রাম- লক্ষ্মণ রাজা সুগ্রীবের বিশাল সেনাদের সঙ্গে নিয়ে অঙ্গদের দেখানো পথে দক্ষিন সাগরতীরে এসে পৌঁছাল।দক্ষিন দেশে থাকার দরুন তবুও সুগ্রীব ও অন্যান্য সেনাদের সাগর সম্পর্কিত ধারণা ছিল কিন্তু রাম-লক্ষ্মণ সাগরের বিশালতা ও ভয়ংকর রূপ দেখে ভয় পেয়ে গেল।বনের এক মুনির কাছে নেওয়া কৌশলে রাম প্রথমে সাগরকে একটু শান্ত করবার চেষ্টা করল কিন্তু এই সাগর পেরনো তাদের দুভাই এর পক্ষে অসম্ভব তা বোঝা গেল।অথচ রামকে পার হতেই হবে,সীতা কীভাবে আছে তা না দেখে সীতাকে গ্রহন বা বর্জনের সিদ্ধান্ত সে নিতে পারবে না ।কিষ্কিন্ধ্যার যাবতীয় ভালো ভালো ঘর-বাড়ির কারিগর ছিল নল। তখন রাম গেল নলের কাছে-নল ও নীল দুজনেই কারিগরী বিদ্যায় চৌখস।নীল চিকিৎসা ও নল নির্মাণে অভিজ্ঞ ছিল।
নলকে ডেকে রাম বলেন—দেখ নল,আমার এত কষ্ট,আর তুমি আমাকে এখনও সাহায্য করছ না,এটা কি উচিত? আমি শুনছি তুকি নাকি জলের উপরে কিভাবে কিভাবে পাথর কাঠ ভাসিয়ে পথ বানাতে শিখছ?
নল বলে,দেখুন রাম-আমাদের দলে সকলেই প্রায় আমার চেয়ে বড়-হনুমান,সুগ্রীব,অঙ্গদ-জম্বুবান তো বটেই-এদের মধ্য থেকে এগিয়ে ‘আমি পারি’ বলে অহংকার করলে সেটা খারাপ দেখাত,তাই আমি আদেশের অপেক্ষায় ছিলাম।আমি দেবতা বিশ্বকর্মার ছেলে,জহ্নুমুনির কাছে মানুষ হয়েছি,কারিগরী আমাকে শিখিয়েছেন স্বয়ং ব্রহ্মা-- কাজেই কৌশল আমি জানি।
রাম খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে সবাইকে ডাকল ও তখন রামের আদেশে সমস্ত সেনারা নলের কথামত কাজে লাগল।সবাই গাছ ও কাঠ কেটে আনতে লাগল সাগরতীরে।সবার আগে অস্থায়ী পাথরের ঘর বানানো হল রামের থাকার জন্য।সে এক অপূর্ব নির্মাণ! সাদা –কালো পাথরের মিশেল আর রুপোর কাজ করা ঘর দেখে সবাই অবাক-ছোকরার এলেম আছে!
এতে হনুমানের হিংসা হল খুব।হনুমানই এতক্ষণ খাতির পাচ্ছিল এই বিদেশীর কাছে—সেই সীতার খবর এনেছিল-কিন্তু কালকের ছোঁড়া নল এখন নেতা হয়ে উঠেছে এটা দেখে আর সহ্য হচ্ছিল না।বড় বড় পাথর এনে সে সাহায্যর অছিলায় ফেলতে লাগল নলের উপরে ।রামকে নল নালিশ করায় রাম হনুমানকে তলব করলে তার ঘরে—কি কারণে নলের উপর রেগে গেলে হনু?
হনু বলে সে ব্যাটা মহা পাজি! কালকের ছেলে,আমি পাথর এনে দিচ্ছি আর সে বাঁ হাতে,তাচ্ছিল্য করে ধরছে।আজ দেখব তার কত সাহস!বড়দের সঙ্গে আচরণ শেখেনি--
রাম এবার বুঝিয়ে বলেন—যারা কাজ করে এইসব, তাদের নিয়মই যে এটা,রাগ করলে চলবে? –তুমি নিজেও কাজ করলে দেখবে বাঁ হাতে পাথর নিয়ে ডান হাতে গড়বে—এটা নিয়ম।আর এটা আমার অনেক বড় কাজ ,এখানে এগুলো ভুলে মিলেমিশে কাজ না করলে আমরা জিতব কিভাবে?
—রামের আদেশে নল ও হনুমান মিটিয়ে নিল সব ঝগড়া।
বিভীষণ দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারপরে চলে এল এপারে রামের কাছে।পরিচয় পেয়ে রাম খুব খুশী।সুগ্রীব সন্দেহ প্রকাশ করলেও রাম তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,কি কারণে তোমাকে বিশ্বাস করব বলো— তুমি আমার শত্রু রাবণের ভাই। বিভীষণ ব্রাহ্মণ সন্তান ,তিনি শপথ নিলেন ,রামের পক্ষে থেকে সমস্তভাবে সহায়তা করার।রামও এই অস্থায়ী শিবি্রে বিভীষণকে লঙ্কার রাজা হিসাবে ঘোষণা করল।
নলের দক্ষতায় ও সমস্ত সেনাদের অক্লান্ত শ্রমে একমাস বাঁধা হল সেতূ।রাম সেই জাঙ্গাল বা সাঁকো দেখে খুব খুশী।এর ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় রাম পুজো করবে—সাদা শিবের মূর্তি বানিয়ে—হনুমানকে পাঠালে হাজারটা সাদা পদ্ম আনতে দেবতাদের দেশ থেকে।রাবণ শিবের খুব পছন্দের লোক,দেবতারা রাবণকে সাহায্য করলে উপায় থাকবে না কাজেই শিবের পুজো হল মহাধুমধাম করে।দেবতারা খুশি হল।রাবনকে বাইরে থেকে সাহায্য করার আর লোক রইল না।
পুজোর শেষে সুগ্রীবের সব সেনারা সেই সেতূর উপর দিয়ে পায়চারি করতে লাগল,একটু করে এগিয়ে খবর আনার চেষ্টা করল।খবর এল লঙ্কার বাইরে আছে লোহার দেওয়াল,ভিতরদিকে রুপোর ।সামান্য একমানুষ ঢোকার মত একটি মাত্র পথ আছে সেই লোহার পাঁচিলের মধ্যে কিন্তু সেই মুখে আছে ভস্মলোচন নামের একজন।যে লঙ্কায় ঢুকবে তাকেই সে পুড়িয়ে ফেলবে।কোনও দিকে তাকায় না সে।হনুমানরা হলে পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে যেতে পারত কিন্তু রাম-লক্ষ্মণ!রাম অসহায় হয়ে জানতে চায় বিভীষণের কাছে,তাহলে উপায়?
বিভীষণ বলে দেয়-দেখো রাম,ভষ্মলোচন মারাত্মক বীর তবে তার বুদ্ধি কম।খুব বড় একটা আয়নার দরকার।সবার আগে সেই আয়না সামনে রাখলে ভস্মলোচন আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেকেই পুড়িয়ে ফেলবে।
তখন দক্ষিন দেশের সাগরপারের বালিতে তৈরি হল বিরাট আয়না।রাম ও সব সেনারা,বিভীষণ সবাই সেতুর উপর দিয়ে আয়না হাতে নিশ্চিন্তে লঙ্কার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।বিভীষণের বুদ্ধিতে,সুগ্রীবের সহায়তায়,নলের নির্মাণ কৌশলে রাম ও লক্ষ্মণ পৌঁছাতে পারল লঙ্কায়! নইলে ভষ্মলোচনকে মারা কি যার তার কাজ!!!