somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালবাসি বাংলাদেশ

১৯ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, জ্বলজ্বলে চোখের মনি থেকে ধুসর আভা বের হচ্ছিল। আমার চোখ দুটো দেখে তার অনুভূতি ঠিক কি হয়েছিল জানি না, কিন্তু দৃষ্টি তারও অপলক ছিল। ঠিক কতক্ষণ আমরা এভাবে একে অপরের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলাম জানা নেই, সংবিৎ ফিরে এল ইউসুফ ভাইয়ার হস্তক্ষেপে ।আমাদের কথাবার্তায় নিষেধাজ্ঞা জারী করে নিজেই কি সব হাবিজাবি বকে যাচ্ছেন, রাগ হল আমার। আমি আমার সামনে বসে থাকা ‘প্রেমিক’ এর দিকে তাকিয়ে আছি আর ‘চিইইই’ শব্দের দিকে কান পেতে অপেক্ষা করছি হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আগমনের। এমন সময় কোথা থেকে একটা উৎকট রিংটোনের আওয়াজে মাথাটা টনটন করে উঠল । পিতা তার অফিসের কাজকর্মের ভার যে ‘ লাউয়াছড়া’ পর্যন্ত বয়ে আনবেন এ আর নতুন কি? পিছে ফিরে তাকে চোখ দিয়ে ভৎসনা করে সামনে ফিরে দেখি প্রেমের মানুষ আমার গায়েব। খানিক খেয়াল করতেই বুঝতে পারলাম ‘চিইইইই’ শব্দেরও কোন বালাই নেই। ইউসুফ ভাইয়া তার ৩২ দাঁত কেলিয়ে ‘ বলেছিলাম না??’ টাইপের একটা বাণীর জানান দিতে চাইছেন। যুগ যুগ ধরে বাংলা সিনেমায় দেখে এসেছি ‘কন্যাদের অমর প্রেমকাহিনীতে ভিলেন হিসেবে পিতার প্রত্যাবর্তন ’। শেষ পর্যন্ত জীবন আমার বাংলা সিনেমা হয়ে গেল।
১.
'Langur’ প্রানিবিশারদরা এই নামে ডাকলেও এদেশে পরিচিত ‘চশমা পড়া হনুমান’ নামে। কালচে বাদামি শরীর, মুখ আর কাল চোখের পাতার সন্ধিস্থলে গোল সাদাটে বর্ডার, ঠিক চশমার মত। তাই স্থানীয় মানুষেরা ভালবেসে এই নাম দিয়েছে। আমি এতক্ষণ যে হনুমানটার সাথে পলক বিনিময় করছিলাম তার আকৃতি ছিল আমার এক কনুই কিন্তু লেজটা ছিল প্রায় আমার অর্ধেক । একটা বাঁশগাছের উপর বসে লেজটাকে পেঁচিয়ে দিল গাছ জুড়ে; যেন সিংহাসন । নিস্তব্ধ প্রকৃতি, বর্ষাবনের স্বভাবজাত গুমোট আবহাওয়া, আর ডান দিক থেকে ভেসে আসছে ‘চি চি’ শব্দ , সময়ের ব্যবধানে শব্দটা আরও নিকট থেকে নিকটে আসছে । সেদিকে কোন খেয়াল নেই আমার। আমি তাকিয়ে আছি আমার সামনে বসে থাকা স্রষ্টার ‘জলজ্যান্ত শিল্প’ এর দিকে । ‘লাভ এট ফার্স্ট সাইট’ বোধ হয় একেই বলে।
২.
প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে কোন কিছু একটা দেখবার ভূত একবার মাথায় চাপলে এবং তা সাধ্যের মধ্যে থাকলে সেটা না দেখা পর্যন্ত আমার ঘ্যানঘ্যান চলতেই থাকে । এবার ভূত চেপেছিল আফ্রিকান ওক দেখবার। বায়না ধরার ঠিক একুশ দিনের মাথায় জুটল বাংলাদেশে অবস্থানরত শেষ আফ্রিকান ওক দেখবার সৌভাগ্য । অবস্থানস্থল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
‘বুঝলেন আপু, একসময় বৃহত্তর সিলেটের সব জায়গায় এ ধরণের ‘রেইনফরেস্ট’ ছিলো। এই যে বাণিজ্য করতে গিয়ে, চা বাগানের জন্যে গাছ কাটতে কাটতে আজ এই অবস্থা’ । যেই মানুষটা সিলেটের বর্তমান অবস্থার দৃষ্টিপাত করছিলেন আগামী তিন ঘণ্টার জন্যে বন কর্তৃপক্ষ আমাদের বন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করেছেন; গাইড ইউসুফ। বনে প্রবেশের কিছুক্ষন পর থেকেই শুনতে পাচ্ছি সাইরেনের মত শব্দ, তাঁর মাধ্যমেই জানতে পারলাম এটা একধরণের ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ । আফ্রিকান ওক ছাড়াও চাপালিশ, ঢেউয়া, আগর , পিতরাজ, হারগজা, চিকরাশি, বহেড়া,কাউ, চামলুকড়া,গর্জন , গামারি , তেলসুর এরকম বিভন্ন ধরণের বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ দেখতে দেখতেই বনে প্রবেশ করছি। সাইরেনের মত শব্দের পাশাপাশি এবার একধরনের ‘চিইইইইই’ জাতীয় শব্দের আবির্ভাব ঘটল। প্রথমে তেমন একটা পাত্তা না দিলেও পরবর্তীতে আর অবহেলা করতে পারলাম না, গাইড জানালেন এবার আমরা যাচ্ছি বিরল প্রজাতির হনুমান দেখতে, যাদের স্থানীয় লোকজন ‘চশমা পড়া হনুমান’ বলে ডাকে। এরা দলে বেঁধে থাকতে পছন্দ করে। একসঙ্গে ১৯টি পর্যন্ত দলে থাকে স্ত্রী হনুমান দল ছেড়ে কখনও যায় না । গাইড বলেই চলছে আর আমরা তার কথা শুনতে শুনতে এগিয়ে যাচ্ছি। সবচেয়ে মজার যেই ব্যাপারটা তিনি বললেন তা হল এই ‘চিইইই’ জাতীয় শব্দের অর্থ হচ্ছে একধরণের সতর্কতাবাণী মানুষের প্রতি। এ প্রজাতির হনুমান মানুষের সাহচর্য তো পছন্দ করেই না, বরং আমাদেরকে শত্রু মনে করে ( বন্ধু হবার মত কোন দায়িত্ব বন্যপ্রাণীদের প্রতি মানুষ করে নি, সুতরাং এতে তেমন একটা অবাক হবার মত কিছু নেই) । তাই আমাদের বারাবার নির্দেশ দেওয়া হল নিজেদের মধ্যে চলমান আলাপচারিতা এবং মুঠোফোন বন্ধ রাখার জন্যে, যাতে কোনভাবেই আমাদের অস্তিত্ব টের না পাওয়া যায়।
৩.
পিতার খুবই পছন্দের উপন্যাসের মধ্যে একটি হল জুলভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ' । অসাধারণ এই উপন্যাসটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমারও । সিলেটে আসার আগে কোথা হতে জানি একদিন তিনি খবর আনলেন এই উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৫৬ সালে নির্মিত ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল এই বনে। ব্যাপারটা আমরা প্রথমে উড়িয়ে দিলেও পরবর্তীতে গাইড এর সত্যতা নিশ্চিত করলেন। বই এ ‘ট্রেন থেকে নেমে নায়কের সতীদাহের মুখোমুখি হবার একটা দৃশ্য ছিল।’ ছবিটি দেখা না হলেও গাইডের কথায় যা বুঝলাম খুব সম্ভবত ওই অংশটুকুর চিত্রায়ন হয়েছিল লাউয়াছড়ার রেললাইন এলাকায়। গর্বের বিষয় বটে। যারা বইটি পড়েছেন তাদের জানার কথা কতটা লোমহর্ষক আর গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ওটা। আবেগে আপ্লুত হয়ে পিতা হাঁটাচলার পথে যে দুটি রেললাইন পেলেন দুটোতেই তার পত্নীর সাথে বেশ কয়েকটি রোমান্টিক ছবি ক্যামেরাবন্দী করে রাখলেন ।
৪.
লাউয়াছড়ায় বিদ্যমান সৌন্দর্যের মধ্যে চোখে পড়ার মত একটি হল বিভিন্ন আ,কৃতি, রং আর বর্ণের মাকড়শা। সাথে ছিল বিভিন্ন রঙের মাটি । সারাজীবন একধরণের এক রঙের মাটি দেখে বড় হওয়া মানুষগুলোর জন্যে খানিকবাদে লাল, সবুজ-হলুদের মিশ্রণ কখনওবা আকাশী-হলুদ রঙের মিশ্রণে মাটি দেখা আশীর্বাদের চেয়ে কম কিছু নয় । মনের স্বভাবজাত স্মৃতির পাশাপাশি ক্যামেরার স্মৃতিতে দৃশ্যধারণের জন্যে বড় বোনের অব্যাহত ক্লিক ক্লিক চলছে। আমরা রাস্তা চলতে চলতে হঠাৎ হঠাৎ তাঁকে হারিয়ে ফেলছি । কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর কোন বাঁশঝাড়ের ভিতর, গাছের পিছন কখনোবা টিলার ওপাশ থেকে তার আবির্ভাব হচ্ছে। এর মধ্যে ঝর্ণা থেকে বয়ে চলা এক হাঁটু সমান পানির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলাম তার বাঁ পায়ের বাঁ দিয়ে বিশাল আকৃতির কাল ময়লা জাতীয় কি যেন লেগে আছে। একজন রক্তশূন্য মানুষের রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে থাকা জোঁক এর দিকে তাকিয়ে কেমন গা ঘিনঘিন করছিল। যদিও ইতিমধ্যে পিতা-মাতাকেও অনুরুপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে দেখা গেছে। ‘লাউয়াছড়ায় আসবেন আর জোঁক ধরবে না, এটা হল নাকি?’ পরিস্থিতি যদিও ঠাণ্ডা তবুও এ কথা বলে ইউসুফ ভাইয়া পরিস্থিতি আরও শীতল করতে চাচ্ছেন ব্যাপারটা বুঝা গেল। মাঝখান দিয়ে আমার নিজেকে বঞ্চিত মনে হতে লাগল।
৫.
যাব না যাব না করেও গিয়ে বুঝলাম খাসিয়াপল্লীতে না গেলে এখানে আসার সৌভাগ্যটাই ম্লান হয়ে যেত। শিক্ষা, সভ্যতা , সৃজনশীলতা এই উপজাতি গোষ্ঠীকে এখানকার সৌন্দর্যে পরিণত করেছে। ফিরে আসবার পথ হিসেবে বেছে নিলাম অন্য রাস্তা, উদ্দেশ্য ছিল সিলেট-বিখ্যাত সাতরঙা চায়ের স্বাদ আস্বাদন। পরিচয় হল এ চায়ের উদ্ভাবক ‘গৌরাঙ্গ দে’ এর সাথে । তার নামের সাথে চেহারার কোন মিল নেই। আভিজাত্যের ছিটেফোঁটা নেই, বয়স বিশ কি চল্লিশ বোঝা দায়, চেহারায় কোন উচ্ছলতা নেই, দেখলে মনে হয় বকা দিবেন।তার ব্যবহারে যত অভিযোগ তা চায়ের সাথে সাথেই গিলে ফেললাম। ‘চা-খাবার অভিজ্ঞতা’ নিয়ে কোন কথা হবে না। যাবেন , স্বাদ নিবেন আর এসে দেখবেন আমার মতের সাথে মিলে কিনা আপানার মত।
.........
ফিরে আসবার সময়, আমি বিভিন্নভাবে লাফালাফি করে, বনে বাঁদাড়ে ঘুরে , গাছ লতাপাতার সাথে অযথা হাতাহাতি করে জোঁককে নিজের দুর্লভ গ্রুপের রক্ত দিয়ে সম্বৃদ্ধ করে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হায়! আফসোস!!!! কোন জোঁকেরই আমাকে মনে ধরে নি । ব্যাপার না!! পরেরবার জোঁকের মনজয় করে তবেই ফিরব ইন-শা-আল্লাহ.
‪#‎ডায়েরির_পাতা_থেকে‬ (১৯.০৯.২০১৪)
লাউ্য়াছড়া_পর্ব ১
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৩:২৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×