রাতারগুল_পর্ব ১
হঠাৎ অন্তঃরাত্মা কোথা থেকে উড়ে এসে সজোরে চপেটাঘাত করল, ‘ তুমি দু’বছর আগে এখান থেকে যে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে গেছ, ঠিক একই অভিজ্ঞতা যদি আবার চাও, তাহলে তোমার এখানে আসার কোন মানে হয় না। এর থেকে তুমি ভরদুপুরে পেটপুরে খেয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে, অন্তত বাকি মানুষগুলো তোমার অসহিষ্ণু প্যাচাল থেকে রক্ষা পেত।’ অন্তরাত্মার প্রবল ভৎর্সনায় আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি জীবনে হেঁটে অনভ্যস্ত সহপাঠীরাও কি সুন্দর নীরব , হেঁটে চলছে। নিজেকে আরও খানিকক্ষণ ভৎর্সনা করে এবার তৃষ্ণা মিটাবার উদ্দেশ্যে সামনে থাকা টিউব ওয়েলের দিকে আগাতে থাকলাম। পিছন থেকে কে যেন বাঁধ সাধল, ‘ লাল রঙ করা, আর্সেনিক নাকি ?’ কুছ পরওয়া নেহি।রোদের তীব্র চোখ রাঙ্গানীতে জীবন সংকটে , আর্সেনিককে অযথা দাম দেওয়ার সময় নেই ।
আমি অধৈর্য্য মানুষ , আল্লাহ তা’য়ালার লীলার লেশমাত্র বুঝার আগেই ‘কেন? কেন? কেন’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেই । রাতারগুলে যাবার সোজা রাস্তা বাদ দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পাড় হয়ে যখন আসল গন্তব্যে পৌঁছলাম তখন ‘কেন’ এর উত্তর উন্মোচিত হল।পিছিয়ে পড়া হিতৈষীকে সঙ্গী করে ঘাঁটে পৌঁছোতেই দেখলাম সুমি ডার্লিং ডুবতে থাকা সূর্যটাকে পিঠ দেখিয়ে আমাদের জন্যে নৌকা আগলে বসে আছে। সূর্যটাকে মাথার উপরে রেখে সোনালী রাতারগুল দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল বছর দুয়েক আগে। এবার কপালে তাহলে আছে সন্ধ্যার রাতাগুল, কি ব্যাপার মাঝি নৌকা ছাড়েন না, কেন? উহহহ! আবার তাড়াহুড়া! দ্বিতীয়াকে নিয়ে এর পারা গেল না...
আনন্দ ভাইয়ের এ ট্যুরে এসে নাম হয়েছে আতঙ্ক ভাই।‘born to travel’ title প্রাপ্ত বান্দা যখন অকারণে , পারলে পাতা ডুবা পানিতেও লাইফ জ্যাকেট নিয়ে নামেন, তখন নব্য ট্যুরিস্টদের মনে আতঙ্ক লাগাটাই স্বাভাবিক । তার এই আতঙ্ক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেখলাম সূচিসহ ‘ফাউল’ গ্রুপের এক হালি ছেলে মেয়ে নিজের দেড়গুণ ওজনের লাইফ জ্যাকেট পড়ে যখন নৌকায় উঠে গেল। হাসব কি? ওদের অবস্থা দেখে সেই গরমে আমারই প্রায় শ্বাস আটকে যায় অবস্থা। যাই হোক দোলা মেয়েটাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল আতঙ্কটা মহামারী আকার ধারণ করে নি এখনও ।
অন্ধকারে জলারন্য যে কি অপূর্ব সুন্দর তা যে দেখে নি, তাকে আমি কিভাবে বুঝাবো । খালি ক্ষণে ক্ষণে চোখে পানি চলে আসে আমার। কিন্তু ঠিকমত প্রকৃতি দেখে আনন্দে এক সাথে চার ফোঁটা চোখের জল ছাড়বারও উপায় নেই। কৃতিত্বঃ সেলফি জেনারেশনের ।
আমি উদ্ভিদ বা প্রকৃতি বিশ্লেষক নই। আমি শুধু প্রকৃতি দেখি এর আবোল তাবোল বিশেষণ বসাই । এই যে যেমন গতবার মনে হচ্ছিল এ গাছগুলো কোমর পানিতে স্বেছায় ডুবে থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জলজ্যান্ত ; প্রাণবন্ত সৃষ্টি । হঠাৎ হঠাৎ তকালে মনে হচ্ছিল এখুনি হাসি দিয়ে বলবে, ‘ দ্বিতীয়া, ভাল আছো ?’ অন্ধকারে আজ গাছগুলোকে কেমন যেন নিরীহ লাগছে, সূর্যটা একদম নাই হয়ে গেল দেখে কিনা জানি না আস্তে আস্তে নিরীহ গাছগুলো কেমন রাগী চেহারায় রুপান্তরিত হতে লাগল । মনে হচ্ছিল, আমার আর অসীমের বেসুরো গলায় গান শুনে থাবড়ে দিয়ে বলবে, ‘ দোহাই লাগে, চুপ কর।’
গন্তব্য ছিল উঁচু টাওয়ারটা ; পুরো জলারন্য একযাত্রায় না দেখার দুঃখ কিছুটা কমানোর উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষের এক অনবদ্য সৃষ্টি । কর্তৃপক্ষের মত সৃষ্টিও ভেজাল, পাঁচজনের বেশি উঠলে এমন কাঁপুনি আরম্ভ হয় যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। আমি সূচির আশেপাশে ঘুরতে লাগলাম , কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ওর লাইফ জ্যাকেটটাকে জাপটে ধরবো। পালাবি কোথায় ??
সিলেটে আসার প্রথম প্রহর থেকেই লক্ষ্য করছি সব বিষয়েই আমার কেমন যেন তাড়াহুড়া । ফেরার সময়ও সবার সাথে পাল্লা দিয়ে আগেভাগেই নৌকায় উঠে বসলাম । পিছে তাকিয়ে দেখি মহীয়সী নারী হিতৈষী তাকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করার জন্যে বিভিন্ন মানুষের কাছে আহবান জানাচ্ছেন। তিনি অত্যন্ত সাহসী ব্যাক্তিত্ব ; শুধুমাত্র পানি, উচ্চতা এবং জোঁকে ভয় তাঁর । আমি তার আহবানে সাড়া দিয়ে যখন আবার আগের অবস্থানে গিয়ে তাকে নিয়ে যখন ফের নৌকায় ফিরছিলাম তখন নিজেকে আমার কেমন যেন ‘হিরো হিরো’ লাগছিল ( যদিও তার কাছ থেকে কোন স্বীকৃতি পাই নি; মেয়ে বড্ড লিঙ্গ বৈষম্যকারী)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১:১৯