সমস্ত লঙ্কাকে জ্বালিয়ে দিয়ে হনুমান আবারও খুব উঁচু গাছের উপর উঠে দেহকে অনেক বড় করে ,হালকা করে লাফ দিয়ে পার হল সাগর।এপারে সাগরতীরে যুবরাজ অঙ্গদ সহ সব বিশিষ্টজনেরা অপেক্ষা করছিল।হনুমানকে দেখেই তারা সকলে ঘিরে ধরল তাকে।হনুমান ধীরে ধীরে সব বলল তাদের,কিভাবে সোনার লঙ্কার এক কোনায় অশোকবনের মধ্যে একা সীতাকে দেখতে পেয়েছেন তিনি।অঙ্গদ উৎসাহিত হয়ে প্রস্তাব দেয়-চলো ভাই,আমরা সবাই যাই আবার ওই লঙ্কায়।গিয়ে সীতাকে উদ্ধার করে একদম সঙ্গে নিয়ে ফিরি।তাহলে রামএরও আর আসতে হবে না,সীতারও কষ্ট থাকবে না। হনুমান বলেন আমি কিন্তু সীতাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম।তিনি রাজি হননি।
প্রবীণ জম্বুবান এদের কথা শুনে হাসেন।বলেন ক্ষত্রিয়দের নিয়ক কানুন না জেনে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব না রে ভাই।রাম আমাদের খোঁজ নিতে পাঠিয়েছে , সেটুকুই আমরা করব।রাম নিজে গিয়ে দেখবে কিভাবে সীতা আছে-তারপরে যদি তার মনে সীতাকে এখনও গ্রহন করা সম্ভব,তবেই তিনি সীতাকে নেবেন।এ কি আমাদের সমাজের উদারতা!
সকলেই বোঝে ব্যাপারটা,এই আর্য অসভ্য সামাজিকতার কথা সকলেই কম বেশি শুনেছে।বালীর মৃত্যুর পরে তারা রানীই রয়ে গেছেন সুগ্রীবের স্ত্রী হয়ে,তাই সামাজিক নিয়মের কথা ভেবে ফিরে আসারই সিদ্ধান্ত নিলেন অঙ্গদ।
ফেরার পথে পরে মধুশালা।পানিয়ের গন্ধে ম-ম করছে আকাশ –বাতাস।হনুমান বড় কাজ সেরে ফিরছে,তাই সেই আবদার করল অঙ্গদের কাছে-আমরা পান করব এবার।অনেক খেটেছি।অঙ্গদও সাফল্যের আনন্দে অনুমতি দিল।সবাই পানশালার মধুকক্ষে ঢুকে খেয়ে,দেয়ে,মারপিট করে সব ভাঙচুর করে ফেলল।এই মধুশালার দেখাশুনার দায়িত্বে ছিল বালি-সুগ্রীবের মামা দধিমুখ।তার সঙ্গে লেগে গেল খুব ঝগড়া।
দধিমুখ তাদের বাধা দিতে এলে অঙ্গদ বলে ,আমি তোর মত বড়লোক আত্মীয়ের সুবিধা ভোগ করি না।আমরা রাজার কাজে গেছিলাম।কাজেই এটা আমাদের অধিকার।কথায় কথায় হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে গেল।দধিমুখ মার খেয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে সুগ্রীবকে খবর দিল,তোমার একদল মন্ত্রী,সেনার দল গিয়ে মধুচক্র ভেঙে ফেলছে,আমাকেও মারধোর করেছে—কেমন অপমান!
অবাক হয়ে সুগ্রীব তাদের নাম জানতে চায়,কার এমন সাহস।রাজার প্রমোদবন সেটা!
দধিমুখ জানায় সবার নাম জানি না তবে তোমার আদরের অঙ্গদ,হনুমান এদের চিনি। এই কথা শুনেই লক্ষ্মন ,রাম সবাই উদগ্রীব হয়ে ওঠে ,তাহলে দক্ষিনের দল কি ফিরেছে?
দধিমুখ অবাক হয়ে দেখে তার নালিশের ফল হল উল্টো।রেগে ওঠার বদলে সকলে ফুল,বাজনা নিয়ে রাজ্যের সবাই অভ্যর্থনা করতে গেল নগরের দক্ষিন পথে! দধিমুখ নিজেই অবস্থা বুঝে ডেকে আনে হনুমান,অঙ্সগদ সহ সকলকে। রাম আকুল হয়ে জানতে চায় তাদের কাছে।স্থির হয়ে সকলে বসবার পরে হনুমান সকলকে আবারও লঙ্কার সব গল্প বলে শোনালেন।সীতার মাথার মনি দিলেন রামকে। রাম সেই মনি হাতে নিয়ে আরও আকূল হয়ে ওঠেন-তক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে চান লঙ্কার উদ্দেশ্যে।সুগ্রীব সকলকে বুঝিয়ে সেনাদের তৈরি হতে বলে, ঘোষনা দিল দুইদিনের মধ্যেই লঙ্কার উদ্দেশ্যে রওনা হব সবাই!
হনুমান লঙ্কায় যে তিনদিন ছিল তার মধ্যে সে সবসময়েই সাধারণের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সব দেখেছে ও লোকের সঙ্গে কথা বলেছে—রামের ও সুগ্রীব রাজার বিশাল ক্ষমতার গল্প সে যাকে পে্রেছ তাকেই করেছে—পরে রাবনের কাছে পর্যন্ত ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবার পর ও সীতার সঙ্গে হনুমানের ভাবসাব দখে সবারই মনে মনে ভয় হল।লঙ্কার চারিদিকে সাগর,কেউ সেখানে আসতে পারত না,কিন্তু একজন লোক হনুমানই যা অগ্নিকান্ড বাধিয়ে ছাড়ল ,গোটা দল এলে লঙ্কাবাসীর ক্ষতিই হব-একথা সবাই ভাবল।এছাড়া ত্রিজটা,সরমা,এমনকি রাবনের মা নিকষা পর্যন্ত সীতার নম্র সুন্দর স্বভাবের জন্য তাকে ভালোবেসে ফেলছে—তাই কদিন মা নিকষা রাবনের মজভাই বিভীষণকে বোঝাতে এল।ওরা অন্য জাতের লোক,অকারনে এদের ঘরের বউকে এনে হয়ত ভুলই করেছে রাবণ।তারচেয়ে সীতাকে ফেরৎ দিয়ে আসা ভালো।সোনার লঙ্কায় সব প্রজাদের ভালো চেয়ে রাবন যন এটা করে।বিভীষণেরও তাই মত।তার বউ সরমা সীতার সখী হয় উঠেছ-মেয়েটার জন্য মায়া হয় বিভীষণের।তাই বিভীষণ গেল রাবণের কাছে তাকে বোঝাতে-সেখান মন্ত্রীদের নিয়ে রাবণ আসন্ন বিপদের নানা সমাধান আলোচনা করছিলেন।বিভীষণের কথায় প্রথম রাবন আমলই দিল না।কিভাবে সীতাকে ফেরৎ দেওয়া যায়,তাই হয় না কি!—বিভীষণ তখন সব মন্ত্রীদের বলে আপনারা দয়া করে রাবনকে ঠিক যুক্তি দিয়ে বোঝান,এতে লঙ্কার ক্ষতি।ছোট্ট দেশে যুদ্ধ লাগলে ,প্রজাদের খুব খারাপ হবে- রাজা রাবন,তারই সামনে দাঁড়িয়ে ছোট ভাই এমনভাবে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করছে দেখে সে খুব রেগে গেল।বিভীষণকে বকতে লাগল রাবন,তাও বিভীষণ একই কথা বলায় ভাইকে ধরে রাবন মারতে লাগে—
অপমানিত হয়ে উপস্থিত মন্ত্রীদের মধ্য থেকে আরও চারজনকে নিয়ে বিভীষণ চলে আসে রাবনের বাড়ি থেকে।স্ত্রী সরমার সঙ্গে দেখা করে তারা পাঁচজন রাবণের বিরোধীতা করার জন্য লঙ্কা ত্যগ করে চলে যায় কৈলাশ পাহাড়ে।বিভীষণকে অনেকেই ভালোবাসত তাই এর ফলে লঙ্কায় থেকে যায় বেশ কিছু রাবণ-বিক্ষুব্ধ মানুষ!