ঋষ্যমুক পাহাড়ের ওপরে তখন বিশেষ জরুরী আলোচনায় বসেছিল মহাবীর বালিরাজার ভাই সুগ্রীব ও তার অতি ঘনিষ্ঠ সহচর।আসেপাশে পাহারায় ছিল সামান্য কয়েকজন অনুগামী।বিশেষ কারণে বালি এই ঋষ্যমুকে আসতেন না।সেই কারণে খানিকটা নিশ্চিন্তে এই বিক্ষুব্ধ জনেরা।এমন সময় তাপসের মত অতি সাধারণ পোশাকের দুইজন ক্ষত্রিয় পুরুষকে পাহাড়ে উঠে আসতে লক্ষ্য করে সুগ্রীব খুব ভয় পেয়ে গেল,নিশ্চয়ই বালির প্রেরিত ভেবে সে কিভাবে আক্রমণ করবে সেই কথা জানতে সহযোগী মন্ত্রীদের কাছে পরামর্শ চাইল।
হনুমান নামে সুগ্রীবের একান্ত কাছের যে লোক,সে বিরক্তি কোনওরকমে গোপন করে বলে—অকারণে আপনি এইসব ভাবছেন কেন সুগ্রীব? বালি চাইলে কবে আমাদের শেষ করে দিতে পারত।এদের দেখেই মনে হচ্ছে অন্য দেশের লোক।আমিই গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলে আসতে পারি। সুগ্রীব আর কি করে,তার এমনিতেই বুদ্ধি কম।হনুমান নিজেও মুনিদের মত সাধারন পোশাকে গিয়ে রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে পথে দেখা করে নিল।রাম নিজ পরিচয় দিল হনুমানকে তারপরে জানাল আমি সুগ্রীবের সঙ্গে একটু দেখা করতে এসিচি।সেই আমায় উদ্ধার করবে।
হনুমান বলে সুগ্রীব নিজের রাজ্য থেকে বিতাড়িত।তার দাদা বালি মহাবীর।তার সামনে গিয়ে এমনকি তার রাজ্যের কোথাও থাকার সাহস নেই সুগ্রীবের।সে কিভাবে আপনার কাজে লাগবে রাম? রাম জানায় আমিও বিতাড়িত।এই বনে একা।আমি বনবাসে থাকাকালীন রাজ্যে কোনও খবর জানাতেও চাই না।বউ নিয়ে এসেছিলাম বনে, এখন প্রজারা যদি বলে একটা বউ সামলাতে পারি না রাজত্ব চালাব কিভাবে? অযোধ্যায় বদনাম হয়ে যাবে।আমি সুগ্রীবকে সাহায্য করব,সে আমাকে।এটাই ভেবেছি। হনুমান রাম-লক্ষ্মণকে সুগ্রীবের কাছে নিয়ে আসে।সুগ্রীব সব শুনে আনন্দিত হয়।ঘর থেকে নিয়ে আসে গয়নাগুলি যা সীতা ফেলেছিল রাবনের রথ থেকে।এই গয়না দেখে রামের চোখে জল আসে আবার,সীতার গায়ের গয়না,সে নিজে ফেলে গেছে,যেন সীতার স্পর্শ লেগে আছে ওই গয়নায়।হায় সীতা,কেন এলে আমার সঙ্গে এই বনে?কত অপমান সহ্য করতে হল তোমাকে! সুগ্রীব সান্তনা দিয়ে বন্ধুত্ব করে রামের সঙ্গে।বলে ,কিষ্কিন্ধ্যার রাজপুত্র আমি,কত কষ্টে এই বনে চোরের মতন লুকিয়ে আছি দেখেছ? কেঁদো না রাম,আমি কি কাঁদছি? কান্না দুর্বলতার প্রকাশ মাত্র ।
রাম বলে দেখো সুগ্রীব মন তো মানে না,তুমি বলো,তোমার কাহিনি।কেন এভাবে তুমি পাহাড়ে বসে আছ? সুগ্রীব নিজের ঘটনা বলে রামকে।
রিক্ষিরাজার দুই ছেলে বালি ও সুগ্রীবের ছিল খুব মিল।রাজার মৃত্যুর পরে স্বাভাবিক ভাবেই বালি রাজা হলেন।তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এক রাজা।প্রজাদের সুখের প্রতি তার ছিল সবসময় দৃষ্টি।বালি কিন্তু সুগ্রীবকেও প্রায় সমান অধিকার দিলেন।চাইলে যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারত সে,আসলে দুই ভাই মিলেই রাজ্য চালাতেন তখন।একবার মায়াবী ও দুন্ধুভি নামে রাক্ষস জাতির দুই ভাই ব্রাহ্মার আনুকুল্য পেয়ে খুব ক্ষমতা লাভ করে কিষ্কিন্ধ্যা আক্রমনে এল।বালি ছিল অজেয়,বালির ভয়ে তারা পালাল কিছু পরেই ।এই দানব জাতিরা মাটির নিচে পাতাল পথের শেষে থাকে।সুড়ঙ্গের সামনে সুগ্রীবকে দাঁড় করিয়ে বালি গেল মায়াবী দানবের পিছনে ধাওয়া করে।অনেক অনেক সময় পার হয়ে গিয়েও কেউ আর ফিরল না। বালি আর ফিরবে না এমন ভাবতে আরম্ভ করেছে সবাই এমন সময় সুড়ঙ্গের মধ্য থেকে বিকট আর্তনাদ শোনা গেল ,ভয়ে সুগ্রীব সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ করে দিল।রাজ্যের মন্ত্রীরাও একবছর পূর্ণ হলে বালির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করল ও বালির রানীকে সুগ্রীবের রানী বলে ঘোষণা করে সুগ্রীবের ওপর রাজ্য চালানোর ভার দিল।এমন সময় বালি ফিরে এল দৈত্যদের মেরে।সুগ্রীবকে সিংহাসনে দেখে আর প্রিয় তারা রানীকে তার পাশে দেখে বালি গেল খুব রেগে।সুগ্রীব ক্ষমা চাইল অনেক কিন্তু বালি ভাবল তাকে মারার জন্যেই সুগ্রীব সুড়ঙ্গের মুখ পাথর দিয়ে বন্ধ করেছিল,রাজ্য ও রানীর লোভে।প্রাণ বাঁচাতে সুগ্রীব পালাল রাজ্য ছেড়ে ,কিন্তু কোথায় পালাবে যেখানেই যাবে সেখানেই বালির ভয়।এদিকে দানব মায়াবীকে বালি পাতালে মেরেছে বলে তার ভাই দুন্ধুভি বালির সঙ্গে লড়াইএ এল।বালিকে খুব গালি দিল সে,বালি রেগে তাকে মেরে এমন ছুঁড়ে দিল যে সে মরে গিয়ে পড়ল ঋষ্যমুক পাহাড়ে মাতঙ্গ মুনির আশ্রমের সামনে।মুনি রক্ত আর মৃতদেহ দেখে অভিশাপ দিল,যে আমার কুটির অপবিত্র করেছে সে যদি ঋষ্যমুকে আসে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে।ব্রাহ্মণের শাপকে সম্মাণ জানাতেই বালি ঋষ্যমুকে আসে না,তাই সুগ্রীব নিরাপদে এখানে এসে বেঁচেছে।
রাম সব শুনে বলে বেশ,তাহলে বালিকে আমি কৌশল করে যদি মারতে পারি তাহলে রাজা হয়ে তুমি আমাকে সাহায্য করবে তো? রাবণরাজার কাছ থেকে সীতাকে আনতে হবে কিন্তু!
সুগ্রীব আগুন জ্বালিয়ে অগ্নিসাক্ষী করে রামের সঙ্গে চুক্তি করে—আমরা যেভাবেই হোক পরস্পরকে জয়ী করবার চেষ্টা করব।দুজনেই অপমানিত,ও সব হারানো দুটি মানুষ তাই আমাদের পথও হবে অন্যরকমের! নৈতিকতার কথা এখন বিলাসিতা মাত্র!
দুই একদিন যেতে না যেতেই রাম অস্থির হয়ে পড়ে।রাম ঋষ্যমুকে এভাবে বসে থাকতে পারে না, বার বার জানতে চায় সুগ্রীবের কাছে সীতার কথা, খুব কি কান্নাকাটি করছিল? —সুগ্রীব রামকে আশ্বস্ত করে বলে,কোনও চিন্তা নেই আপনার।আমাদের কিষ্কিন্ধ্যার অনেক সেনা,ঠিক আমরা উদ্ধার করব।কিন্তু কিষ্কিন্ধ্যায় আগে যাই।
রাম তখনই যেতে চায় ,বলে চলো সুগ্রীব,আজই গিয়ে বালিকে মেরে তোমাকে রাজা বানিয়ে ফেলি।
সুগ্রীব রামকে বোঝায়,আমি কাছে গেলে তবেই বালি যুদ্ধ করবে নইলে নয়।সে ধার্মিক লোক,তোমার মত অপরিচিত মানুষের সঙ্গে সে কখনও যুদ্ধ করবে না,আর আমি যদি তার কাছে একবার যাই,তার এত রাগ আমার উপরে যে তখনই মেরে ফেলবে আমাকে।তোমাকে সেই ক্ষণেই এক বাণে বালির প্রাণ নিতে হবে।
রাম রাজি,বলে ,তুমি জান না সুগ্রীব,আমার কাছে কত অস্ত্র আছে।সুগ্রীব বলে তুমিও বালিকে জান না।চারটি পাহাড়ের মাথায় উঠে সে পুজা করে সন্ধ্যায়।তার গতি মারাত্মক,তার বাহুবলে দেবতারাও বার বার পরাজিত হয়েছে।স্বয়ং রাবনকে একবার বালি চার সাগরের জলে নাকানি চোবানি খাইয়ে ছেড়েছিল।রাবন অনেক ক্ষমা চেয়ে ছাড়া পেয়েছিল।তোমাকে দেখাতে হবে আগে নিজের বীরত্ব,নইলে নিজের জীবনের ঝুঁকি আমি নিতে পারব না রাজা।
রাম তখন নানাভাবে বাণ মেরে ,সব অস্ত্র বার করে দেখালো।অনেক বুঝিয়ে সুগ্রীব রাজি হল।ঠিক হল পরদিন সকালে পাঁচজন বানরজাতের লোক ,রাম ও লক্ষ্মন রাজধানীতে যাবে বালিবধ করতে
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ৮:৫৪