত অন্রাযের সাহায্মযের ও রাজনীতির-লক্ষ্মণের মৃত্যুর খবর পেয়ে ইন্দ্র চিন্তায় পড়ে গেল।রাবনের ছেলের নাম ছিল মেঘনাদ,কিন্তু সে ব্যাটা ,ইন্দ্রকে হারিয়ে নিজের নামই রেখে দিয়েছে ইন্দ্রজিৎ।নামটা শুনলেই ইন্দ্রের পিত্তি জ্বলে ওঠে,এছাড়া রাবনও খুব বীর—চাইলে যেকোনও দিন স্বর্গ দখল করতে পারে,কাজেই দুর্বল প্রতিপক্ষগুলি এক হয়ে যদি রাবনকে হারাতে পারে ,ইন্দ্র সেটাই চাইছিল।রাম-লক্ষ্মণের মৃত্যু হলে রাবনের তেজ আরও বাড়বে—তাই ইন্দ্রই তখন গরুড় নামে এক দেবতাকে পাঠালে ওই নাগপাশের কঠিন বাঁধন খুলে রাম-লক্ষ্মণকে বাঁচানোর জন্য।েই বাঁধন খোলা খুবই কঠিন,গরুড় ছাড়া কেউই পারত না
রাম মৃত্যু আসন্ন জেনে সুগ্রীবকে বলছে—সুগ্রীব,আমি বালিবধের পাপ করেছি বলেই হয়ত আজ এই দশা হল,তুমি আমার ভাই ও মায়েদের একটা খবর পাঠিও যে আমরা তিনজনেই ...। গরুড় এসে রাম-লক্ষ্মণকে গিঁট খুলে দিতে লাগল ও তারা সুস্থ্য বোধ করল।কিছুক্ষণ পরে উঠে বসতেও পারল।সমস্ত সেনারা নতুনভাবে জেগে উঠল আনন্দে—জয় শ্রীরামের জয়—ধ্বণিতে আকাশ কেঁপে উঠল
রাবন তখন ছাদে—যুদ্ধ জয়ের পরে কী হবে,সেই কথাই ভাবছেন।সীতা রাজি না হলে অশোকবনেই কি ওই সোনার প্রতিমা...এমন সময় রামের সেনাদের উল্লাসে তিনি চমকে উঠলেন,মৃত শত্রুও কি বেঁচে উঠল! একমাত্র দেবতা ছাড়া কারো সাধ্য নেই ওই দড়ি খোলার।তাহলে কি...রাবণের মনে এই প্রথমবার দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনালো,তাহলে সময় খুব খারাপ।দেবতারা অনেক ছলা-কলা জানে—তারা যে গোপনে সাহায্য করছে এই ঘটনায় তা স্পষ্ট হল।হায় রে দুর্ভাগ্য।শক্তিও অনেক সময় দশচক্রে পরাজিত হয়!