২
- ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবো তুমি?
- জীবনের লক্ষ জানতে চাইছেন?
- হুম, অনেকটা সেরকমই
- একদিন ধুম করে মরে যাবো । এই প্রকৃতি , পাখপাখালি, আকাশ, পাহাড়, সমুদ্র ,ঝরনা , সামনের হতাশাগ্রস্ত মানুষটা জানতেই পারল না, আমি বেঁচে ছিলাম , এমনটা যাতে না হয়।
- ইম্প্রেসিভ । বানিজ্য বিভাগে পড় আর সফল মানুষ হতে চাও না??? শুনে অবাক লাগলো
- একেকজনের কাছে সফল মানুষের সংজ্ঞা একেক রকম । সাফল্যের সব সংজ্ঞা পুঁজিবাদী সমাজকেই ঠিক করতে হবে এমনতো কোন কথা নেই।
কথাটা শুনে মনসুর লাঠিটা মাটিতে গেঁড়ে পিছে ফিরে একবার পঙ্খীর দিকে তাকালো।
- তোমার পোশাক, চেহারা বা তোমার চালচলনের সাথে তোমার কথাগুলো যে সাংঘর্ষিক বোঝো তুমি?
- আমার সংঘর্ষ নিয়ে আপনার উদ্বেগ ঠিক কতখানি জানি না, কিন্তু আপনার মত একজন উদার লেখকের মুখে এই ধরণের সংকীর্ণ কথায় আমার কিন্তু বেশ উদ্বেগ হচ্ছে।
- বয়স কত তোমার ?
- আপনার বয়সের অর্ধেকের কম হবে না।
- এভাবেই কথা বল সবসময় ?
- নাহ! সবসময় আপনার মত দু'ঘরনার মানুষের সাথে দেখা হবার সুযোগ হয় না।
- এর মানে?
- তেমন কিছুই না।
পঙ্খী সামনে হাঁটতে থাকে । পঙ্খী সহ আটজনের এই দলটা মিরসরাই ঘুরতে এসেছে। তারিখ ১৮ আগস্ত, ২০১৬। ভ্রমণপিয়াসু পঙ্খীর বন্ধু পরিবারবিহীন প্রথম ভ্রমণ । গন্তব্য নাপিত্তাছড়া , ওদের পথ দেখিয়ে নেবার জন্যে সাথে আছে গাইড ছোট্ট রাসেল । সকাল থেকেই মজার মজার সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র প্রদোষ যে কিনা কাল রাত থেকেই নিজেকে এই যুগের সবচেয়ে সাহসী আর শক্ত বলে দাবী করছিল সকাল থেকে একটার পর একটা ডিগবাজি খেয়েই চলেছে। কখনো ছড়ার পানিতে, কখনো শুকনো মাটিতে । তার সাথে আসা দুজন বন্ধুর একজন ইংরেজী বিভাগের ছাত্র নাসিম, আর এরকজন অর্থনীতির গিয়াস । ওদের সাথে অল্প কিছুক্ষণেই পঙ্খীর বেশ ভাল জমে গেল। গিয়াস পঙ্খীকে দেখা মাত্রই উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তার লম্বা জামা আর মাথার ভারী ওড়নাটার দিকে চোখ বুলিয়ে বলেছিল 'হাঁটতে পারবেন আপনি'? পঙ্খী সে কথার কোন উত্তর দেয় নি ; মুচকি হেসে বলেছিল , 'তুমি থার্ড ইয়ারে না? আমিও , চাইলেই আমাকে তুমি করে বলতে পারো।' গিয়াসের এ্যাক্রোফোবিয়া আছে। পাহাড়ের ঢালে উঁচু সরু রাস্তায় যেখানে অন্যদের সাহায্য ছাড়া এগুতে তার মন সায় দেয় না, এই মেয়ে দেখি লাফ দিয়ে দিয়ে সবার আগে আগে সেসব জায়গা পাড় হয়ে যায়। রাতের সেই বোকা বোকা প্রশ্নের জন্যে এই নিয়ে তিনবার স্যরি বলল গিয়াস। ওরা তখন নাপিত্তাছড়ার তৃতীয় ঝর্ণায় , নাম ফুলতলা । ঠিক যেন ফুলের মতই ঝরে ঝরে পড়ছিল ঝরনার জলরাশি । এই দৃশ্য দেখে মরে গিয়েও শান্তি, এইজন্যে ভয়কে জয় করে মানুষ দুর্গম পথ পাড়ি দেয়। চিৎকার করে উপরে তাকিয়ে পঙ্খী বলে উঠে 'আলহামদুলিল্লাহ'।
এই দলের সর্বজ্যেষ্ঠ সদস্য মনসুরুল আজিজ। পড়াশোনায় ফার্মাসিস্ট , পেশায় লেখক। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে ৭ বছর হাতে কলমে , আর সত্যিকার অর্থে কখনো ছাড়তে পারবে বলে মনে হয় না। টি এস সির আড্ডায় , লেখকের সমাবেশে , বইমেলার ভিড়ে তরুণদের মধ্যমণি জনপ্রিয় এক নাম। বন্ধু বন্ধুপত্নীর সাথে ঘুরতে এসে কেমন একটা একলা একলা অনুভব করছেন। নাহ! শুধুমাত্র ঘুরতে আসার জন্যে হলেও সঠিক বয়সে বিয়েটা করা খুব দরকার ছিল।
'অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজন দুজনকেই বলবো
'অনেকদিন দেখা হয় নি' ।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বছরের পর বছর ।
তারপর একদিন হয়তো জানা যাবে
বা হয়তো জানা যাবে না
তোমার সঙ্গে আমার বা আমার সঙ্গে তোমার
আর কখনো দেখা হবে না। '
পঙ্খী নামের যে মেয়েটার সাথে আজ সকালে একটা হালকা দ্বন্দ হয়ে গেল, তার মুখে প্রকৃতির মাঝে এই জোছনা রাতে তারাপদের এই সাধারণ কবিতার অসাধারণ আবৃত্তি শুনে প্রশংসা না করে পারলো না মনসুর। এ মেয়েটা একটু অন্য ধরণের কিংবা আসলে খুবই সাধারণ কিন্তু অন্যভাবে নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। সে যাই হোক , মনসুরকে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। সে লেখক মানুষ , মানুষে যত বৈচিত্র্য তাতে তার তত আগ্রহ । এই মেয়েটার ক্ষেত্রে যদিও আগ্রহটা কিছুটা নেতিবাচক। যাক সে কথা।
'পঙ্খী তুমি না কবিতা লেখ? সেখান থেকেই একটা শোনাও না।' মনসুরুল আজিজ এর বন্ধুপত্নী পরমা বলে উঠল
- খুব একটা ভাল হয় না, আপু। শখের বসে লিখি দু'চারটা। দু'দিন পর পড়ে নিজেরই বমি পায়।
- তুমি যে বান্ধবী প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিনয়ী তা কিন্তু মিরসরাই ঘুরতে আসবার আগে থেকেই জানি আমি। তো ক্যাম্পাসের লোকমুখে এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত বিনয়ী কন্যা, এসবে পাড় পাওয়া যাবে না। সাহস করে শুনিয়েই ফেল। বমি করবো কি করবো না তা আমরা শোনার পর ভেবে বের করবো ।
নাসিমের কথায় করতালি দিয়ে সায় দেয় সবাই।
'আমি যখন থাকবো না, তখনো কিন্তু এই সমুদ্র থাকবে,
সমুদ্রের গর্জন থাকবে, থাকবে পাখির কলতান ।
সূর্য প্রতিদিন একবার উদয় হয়ে, ঠিক অস্ত যাবে
ঐ কংক্রিটের দেয়ালে ঘড়ির কাঁটাটা ঠিক সময় দিবে তখনো।
ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ হাতে আড্ডা জমবে গলির মোড়ে মোড়ে
সবকিছু ঠিক তেমনিভাবে চলতে থাকবে যেমনটা চলতো বছর কয়েক আগে,
আর এদের বহমান প্রবৃত্তিই তোমাকে বারবার মনে করিয়ে দিবে
আমি নেই, আমি নেই।'
(চলবে.)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৩৬