বিচ্ছিন্ন দ্বীপ লঙ্কা চিরকালই সুরক্ষিত ছিল।এভাবে কোনও মানুষ,সৈন্য-সামন্ত নিয়ে যে চলে আসতে পারে তা লঙ্কাবাসী বা তাদের রাজা রাবন কেউই ভাবেনি।রাবন ছিল মস্ত বীর।বড় বড় বীরদের কাছে সে শিক্ষা নিয়েছে সমস্ত রকম যুদ্ধ বিদ্যার।খুব ভক্তি তার ,শিবও খুশি রাবনের উপর।আর বুদ্ধিতে তো রাবনের সমতুল্য কেউই নেই—বেড়ালের যেমন নটি জীবন,রাবনেরও দশটি মাথা-লোকে বলে।প্রজারা অনেকটাই নিশ্চিন্তে বসবাস করত।এই সেনা আসার ঘটনা লঙ্কার ইতিহাসে নতুন,তাই রাম ও তার দলের গতিবিধি জানবার জন্য শুক ও সারণ বলে দুজন চরকে পাঠানো হল রামের শিবিরে।সাগর পারে তারা অস্থায়ী শিবির বানিয়ে রয়েছে। শুক ও সারণ সকলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আন্দাজ করার চেষ্টা করল রামের লোকবল কত,অস্ত্রের পরিমান কত—ইত্যাদি।বিভীষণ যে এদের মধ্যে থাকবে তারা ভাবেনি,বিভীষণ দেখেই চিনে ফেলে এই বিখ্যাত রাজকর্মচারীদের—সুগ্রীবকে হুকুম দেয় –এক্ষুনি মারো এই পাজি দুটোকে—দেশের লোক বলে বিভীষণের এতটুকু দয়া আসে না মনে। রামের কাছে এদের মারতে মারতে ধরে নিয়ে যাওয়া হলে রাম বলে ,দূতকে মেরে ফেলার নিয়ম নেই-আর দূতই তো আমাদের খবর নিয়ে যাবে।শুক ও সারণ তোমরা তোমাদের রাজার কথা লোককেও জানিও আর রাজাকেও জানিও,আমি ঘরে ছিলাম না ,সেই সময়ে রাবণ সীতাকে হরণ করেছে।তারপরে খর ও দুষণ নামে তোমাদের দুই জনকে আমি মেরেছি—কাজেই রাবণ যেন তৈরি হয় যুদ্ধের জন্য।
শুক ও সারণ ফিরে এসে রাবন০কে জানায়,লঙ্কার জন সংখ্যা এমনিতেই কম,সেনার সংখ্যা প্রয়োজন অভাবে আরও কম,কিন্তু রামের সঙ্গে অনেক অনেক সেনা এসেছে।আমাদের থেকে বেশি ছাড়া কম নয়। রাবন এইসব বিশ্লেষণে রেগে ওঠে—তোমরা কতক্ষণ ছিলে সেখানে? কিভাবে থাকব ঢোকবার সময়ই তো বিভীষণ দেকে ফেলল-- তাহলে সেনাদের সংখ্যা ,বীরত্ব জানলে কীভাবে? অপদার্থ সব--
এরপরে কেউ চেনে না এমন একজন ,যার নাম শার্দুল-তাকে পাঠাল রাম ও তার দলবলের সঠিক অবস্থান জানার জন্য—কিন্তু এবার রামের শিবিরে সকলেই সচেতন ছিল তাই শার্দুলও ধরা পড়ে গেল বিভীষণের চোখে-মারতে মারতে সকলে মিলে শার্দুলকে প্রায় আধমরা করে ফেলল,রামের নির্দেশ মত তারপরে রামের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হল।রাম শার্দুলকেও গায়ে হাত বুলিয়ে বলল—তোমাকে আমি মারব না তুমি ভয় পেও না কিন্তু তুমি লঙ্কার সেনাদের ও সাধারণ মানুষদের বলবে আমি এত ভীষণ সাগর পার করে চলে আসতে যখন পেরেছি,আমার অসাধ্য কিছুই নেই(সাঁকো কে বানিয়েছে তা তো লঙ্কার কেউ জানে না!)।আমার বউ সীতাকে রাম ধরে এনেছে কাজেই লঙ্কার একটা লোককেও আস্ত রাখব না।রাবনের দোষেই সকলের মরন হবে--
শার্দুল গিয়ে রামের হয়েই কথা বলে রাবনকে,রাবন দেখে শার্দুলও আসলে কিছুই খবর আনতে পারেনি।সৈন্য সংখ্যা জানাটা জরুরী ছিল কিন্তু লোকজন বিশ্বস্ত থাকছে না।রাবন বিদ্যুজ্জিহ্ব নামে এক শিল্পীকে ডেকে পাঠালেন।শার্দুল ও শুক বসে রামের বর্ণনা করল তার কাছে আর বিদ্যুজ্জিহ্বা বসে বসে রামের অবিকল প্রতিমূর্তি বানাল।ঠিক মূর্তি না রামের মুন্ডুটাই বানাল বিদ্যুজ্জিহ্ব রাবনের আদেশে—
ওদিকে রাবন তার মন্ত্রীদের নিয়ে জরুরী আলোচনায় বসলেন।রাবনের মা নিকষা এল সেই সভায়,সরমা ও অন্তঃপুরের সব মেয়েরাই সীতার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছে-নিকষা বলল,রাবন ,তুমি রামের সঙ্গে দ্যাখা করে সীতাকে ফিরিয়ে দিয়ে এস।সে যার স্ত্রী তার ঘরেই সে চলে যাক।ওদের দেশের ,সমাজের যা নিয়ম তাই ওরা মানবে।মেয়েরা সকলেই এই কথা আলোচনা করছে- রাবন মাকে ধমক দিয়ে বলে—তুমি রাজনীতির কি বোঝ? তুমি ভেতরে যাও- নিকষা চলে যেতে রাবনের প্রবীন মন্ত্রী মাল্যবান বলে,আপনার মা না হয় সব জানেন না,কিন্তু রাবন,আমি তো জানি—প্রজাদের মনে ভয় ঢুকে গেছে—কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না কয়জন সেনা এসেছে সাগর পার করে— রাবন জানায় সীতাকে ছাড়া যাবে না—এটা অসম্মাণের মন্ত্রীরা বলে ,যদি সীতাদেবী স্বেচ্ছায় থাকতেন,সেটা আলাদা কথা রাবন বলে,বেশ-আমি সেটারও চেষ্টা করে দেখছি,কিন্তু সীতাকে প্রাণ থাকতে আমি ছেড়ে দেব না।
বিদ্যুজ্জিহ্বার কাজ শেষ হলে দ্যাখা গেল তার শিল্প দেখে যে কেউ অবাক হবে।হুবহু রামের মতন দেখতে হল সেই মাথা।সেই মাথাটা নিয়ে রাবন গেল সীতার কাছে,অশোক বনে।
সীতাকে গিয়ে রাবন বলে রাতের বেলায় সব সৈন্য যখন ঘুমাচ্ছিল,আমি তোমার রামের মুন্ড কেটে নিয়ে এসেছি।এখন তুমি অনাথা,সমস্যা নেই আর—আমাকে এইবার গ্রহন কর।
এমন একটা আকস্মিক খবরে সীতা খুব কষ্ট পান,রামের কাটা মুন্ড থালায় করে রাবন যখন দেখাল রাবনকে মনে হয় নরপিশাচ! হায় নর,নারীর মন পেতে এ কি বিভৎস পথ বেছে নিলে—ঘৃণায় সীতা মুখ ফেরালে-তার চোখে জল নেমে এল,মনে পড়ল রামের সঙ্গে কাটানো ভালো ভালো মুহূর্তের কথাগুলি।কষ্ট অনেক হয়েছে বনের পথে কিন্তু মাঝে মাঝে যখন লক্ষ্মন থাকত না ,রাম ফিরে আসত শিকার নিয়ে...হায় রাম!
কিন্তু সীতা খুবই বুদ্ধিমতি,রাবন চলে যেতেই সে দাসীদের দিয়ে সরমাকে ডেকে পাঠাল।বিভীষণ লঙ্কা ছেড়ে গেলেও তার বউ সরমা কিন্তু রয়ে গেছে,সীতার কাছে এসে সব শুনে সরমা বলে,দাঁড়াও,তুমি ভেব না।আমি শয়তানটার সব খবর জেনে আসছি।রাম মারা গেলে কিছু কানে আসতই-- চর মারফৎ খুব তাড়াতাড়ি সরমা খবর পেল ও সীতাকে এসে জানাল যে রাম বহাল তবিয়তেই আছে-বিভীষণের কাছের লোকেরা রামদের সাহায্যই করবে।মন্ত্রী মাল্যবাণও আজ রাবনের বিরুদ্ধে চলে গেছে-এমনকি রাজবাড়ির মেয়েরা ও রাবনের নিজের মাও রাবনের বিরুদ্ধে—কোনও চিন্তা নেই-রাবনের আত্মবিশ্বাস তলানিতে—যুদ্ধ হলেও রাবন আর অপরাজেয় নয়!
লঙ্কার চারদিকের চারটি বড় বড় তোরণ।চারটি তোরনেরই বাইরের দিকে রামের সেনারা এসে প্রস্তুত হতে লাগল।তোরনের ভিতর দিকে রাবনের সেনারা।খাদ্য,অস্ত্র সমস্ত চারটি সেনাশিবিরে রাখা হল দু-তরফেই,কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয় না।দুই দিন যায়,চারদিন যায়—।
রাম তখন মতলব বোঝবার জন্য অঙ্গদকে পাঠায় রাবনের কাছে,দূত হিসাবে।অঙ্গদকে রাবনের সভায় আহ্বান করে নিয়ে যাওয়া হয়- অঙ্গদ রাবনকে জানায়,আমরা রামের সেনারা যে সাগর পার করেছি তা কি আপনি জানেন? রাবন বলে,নিশ্চয়ই জানি । অঙ্গদ বলে এর আগে হনুমান নামে এক চর এসেছিল আপনার কাছে - রাবন বলে-হ্যাঁ হ্যাঁ,তার কথাই জানার ইচ্ছে -আমার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সেই করেছে।সে এখন কোথায়? সে কি তোমাদের সেনাপতি? অঙ্গদ খুব বুদ্ধিমান,নিজেদের খবর ফাস করতে সে রাবনের সভায় যায়নি।অঙ্গদ তাই বলে,আরে না না ,ও কিসের সেনাপতি,ওকে রাম তাড়িয়ে দিয়েছে।কথা ছিল আপনার মুন্ডু এক হাতে আর সীতাদেবী সহ অশোকবন একহাতে ফেরার,তা না করে সে সীতার কাছ থেকে একটা গয়না নিয়ে ফিরেছে-- রাবনের অগ্নিকাণ্ডের কথা মনে আছে,তাই হনুমান সম্পর্কে একটা রাগ ও ভয় ছিলই—সে তাও জানতে চায়,আচ্ছা ওরকম বীর তোমাদের মধ্যে কতজন আছে? অঙ্গদ বলে,ধুর,ও একটা বীর হল? ওর সাথে কেউ মেশে না।মরলে কোনও ক্ষতি নাই বলেই ওকেই পাঠানো হয়েছিল সবার আগে লঙ্কায়—আমাদের বীরদের এইবার দেখবেন ,একটাই বাঁচার উপায়-সীতাকে ফেরৎ দিয়ে রামের সাথে সন্ধি করা। রাবণের মনে মনে এইবার রাগ হচ্ছিল,কিন্তু তবু জানার আছে অনেক কথা তাই সে বলে,দেখো,আমাদের নিজের দেশ ,তাই অস্ত্র অনেক-তোমাদের এতদূর থেকে আর কতটা অস্ত্র আনতে পেরেছ? অঙ্গদ জানায়,আমাদের সুগ্রীব রাজার অস্ত্রাগারের সব অস্ত্র আমাদের সঙ্গে-এছাড়া পক্ষীরাজ সম্পাতির সাহায্য আমরা পেয়েছি।আর রাম? গত ১২/১৩ বছর বনে ঘুরে ঘুরে সে যা অস্ত্র সংগ্রহ করেছে মুনিদের কাছে তার ইয়াত্ত্বা নেই।একটা ছাড়লে তোমাদের সোনার লঙ্কা ধ্বংস হয়ে যাবে,শিলীমুখ,ঐশীক,অশ্বমুখ—সীতাদেবী আছেন বলে এখনও তা প্রয়োগ হয়নি,নইলে তুমি যা পাজি লোক... রাবন হুংকার দেয়—আমি পাজি? তোমার রাম খুব ভালো?
--পাজি না হলে পরের বউ কেউ হরণ করে?
বাহ,সেটাই দেখলে? রাম এত পাজি যে নিজের বাড়িতে ভাইদের সঙ্গে পর্যন্ত তার সদ্ভাব নেই—বনে বনে সে সীতাকে নিয়ে বেড়াত-আমার বোনকে সে যেভাবে অপমান করেছে,আর তোমার বাবাকে সে যেভাবে মেরেছে--
--রাখেন মশাই,ওসব লোকে শুনবে না।লোকে দেখতে পাচ্ছে যে সীতার অমতে আপনি জোর করে তাকে ধরে রেখেছেন।আপনার শেষ সময় এসে গেছে রাজা...
অঙ্গদকে দূত বলে রাবন ছেড়ে দেয় কিন্তু সভার সকলে বুঝতে পারে যুদ্ধ আর ঠেকানো যাবে না। লঙ্কার চারিদিকে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়।দক্ষিণ দিকে সেনাপতি হয় মহোদর,পূর্বে প্রহস্ত,পশ্চিমে ইন্দ্রজিৎ আর উত্তরে রাবণ নিজে দায়িত্বে থাকে।
এদিকে রামের দলে নীল হয় পূর্বের সেনাপতি,অঙ্গদ থাকে দক্ষিনে,হনুমান থাকে পশ্চিমে ,সুগ্রীব থাকে উত্তরে।এছাড়া বিপদকালীন সেনাপতি হিষেবে সুশেন,শেষের দুই ছেলে মহেন্দ্র ও দেবেন্দ্র,কুমুদকে নিয়োগ করা হয়—জরূরী ওষুধ-পত্রের দায়িত্ব থাকে হনুমান ও সমস্ত বিষয়ে পরামর্শ ও সিদ্ধান্তে সাহায্যে থাকে জাম্বুবাণ—দু-পক্ষের প্রস্তুতি দেখেই দুপক্ষ বুঝতে পারে পরের দিন সকালে উঠেই শুরু হবে সেই প্রতীক্ষিত যুদ্ধ--
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:৪৬