১
আজকের সকালটা সুন্দর । শেষের আগে দিনগুলো বুঝি এমনই হয় । আশেপাশের মানুষগুলোর জীবনে অবোধ্য একটা শৃঙ্খলা । নামাজটায় আগে গড়িমসি হয়েই যেত অনেক সময়, বিশেষ করে সামান্য অসুস্থতায়, সর্দি-কাশিতে । আজকাল আর হয় না, কষ্ট হয় পঙ্খীর , তারপরও ভোরের আজানটা হবার সাথে সাথে একটা তাগিদ অনুভব হয় ওর মাঝে। একটা সময় অনেক কথা বলতো পঙ্খী , সবাই অস্থির হয়ে যেত , আবার একই কারণে ভালোও বাসত । আজকাল মালিকের সাথেই বেশি কথা হয়, এই পৃথিবীর মালিক, পঙ্খীর মালিক । কথা বলতে কষ্ট হয় ওর । মা ছাড়া বুঝেও না তেমন কেউ , কিন্তু তাকে বলতে শব্দ লাগে না, চিন্তা করলেই হয়ে যায়। অবাক ব্যাপার ! যে কখনো বলে নি তার জন্যে, যে কখনো বুঝে নি তার জন্যে। পঙ্খীর জন্যে ব্যাপারটা পুরনো , যখন গড়গড় করে অনেকগুলো কথা বলতো তখনো আর এখনো।
সকাল ৭টা বাজে, পুরনো ডায়েরিটা চেয়েছিল মার কাছে, আলমিরার ডান দিকের ড্রয়ারটাতে রাখা। ডায়েরিটা খুললে মনে পড়ে যায় কত হাসি, কত স্মৃতি , কত চাপা অভিমান আর ৫২টা ছবি। ক্লাস এইটে যখন পড়তো এক অভিনেতার প্রেমে পড়লো ; জীবনে প্রথমবারের মত কারও প্রেমে পড়লো, অভিনেতার প্রেমে পড়ল বললে ভুল হবে, অভিনয়ের প্রেমে পড়ল বোধ হয় সবচেয়ে ঠিক হবে এটা বললে , অভিনেতার অভিনয় করা চরিত্রের প্রেমে পরল । আনোয়ার ছিল তার নাম, তিতলী নামের এক মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েকে ভালবাসত সে, মাথায় চুলহীন বিবর্ণ চেহারার একটা মেয়েকে দেখতে প্রতি বিকেলে তার বাড়ি পর্যন্ত আসতো। তিতলি সূর্যাস্তের সময় কিছুক্ষণের জন্যে একবার বারান্দায় আসতো আর আনোয়ার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো ওর দিকে। আহা!! ঠিক এইভাবে কেউ ভালবাসত আমাকে, পঙ্খীর আত্মা বলে উঠতো। সেই থেকে আনোয়ারের চরিত্রকে সত্যে রুপায়ন দেওয়া মানুষটার সাথে প্রেম ওর । আহা! একবার সামনা সামনি চোখের দেখা দেখতে পেত। এখনকার মত হাতের মুঠোয় ছিল না তখন তাদের নাগাল, চাইলেই দেখা যেত না বাস্তবে মানুষটা কি করছে, জানা যেত না আসলেই মানুষটা কেমন। একটা আঙ্গুলের স্পর্শেই ভেসে আসতো না ইউ আর ফলোয়িং হিম। ছিল পত্রিকা, ছবি, আর সেই ছবির জন্যে দিনের পর দিন অপেক্ষা। আর একটা ছবি আসলেই পত্রিকা টের পেত কেচির স্পর্শ । একদিন মা পত্রিকায় মাটন বিরিয়ানি রান্নার প্রণালী খুঁজতে গিয়ে দেখে রান্নার ছবির নিচটায় বড় একটা ফাঁকা , এপাশ থেকে ওপাশটা দেখা যায় । পঙ্খী আস্তে করে সরিয়ে নিয়ে আসল পাতাটা, পরদিন ওই ফাঁকাটায় জুটল কস্টেপের প্রলেপ । ভারী লজ্জা পেয়েছিল সেদিন পঙ্খী । দুদিন বাদে সেই পত্রিকার পাতাটা মা হাতে দিয়ে বলল , 'এরপর পেপার কাঁটার আগে একটু দেখেশুনে কেটো , গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে পুরো পাতাটাই রেখো , মা চেয়ে নিবো । আজ হঠাৎ মনে পড়তেই হো হো করে হেসে উঠলো পঙ্খী । আজ হাসির শব্দটা আর অনেকদূর গেল না , কেউ টের পেল না, টের পেল ওর আত্মা আর ঠোঁট জোড়া ।
আল্লাহ তা'য়ালা বোধ হয় খুব ভালবাসেন পঙ্খীকে , ও যা চাইলো , ঠিক তাই তাই কিন্তু পেলো জীবনে । যাবার আগে ও ব্যাপারটা একবার বুঝে যেতে চেয়েছিল , অনেকদিন ধরে পুষে রাখা মৃত্যুর ভয়টা কেমন? ওর খুব সুখী একজন বাবা মা আর বোনকে দেখে যেতে চেয়েছিল ও । ওদের অসুখী চেহারাটা দেখতে দেখতে বেজায় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল ও । যেদিন আপুর চতুর্থ বাচ্চাটাও পৃথিবীতে আসার দুমাস আগেই মায়ের গর্ভেই শেষ নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিল, সেদিন সারারাত কেঁদেছিল পঙ্খী । বিয়ের পর ছ'টা বছর পাড় হয়ে গেল একমাত্র বোন প্রমা আর আরাফাত ভাইয়ের । একটা ফুটফুটে বাচ্চার জন্যে হাহাকার দেখেছে ওদের চোখে পঙ্খী, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। আরও দুজন মানুষও আহাজারি করেন একটা নাতি অথবা নাতনীর মুখ দেখবার জন্যে । একটা বাচ্চার কান্নায় সারারাত ঘুম হবে না তাদের, হাসিতে চোখে পানি চলে আসবে, পুরো ঘরজুড়ে থাকবে ছোট ছোট কাপড় আর কাঁথা বালিশের সমারোহ। তারপর বছর ঘুরতেই যখন হেঁটে দৌড়ে এটা ওটা ফেলে দিয়ে কাপড়ে জাপটে নিজের আধিপত্য জাহির করতে যাবে, তখন বাড়িশুদ্ধ সবাই বলবে, 'উফফফফ!!! আর পারি না। এমনটাতো পঙ্খীও চায়। তাই যেদিন পঞ্চমবারের মত খালা হবার খবর পেল, তারপর থেকে ছোট্ট আহলাম আসা পর্যন্ত পঙ্খী তাহাজ্জুদটাকে ফরজ নামাজের মত নিয়ম করে পড়ত । শেষরাতে নাকি দোয়া কবুল হয় , ঠিক কোনরাতের দোয়া কবুল হয়েছিল ওর ? সবরাতের ? না সেই রাতের যেদিন ও বলেছিল 'আপুর কোলে একটা সুস্থ ফুটফুটে বাচ্চা দেখে মরে গেলেও কোন আফসোস থাকবে না আমার! সত্যি বলছি আল্লাহ , সত্যি বলছি।দেখো তুমি।' উপর থেকে হয়তো একজন সেদিন বলেছিলেন, 'আচ্ছা , দেখবো তাহলে।' সে কথা পঙ্খীর জানবার কথা নয়।
এখন পঙ্খীর খালি একটাই আফসোস আহলামের স্মৃতিতে থাকবে না ও। একমাত্র ভাগ্নের কাছে ও থাকবে ঝাপসা , কিছু কথা , কিছু ছবি আর কিছু মানুষের দীর্ঘশ্বাস হিসেবে। থাক! নিজেকে বোঝায় ও। আরও চারজন যে ওখানে বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে তাদের সঙ্গ দেবার জন্যেই হয়তো ওকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আচ্ছা ওরা দেখতে কেমন ? ওখানে ওদের সাথে কি ওর দেখা হবে? ওরা ওকে কি ডাকবে? ওদের কাছে গিয়ে আহলামের কি গল্প করবে? ভালবেসে প্রমার পঞ্চম কিন্তু পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া প্রথম বাচ্চাটার নাম রাখা হয়েছে আহলাম। আহলাম মানে স্বপ্ন , ওদের পুরো পরিবারের স্বপ্ন। আহলামের বয়স এখন এক বছর আট মাস। ও আজ আছে বলে মা বাবা অযথা পঙ্খীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করে কেঁদে দিন পার করছে না, হাসতে ভুলে যাচ্ছে না। সারাদিন তটস্থ করে রাখে সবাইকে ,দৌড়ে চিৎকার করে। এসব কিছুই দেখতে পায় না পঙ্খী , শব্দ শুনে আঁচ করতে পারে। আজকাল নানা, নানু, আম্মু আব্বু সব বলতে পারে ও। শুধু ওর রুমটাতে আসলেই পুচকুটা যেন সব দুষ্টামি ভুলে যায় , ঠাণ্ডা হয়ে বসে থাকে। সেদিন প্রমা এসে বলল , আহলাম বল তো , পঙ্খী মা, পঙ্খী মা। পাগল নাকি প্রমা কে জানে! এত ছোট বাচ্চা পঙ্খী কিভাবে বলবে!! আর মা ই বা বলবে কেন অযথা ? খালা শিখালেই হয়।এই জন্মে আর ভাগ্নের মুখে খালামণি ডাক শোনা হবে না । ও অসুস্থ হবার পর থেকে যতসব অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিয়ে চলছে ওর পরিবারের লোকজন। আহলাম ওকে ডাকে না, চুপ করে বসে থাকে । মাঝে মাঝে ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে ওর কপাল ছোঁয় । পঙ্খীর এতেই চলবে । আজ আহলাম নিজেই দরজাটা ঠেলে ওর রুমে ঢুকে গেল। কেমন হতভাগাই না ও, দৌড় দিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিবে সেই শক্তিটাও ওর ভাগ্যে নেই। ড্যাবড্যাব করে আহলামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও ছোট্ট ছোট্ট পায়ে থপথপ করে হেঁটে আসলো আস্তে আস্তে। এখানে যে কোন একটা বিষয় স্বাভাবিক না সেটা এই ছোট্ট প্রাণটাও বুঝে গেছে। এসে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । তারপর ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে বলে , 'মা! মা!' পঙ্খীর বোধ হয় শরীরের অন্য কলকব্জার সাথে কানটাও গেল। তারপরও কান পেতে বসে থাকে, 'মা, ও মা, মাআআআআ' দু' চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়েই যাচ্ছে, খুশিতে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হল পঙ্খীর । মা ডাকে এত সুখ কে জানতো । ভাগ্নের হাত দুটো নিজের ঠোঁটের কাছে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকলো , ঠিক কতক্ষণ এভাবে গেল জানে না সে। একটু পর আহলাম একটা হাত ছাড়িয়ে আলতো করে ওর চোখটা মুছে দিতে থাকলো । একটা ২০ মাসের বাচ্চার মাঝে এতটা বোধ কিভাবে আসে ? বাচ্চাদের সাথে নাকি ফেরেশতারা থাকে , কথা বলে। তাহলে কি ওরাই কেউ শিখিয়ে দিল এসব? যাক গে এত কিছু বুঝে লাভ নেই, একটুপর আহলাম তার আসল মা এর কাছে চলে গেল । দরজাটা অন্য সময়ের মত বন্ধ না, হা হয়ে আছে। দূর থেকে ওর চিৎকার , দুষ্টামির কিছু মুহূর্ত ভেসে ভেসে আসে হালকা হালকা । সে অন্য এক পৃথিবী , সে পৃথিবীতে পঙ্খী থাকে না। পঙ্খীর পৃথিবীতে আজ মিনিটের পর মিনিট চলে গেল চোখের জলে। এর থেকে বেশি খুশি ও তো চায় নি কখনো।
গত দুদিন ধরে চাচ্চুটা বড্ড জ্বালাতন করছে, সকাল সকাল চলে আসছে, সারাদিন আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে, আর মা মা করছে। ব্যাপারটা খুব বিরক্ত লাগছিল পঙ্খীর। মানুষগুলো প্রয়োজনের অতিরিক্ত দুখী দুখী চেহারা করে ঘুরে বেড়ায় , ব্যাপারটা হাস্যকর। কিরে মা, দেখ, আমি এসেছি তো, পুরোটা সময় তোর জন্যে নিয়েই এসেছি । একটু চোখ খুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে থাকল মেয়েটা। ব্যাপারটা কি খুব বেশি খারাপ হল ? হাজার হোক বয়সে বড় , আবার আপন চাচা। যাক গে, এসব ভাবার সময় এখন ওর নেই। এরকম ওদেরও অনেক খারাপ লেগেছে। এর আগে ঠিক চার বছর আগে দেখা হয়েছিল ওর চাচার সাথে। অনেক ক্ষোভ , চাপা অভিমান নিয়ে বাসায় ফেরার সময় পঙ্খী বলেছিল , 'অনেক টাকা হল আপনার , তোষামোদকারী লোকও হল , কিন্তু ভালবাসে কেউ আপনাকে? এর থেকে তো আরও বেশি ভাল মানুষ আমাকে বাসে। আমার তো মনে হয় আমি এই ১৯ বছর বয়সে মারা গেলে যত লোক আমার জানাজায় আসবে তার অর্ধেকও আপনি পাবেন না।' নাহ! ব্যপারটা বড্ড বেশি হয়ে গিয়েছিল, আচ্ছা সেজন্যেই এমন রোগ হল ওর? আল্লাহ শাস্তি দিল ওকে? পঙ্খী একবার ভাবল উঠে বসবে কিন্তু আজকাল ওর শরীরটা ওর বশে নেই, একটু বেশি নড়াচড়া করলেই নাক দিয়ে রক্ত বের হয়, সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যাপারটা একদম ভাল লাগে না ওর। এ পাশ ফিরে তাকালো, একবার অস্পষ্ট স্বরে বলল , 'চাচ্চু'। চাচ্চু হাতটা ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ওজনটা প্রায় অনেকখানি কমে গেছে , এখন কি চাচ্চু ওকে কাঁধে নিয়ে পুরো বাড়িটা ঘুরতে পারবে?? ঠিক ছোটবেলার মত ?? নাহ চাচ্চুর বয়সটাও বেড়ে গেছে, আর সাথে হাঁটুর যে ব্যাথা ছিল ওটাও । ছোটবেলায় দেখা হলেই কাঁধে চড়িয়ে নাকটা গালটা টিপে অস্থির করে তুলতো চাচ্চু। এখন চাচ্চুর চেয়ে ওর শরীরটা আরো বেশি নাজুক হয়ে গেছে। ও যত ওষুধ গত দু'মাস খেলো, তত ওষুধ গত বিশ বছর মিলেও ওর চাচা খেয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। (চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:০৯