তখন শ্রাবণ মাস ছিল, পরপর টানা তিনদিন মুষলধারে বৃষ্টি হল । বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে কান ধরে গিয়েছিল আবিদার। এমনিতে বৃষ্টি ভালই লাগে তার। শরীরটা খারাপ বলে কিনা তখন খুব অসহ্য লাগতো ।মাঝে মাঝে ব্যাথায় চিৎকার করে কাঁদত । স্ত্রীর অবস্থা দেখে ভারী দুশ্চিন্তা হতো ফারুকের। 'একটু সবর করো। জানো তো !! আল্লাহ যখন খুব খুশি থাকেন তখন বৃষ্টি হয়। দোয়া কবুলের সময়। তার কাছে দোয়া করো , আমাদের অনাগত সন্তানের যাতে খুব ভাল একটা জীবন হয়, খুব ভালো একটা ভবিষ্যৎ হয়। ' তীব্র প্রসব বেদনায় এসব আবেগের কথা তখন অসহ্য মনে হয় আবিদার । বিরক্ত হয়ে বলে, 'সব দোয়া যদি আমিই করি , তাহলে তুমি কি করবে ?।' 'করছি তো! তোমার যাতে কষ্টটা কমে যায় , একটু আরাম হয়, সেই দোয়াই তো করছি। ' চোখের জলে লোকটার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। স্বামীর সেই মায়াভরা চোখের দিকে তাকিয়ে সব দুঃখ ভুলে যায় আবিদা।
সেই বৃষ্টির সময় জন্ম হয়েছিল মেয়েটার । মেয়ের বাবা ভালবেসে নাম রেখেছিল বৃষ্টি । নামের মর্যাদা রেখেছে মেয়ে বটে । কিছু হোক না হোক দু'চোখ দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি নামে তার। ঘটনা ঘটতে দেরী আছে মেয়ের কাঁদতে দেরী নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়ের চোখের পানি ধরেই ঢাকা শহরের হাজার এলাকার পানি সমস্যা সমাধান করা যাবে। মেয়ের বাবা তো নাম রেখেই খালাস। এখন যে কিছু হলেই আবিদাকেই সব সামাল দিতে হয়। কোথায় এখন মেয়ের বাবা? বাসায় এসেছে পর্যন্ত দেখে মেয়ের চোখ ফোলা , নাকটা লাল হয়ে আছে , গায়ে হাত দিয়ে দেখে গরম হয়ে আছে শরীর । কতক্ষণ ধরে কাঁদছে কে জানে। কোন বিপদ হল না তো ?
-কি রে মা ? কি হয়েছে তোর? মাকে বল
- কিছু হয় নি আম্মু, তুমি যাও ।
- বললেই হল ? মাকে বল।
সকালে রান্না করা ভাতগুলোর কোন নড়চড় হয় নি। পাতিলটা এখনও ভরে আছে। মেয়েটা ভাতও খায় নি। ভাতের পাশে বড় একটা কই মাছ প্লেটে করে মেয়ের সামনে গেল মেয়ে। দারুণ ভালবাসে কই মাছ, এমনিতে ভাত খুবই অল্প খায়। কিন্তু মায়ের হাতের মাখা মাখা করে রান্না করা কই মাছের দোপেয়াজো পেলে বেশ খানিকটা ভাত খেয়ে ফেলে। চার লোকমা ভাত খেয়ে পানি খেয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। বেশ কিছুক্ষণ বালিশে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল । ভারী দুশ্চিন্তা হচ্ছে আবিদার।
'সন্তানদের টিন এইজ বয়সটা বেশ ভোগান্তির , বুঝলে আবিদা?এই বয়সে গেলে মেয়েকে একটু চোখে চোখে রাখবে।' সহকর্মী পারভিন আপা বলছিলেন। বৃষ্টি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে । ও কথায় তখন অত পাত্তা দেয় নি আবিদা। এখন ভোগান্তি পদে পদে টের পাচ্ছে। স্কুলটা ভাল ভালই পাড় করলো মেয়েটা । যত বিপত্তি হল এই কলেজে উঠে । কার সাথে মিশে , কি করে কে জানে, মেয়েটা যে একটু একটু করে বদলাচ্ছে বেশ বুঝতে পারলো । অত পরহেজগার না আবিদা। কিন্তু কিছু ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে চলার চেষ্টা করে, এত সুন্দর জীবন যিনি দিয়েছেন তার উপর কিছু দায়িত্ব তো আছে। মেয়েটাও তার এমনই ছিল । মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে যেত । দোয়া , সুরা কি বুঝত না। এসে আবদার করতো আরবি ছড়া পড়ব । মাত্র আট বছর বয়সে আবদার করলো যে তাকে যাতে সালোয়ার কামিজ বনিয়ে দেওয়া হয় । সেই থেকে মায়ের দেখাদেখি মাথায় কাপড় দেয় মেয়েটা । কোন উৎসব , পার্বণ , কাজিনের বিয়ে কখনো মাথার কাপড় সরানো যায় নি যে মেয়ের কদিন ধরে হঠাৎ বায়না করছে চুল খুলে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যাবার এবং যাচ্ছেও । না! ধর্ম কর্মে কোন জোর খাটানো পছন্দ না আবিদার, কিন্তু মেয়ে কখনো যেটা করে নি সেটা করছে, এটা তো ও না, নিজের সাথে নিজে ধোঁকা করছে না তো । অনেকদিন দুশ্চিন্তা করে নিজেই নিজেকে বুঝ মানায় আবিদা। কিন্তু সেদিন অবাক হয়ে যায় আবিদা, মেয়ে তার কাছে মোবাইল ফোন আবদার করে বসেছে। যেই মেয়ে কিনা মায়ের কষ্টের কথা ভেবে গত পাঁচ বছর একটা সামান্য শখের খাবারের আবদার করে নি, সে সেদিন মোবাইল চেয়ে বসলো! প্রথমে আবিদা খুশিই হয়েছিল। মেয়ে কতদিন পর তার কাছে কিছু চেয়েছে। খুশিতে নিজের মোবাইল দিতে চাইলো আবিদা।
- তুমি আমাকে একটা নতুন মোবাইল কিনে দিতে পারছ না, মা? তোমার এই ভাঙাচোরা মোবাইল আমি নিবো না।
আবিদার সেদিন দারুণ অভিমান হয়েছিল। মেয়ের উপর , না ফারুকের উপর, নাকি নিজের অক্ষমতার উপর জানে না সে। রাগে দুঃখে টানা এক সপ্তাহ মেয়ের সাথে কথা বলে নি। তারপর অষ্টম দিনের দিন মেয়েকে নিয়ে গিয়ে তার পছন্দের একটা মোবাইল কিনে নিয়ে আসলো । কথার শাস্তি কিন্তু মেয়ের তখনো চলছিল। এ শাস্তি বৃষ্টির পরিচিত, আবিদার অস্ত্রও বলা যেতে পারে। মেয়ের কোন ব্যবহারে কষ্ট পেলে বা কাজে মনঃক্ষুণ্ব হলে এই অস্ত্র ঢাল হিসেবে থাকে ওর । একদিনের বেশি অবশ্য চলে না এসব। মেয়ে তার কথা না বলে থাকতেই পারে না মায়ের সাথে । মায়ের পা ধরে, জড়িয়ে , নিজের কান ধরে, কেঁদে কেটে অভিমানী মাকে ঠিকই মানিয়ে ফেলে ও। কই বৃষ্টি তো সেদিন ওকে মানাতে আসলো না।
আজকে আবার এই অবস্থা । এত দুশ্চিন্তা নিতে পারে না। কি হল মেয়েটার ? নতুন কলেজ, মাত্র তিনমাস হল , চিনেও না আবিদা ঠিক মত ওর বান্ধবীদের। কার সাথে মিশছে , বৃষ্টি ? কোন বিপদ হল না তো ?
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১:০৮