somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দা কেস –এজেন্ট রায়ান।

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত দুটো।
ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন। ডিউটিতে ছিল সাব ইন্সপেক্টর শাহাদাত। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভয়ার্ত গলা ভেসে এল,
-হ্যালো, পুলিশ স্টেশন?
-জি, বলুন।
-সর্বনাশ হয়ে গেছে, অমূল্য রত্ন চুরি হয়ে গিয়েছে!
আপনার পরিচয় দিন,
-আমি জাতীয় জাদুঘরের কিউরেটর মাহবুব হক।
নরেচরে বসলো অফিসার। বলল,
-আপনি কোথায় আছেন এখন, আর কি হয়েছে?
-আমার মিউজিয়ামে চুরি হয়েছে। আমি ওখানেই আছি। যদি আপনারা কেউ আসেন...
-আমরা আসছি।

মিউজিয়ামে,
অফিসার শাহাদাত আর অফিসার নাফিজ কিউরেটর সাহেবের সাথে ভেতরে ঢুকল। নিচে ৫ জন কনস্টেবল পাহারায় দাঁড়িয়ে গেছে। কিউরেটর সাহেবকে প্রশ্ন করল শাহাদাত,
-কি চুরি হয়েছে?
-একটা পুরনো মূর্তি। অমূল্য জিনিস।
-কখন চুরি হয়েছে?
-আপনাকে ফোন করার আধ ঘণ্টা আগে দোতলায় একটা শব্দ শুনতে পাই। গার্ডদের কারও ওখানে থাকার কথা না। দুজন গার্ডকে দেকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে প্রথমে কিছুই দেখতে পাইনি। হঠাৎ খেয়াল করি মূর্তিটা গায়েব। চোর কিভাবে আসল কিভাবে গেল টেরই পেলাম না!
-আপনি এতো রাতে মিউজিয়ামে কি করছেন? আপনি কি সারারাত এখানেই থাকেন নাকি?
-আমার একটা রিসার্চের কাজে গত এক সপ্তাহ ধরে আমি রাত একটা পর্যন্ত এখানে থাকি। আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল।
-আচ্ছা। চলুন, দোতলাটা দেখান আমাদের।
দুই অফিসারকে নিয়ে দোতলায় চলে এল কিউরেটর হক। মূর্তিটার খালি কেসটার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। চারপাশে একবার নজর বুলাল অফিসার নাফিজ। বলল,
-কেস দেখে তো মনে হচ্ছে জিনিসটা মোটামুটি বড়ই ছিল। আশেপাশে ছোটোখাটো জিনিসেরও অভাব দেখছি না। ব্যাপারটা কি?
কিউরেটর জবাব দিলেন,
-এ ব্যাপারে আমরাও অবাক হয়েছি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। গার্ডরাও কিছু বোঝেনি।
দুই অফিসার মিলে তন্নতন্ন করে পুরো রুম খুঁজল কিন্তু কোন ক্লু পেল না।
অফিসার শাহাদাত কে বলল নাফিজ,
-আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। এমন জিনিস খোলা বাজারে তো দুরের কথা, চোরাই বাজারেও বেচতে পারবে না।
-হুম। আপাতত এখানে আমাদের আর কিছু করার নেই। চল যাই।
কিউরেটরের কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে চলে গেল নাফিজেরা।

ভোর সাড়ে চারটা। সূর্যোদয়ের খানিক আগে সিটি সেন্টারের ছাদের হেলিপ্যাডে উঠে এল রায়ান। কোনও চপার রাখা নেই আপাতত। সেন্টারের উপরের তিনটে ফ্লোর ভাড়া নেয়া হয়েছে ফিনিক্স সিকিউরিটিজ এর নামে। ৩৭ ফ্লোরে নিজের জন্য একটা লিভিং কোয়ার্টার করে নিয়েছে রায়ান। দিনের বেশির ভাগ সময়েই অফিস আর ফাইলওয়ার্ক করতে করতে কেটে যায় ওর সময়। সিআইএ-র সেই ষড়যন্ত্রের জবাবে রায়ান কিছু করছেনা দেখে অনেকেই অবাক হয়েছিল। জেসনকে একটু হেসে জবাব দিয়েছে সেই পুরনো প্রবাদটা বলে,
-রিভেঞ্জ ইজ আ ডিশ, বেস্ট সার্ভড কোল্ড।
জায়গা এবং সময় দুটোই রায়ানের খুব প্রিয়। শহরের সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়ে কুয়াশা আর আঁধারে মোড়া ঢাকা শহরকে সূর্যের আলোতে ভাসতে দেখতে খুব ভাল লাগে ওর। এখনও তন্ময় হয়ে শহরটাকে ধীরেধীরে আলোকিত হতে দেখছিল। এমন সময় পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারল। চোখের কোন দিয়ে দেখে বুঝল ওর পিএ, জিসান।
-কি ব্যাপার জিসান?
-স্যার পুলিশ একটিভিটির রেগুলার মনিটরিং রিপোর্ট।
-আমাকে দেখাচ্ছ কেন? এনালাইজিং ডিপার্টমেন্টে পাঠাও, কোনও গড়বর আছে নাকি বের করতে বল।
-সেখান থেকেই এসেছি স্যার।
-কোনও সমস্যা?
-স্যার আপনি যেসব নামের ব্যাপারে প্রায়োরিটি দিয়ে রেখেছেন তাদের একজনের সাথে জড়িত।
-নাম?
-আসগর চৌধুরী।
একটা ঝাঁকি খেল রায়ান। বলল,
-কোথায়, কি, কিভাবে, কোন থানা এসব আমার ডেস্কে নিয়ে রাখো। আমি আসছি।
জিসান নেমে যেতেই স্মৃতির পাতায় ডুবে গেল রায়ান। শরীরটা বর্তমানে থাকলেও মনটা হারিয়ে গেছে এক দূর অতীতে। তখন সে ছিল আর্মিতে, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা বাহিনির একটা পদাতিক ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার। কলম্বিয়ান ড্রাগ লর্ডদের নিজস্ব আর্মির সাথে লড়াই করে ড্রাগ লর্ডদের মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার টার্গেট ছিল ওদের। একে একে ছয়জন ড্রাগ লর্ডকে ওরা ধ্বংস করে। শেষ ড্রাগ লর্ডকে তাঁর বাড়িতে হামলা করে হত্যা করে ওরা। অপারেশনে কাঁধে গুলি খায় রায়ান।
ক্যাম্প ডাক্তার, ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সুমনের কাছে নিয়ে আসা হয়। সেলাই করতে করতে ডাক্তার বলল,
-অনেক দিন হয়েছে তোর ফিল্ডে। শরীর এতো সহ্য করতে পারেনা। তোর এখন এসব থেকে দূরে যাওয়া উচিত।
বন্ধুর মন্তব্যে হেসে উঠেছিল রায়ান। বলেছিল,
-তুইও না যেমন, সুমন! এই তো বয়েস, এখনই তো সময়। দেশের জন্য লড়ার অধিকার আমারও আছে।
-আছে এবং তুই দেশের জন্য কম কিছু করিসনি। কিন্তু সব কিছুর একটা সীমা আছে। তুই বুঝতে না পারলেও তুই অসুস্থ হয়ে পড়েছিস।
-প্রমান দে।
-তুই রাতে ঘুমাতে পারিস না, কোন রাতে ঘুমালেও ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠিস। অতিরিক্ত অ্যালার্মড হয়ে থাকিস সবসময়। রিলাক্স হওয়া কাকে বলে তা তুই ভুলে গেছিস! তোর মন আর প্রেসার নিতে পারবে না। এইবার তুই এই প্রফেশনকে বিদেয় দে।
-আগে তুই বিয়েটা সেরে ফেল, এরপর আমি প্রফেশন ছাড়বো।
-আমার বিয়ের সাথে তোর চাকরি ছাড়ার কি সম্পর্ক?
-আরে আমি চাকরি ছাড়লেও তুই তো ছারছিস না, এদিকে বিয়েটিয়ে আমার দ্বারা হচ্ছে না। তুই বিয়েটা করলে আমার বেশ সুবিধে হয়ে যেত।
-তবে রে শালা...
হঠাৎ শুয়ে থাকা রায়ানের উপর লাফ দিয়ে পড়ল সুমন। রায়ান প্রথমে ভাবল দুষ্টুমি করে ওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সুমন, কিন্তু পর মুহূর্তে গুলির শব্দে চমকে উঠল। আততায়ীর গুলিটা লাগলো সুমনের বুকে। ঝট করে পাশে রাখা পিস্তলটা তুলে গুলি করল রায়ান। আততায়ি পরে গেল। সুমনের ক্ষতটা পরিক্ষা করে দেখে হতাশ হল। কোন আশা নেই। মুখে কোন কথা বলতে পারছিল না সুমন, ওর হাতে একটা কাগজ তুলে দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। ওদিকে ক্যাম্পে যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। পিস্তল হাতে বেরিয়ে এল রায়ান। অনাকাংখিত শত্রুদের চেহারা দেখে বুঝতে পারল যে সাত নম্বর ড্রাগ লর্ডকে শেষ করার জন্য যে টিমটা গিয়েছিল ওরা ব্যর্থ হয়েছে। ক্যাম্পে বেশী লোক নেইও দেখতে দেখতে ওরা সবাই শেষ হয়ে গেল। শত্রুরা সবাই রায়ানকে ঘিরে ধরল।
এগিয়ে এল ড্রাগলর্ড আঞ্জাল। ওকে দেখে দাঁত কেলিয়ে বলল,
-What’s the matter major? Mommy is not here?
আকাশ বাতাস কাঁপানো হাসি হাসল সে। রায়ান কিছু বলছে না দেখে আবার বলল,
-Waiting for back up? There is no one else of you. All of my men are waiting here to see you dead. May I please them? Ha?
আবার সেই বাতাস কাঁপানো হাসি। রায়ান জিগ্যেস করল,
-All of your men are here?
-Yes they are.
-You sure?
-Hell yeah! Why?
পকেট থেকে হাত বের করল রায়ান। সন্দেহের দৃষ্টিতে রায়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল সে,
-What’s that? Candy? Or you want to play magic?
-Be careful what you wish for.
রহস্যময় হাসি হাসল রায়ান। হাতের মুঠো খুলল। একটা মিনি ট্রান্সমিটার ধরা ওর হাতে। জিনিসটা চিনতে পেড়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেল ড্রাগলর্ডের। রহস্যময়, গায়ের রোম খাড়া করা চাপা গলায় বলল রায়ান,
-Now, are you watching closely?
ট্রান্সমিটারের বাটন প্রেস করল। ট্রান্সমিটার এক সাথে দুটো কাজ করল। ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় ফিট করা চার্জ একটিভেট করে দিল আর সেইসাথে রায়ানের পায়ের নিচের বম্ব শেল্টারের ঢাকনা খুলে দিল। চোখের সামনে এতো দ্রুত ব্যাপারটা হয়ে গেল যে কিছুই করতে পারল না শেষ কলাম্বিয়ান ড্রাগ লর্ড। পুরো ক্যাম্প আগুনের গ্রাসে ঢেকে গেল। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সবাই। বম্ব শেলটার কেঁপে উঠল শকওয়েভে।

কেস রিপোর্টে যা আছে দেখে নিয়ে থানায় যোগাযোগ করে কেসটা নিয়ে রায়ান নিজে কাজ করবে বলে জানাল। নিজের পরিচয় দিল ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের বড় অফিসার বলে, চেক করলেও সমস্যা নেই। ঠিকই জানতে পারবে এই নামে তুখোড় এক ডিটেকটিভ আছে তাদের, প্রাক্তন আর্মি অফিসার। থানার অফিসাররাও এ ধরনের কেস ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চেই সাধারণত হ্যান্ডওভার করে, তাই কোনও সমস্যা হয়নি। কাল আবার যাবে ওরা মিউজিয়ামে।
নিচের কনস্টেবলদের দেখে একবার ভ্রূকুটি করে ঢুকে পড়ল ভেতরে রায়ান। ওর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল দুই অফিসার। অফিসার শাহাদাতকে প্রশ্ন করল,
-সার্চ হয়ে গেছে?
-ইয়েস স্যার।
-তাহলে বাহিরে কনস্টেবলদের রেখেছ কেন? চোর এক জায়গায় দুবার আসে নাকি? দেশে ক্রাইম এই একটাই হয়না। তুমি ওদের নিয়ে চলে যাও, অফিসার নাফিজ থাকুক।
কাঁচুমাচু হয়ে বলল শাহাদাত,
-ইয়েস স্যার।
কনস্টেবলদের নিয়ে অফিসার শাহাদাত চলে যেতেই দোতলায় ক্রাইম সিনে রায়ানকে নিয়ে এল নাফিজ। কিউরেটরের পিছনে এসে দাঁড়াল রায়ান। বলল,
-লুকানো ক্যামেরা তো থাকার কথা মিউজিয়ামে। সেগুলো কাজ করে নাকি বাতিল মাল?
চমকে পিছনে ফিরল কিউরেটর,
-আপনি কে?
-রকিব রায়ান, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ। প্রশ্নের জবাব দিন।
-কাজ করে।
-তাহলে আগে ওদের বলেননি কেন?
আমতা আমতা করে বলল কিউরেটর,
-আসলে এতো তাড়াতাড়ি এসব ঘটে গেল যে ক্যামেরার কথা মনেই ছিল না। ওনারাও জিগ্যেস করেননি।
তিরস্কারের দৃষ্টিতে নাফিজের দিকে চাইল রায়ান। কিউরেটর সাহেবকে বলল,
-ঠিক আছে। চলুন, আমাদের দেখাবেন।
-চলুন।
পথ দেখিয়ে কন্ট্রোলরুমে ওদের নিয়ে এল। টেকনিশিয়ান বিশাল এক হা করে ঘুমুচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে তাকে ঘুম থেকে উঠাতে হল। চোখ থেকে এখনও ঘুমের রেশ কাটেনি একটুও। ধমক দিয়ে বলল কিউরেটর,
-তোমাকে বেতন দেয়া হয় কি ঘুমানর জন্য?
-জি স্যার? না স্যার।
ঘুম ঘুম চোখে বলল টেকনিশিয়ান।
-তাহলে ঘুমাচ্ছিলে কেন? চুরি যে হয়ে গেল, সেই ক্ষতি কে মেটাবে? তুমি?
ঘুমের ঘোরে বলল সে,
-বারাক ওবামা দেবে।
-হোপলেস!
টেকনিশিয়ানকে সরিয়ে নিজেই খুঁজে বের করে নির্দিষ্ট ভিডিও টেপটা চালু করল কিউরেটর সাহেব। অনেকক্ষণ কিছুই দেখা গেল না। হঠাৎ ব্যাতিক্রম দৃশ্য ফুটে উঠল। ছাদের স্কাইলাইট কেউ খুলে উপরে টেনে নিচ্ছে। এরপর আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা দুজন লোক নেমে এল। একজন ভীষণ ঢ্যাঙ্গা, অপরজন বেশ মোটা। অদ্ভুত এক জুটি। ঢ্যাঙ্গা লোকটা প্রথমেই মূর্তির সাথে সেট করা অ্যালার্মের তার খুঁজে বের করে কেটে দিল। ওদের দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে ওদের টার্গেট একমাত্র মূর্তিটাই। মোটা লোকটা অনায়াসে ভারি মূর্তিটা কোলে তুলে নিল। এরপর স্কাইলাইটের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। ঢ্যাঙ্গা তার কাঁধে চড়ে ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে নিচে দড়ি ফেলল। দড়িতে মূর্তিটা বেধে দিতেই টেনে নেওয়া হল। হঠাৎ উপর থেকে স্কাইলাইটের ভারি ঢাকনাটা নিচে এসে পড়ল। সম্ভবত ঢ্যাঙ্গার নাড়া খেয়েছে। ওটার শব্দই কিউরেটর সাহেব শুনেছিলেন। কিউরেটরের পায়ের আওয়াজ পেয়ে দ্রুত ঢাকনাটা আবার তুলে ঢ্যাঙ্গার কাছে দিল মোটু। এরপর সবার চোখ ছানাবড়া করে বিশাল এক লাফ দিয়ে আড়াই মানুষ সমান উঁচু স্কাইলাইটের কোনা ধরে ঝুলে পড়ল। নিজেকে টেনে তুলল উপরে। স্কাইলাইটের ঢাকনা যথাস্থানে লাগিয়ে দিল। তার আধসেকেন্ড পরেই কিউরেটর সাহেব দুজন গার্ড নিয়ে রুমে ঢুকলেন। এরপরের দৃশ্যের বর্ণনা ওরা আগেই তার কাছে শুনেছে।
কি যেন একটা আসি আসি করেও মাথায় আসছে না রায়ানের। তখনকার মতো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা বাদ দিয়ে কিউরেটরকে প্রশ্ন করল,
-মূর্তিটার ছবি রেকর্ড বইয়ে আছে?
-আছে।
-আমাদের দেখান।


রেকর্ডরুম থেকে বই বের করে ওদের দেখাল উনি। নাফিজ জানতে চাইল,
-মূর্তিটার কত দাম?
-১০ কোটি। কমপক্ষে।
-কমপক্ষে!? এতো দামী হওয়ার কারণ কি?
-আসলে ওটা এমন এক ধরনের মেটাল দিয়ে তৈরি যা এখনও পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায়নি।
-তাই নাকি? তা আপনারা এটা পেলেন কোথায়? বাহির থেকে আনিয়েছেন? নাকি এলিয়েনরা গিফট করেছে?
নাফিজের গলায় ব্যাঙ্গের সুর স্পষ্ট হলেও এড়িয়ে গেল কিউরেটর,
-আশ্চর্য হলেও সত্যি যে এই মূর্তি আমাদের দেশের। অনেক পুরনো এক জমিদারের বংশধরের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া। তিনিও পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। সেটাও বহুবছর আগের কথা।
গর্বের দ্যুতি দেখা গেল কিউরেটরের মুখে। রায়ান বলল,
-আমি একবার বাহিরে গিয়ে অবস্থাটা দেখি।

রায়ানের পিছুপিছু নাফিজও বাহিরে চলে এল। অনেকক্ষণ ধরে মারবেল পাথরের খোদাই করা এক দেয়াল দেখল রায়ান। নাফিজকে বলল,
-এই খোদাই করা নকশায় পা দিয়ে দিয়েই উপরে উঠেছে। হ্যাংলা লোকটা উপরে উঠে দড়ি বেধে নামিয়ে দিয়েছে, তারপর উঠেছে মোটা।
-হতে পারে স্যার। কিভাবে বুঝলেন?
-বোকা নাকি? মাথায় কিছু নেই? অন্য কোন দেয়ালে না আছে জানালা, না আছে নকশা, না আছে কোন কার্নিশ। আর ঐ দেখ দড়ি,
ঝোপের দিকে ইশারা করল রায়ান। ওখান থেকে একটা দড়ির কিছু অংশ বের হয়ে রয়েছে। নাফিজ বলল,
-তাহলে ফিঙ্গারপ্রিন্টের জন্য ল্যাবে পাঠিয়ে দেই স্যার?
অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল রায়ান,
-রাতকানা নাকি তুমি? অফিসার হয়েছ কিভাবে? উপরে লোক আছে চেনা? ভিডিওতে দেখনি? দুজনের হাতেই গ্লাভস পড়া ছিল।
ধমক খেয়ে কাচুমাচু হয়ে গেল নাফিজ। মনে মনে বলল,
-ধুর! একে ইনভেস্টিগেশনের জন্য ডেকে আনার জন্য আমার ফাসি দেয়া দরকার! শালার!
গর্জে উঠল রায়ান,
-মনে মনে গালাগালি পরে করো। আগে চল কিউরেটর সাহেবের সাথে কথা বলে এখান থেকে যাই।
থমকে গেল নাফিজ, শালা শব্দটা কি মুখেই বলে ফেলেছিল?
ভেতরে এসে কিউরেটর সাহেবের সাথে দেখা করল ওরা। রায়ান বলল,
-আপনাদের বাহিরের ঐ দেয়ালে খোদাই করে যে চিত্রকর্ম করা হয়েছে সেটা থেকে জলদি মুক্তির ব্যবস্থা করুন। চোর ওটার সাহায্যেই উঠেছে।
অবাক স্বরে বলল কিউরেটর,
-জি আচ্ছা।
-আমাদের আপাতত এখানের কাজ শেষ। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে থানায় খোঁজ নিতে পারেন। আমরা তাহলে চলি। সাবধানে থাকবেন।
বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল ডিটেকটিভ সাহেব আর অফিসার নাফিজ।

পরদিন সকাল।
হোটেলে ব্রেকফাস্ট করছে অফিসার নাফিজ আর রায়ান। রায়ান নাফিজকে প্রশ্ন করল,
-তোমার কি মনে হয় কেসটার ব্যাপারে?
-সত্যি বলতে স্যার এর আগা মাথা কিছু বুঝতে পারছিনা। একটা ব্যাপার পরিস্কার যে চোর শুধুমাত্র ঐ জিনিসটার জন্যই এসেছিল।
-কেন মনে হল?
-আশেপাশে দামী আরও জিনিস ছিল, সেগুলোও অনায়াসে নিতে পারতো। কিন্তু নেয়নি! কেন?
-পয়েন্ট। ধরা যাক তুমি চোর। কোন কারনে শুধু ঐ জিনিসটাই তোমার প্রয়োজন। কারণটা কি হতে পারে?
-পাগলা কালেক্টর?
-হতে পারে। তবে কোন কালেক্টর কি এভাবে চুরি করতে আসবে?
-প্রফেশনাল কোন চোরকে দিয়ে করিয়েছে।
-চোরেরা কারও জন্য চুরি করে না। অন্তত আমাদের দেশে এভাবে নয়।
-হতে পারে কারও মাধ্যমে চোরের সাথে কন্টাক্ট করা হয়েছে! হতে পারে নিজেকে আড়ালে রেখে অন্য কাউকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যাবহার করেছে!
-পসিবল। তোমার মগজ খুলছে দেখা যাচ্ছে। তাহলে আমাদের কাজ হচ্ছে অ্যান্টিক চোরদের দালালদের খুঁজে বের করা।
-সাধারন চোর দিয়েও তো কাজ করাতে পারে!
-নাহ। সাধারন চোররা শত শত মূর্তির ভীরে নির্দিষ্ট অ্যান্টিক মূর্তি চিনবে না। তাছাড়া ওদের বিশ্বাসও করা যায় না।
-ও। তাহলে আমি রেকর্ড ঘেঁটে দালালদের তালিকা বের করব?
-সেটা পরে করা যাবে। তার আগে চল, পরিচিত এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
-চলুন। যাওয়ার পথে মিউজিয়াম থেকে মূর্তিটার একটা ছবি নিয়ে নিব।
-হুম। চল।

মিউজিয়ামের সামনে নিজস্ব জীপ থামাল রায়ান। নাফিজকে জীপে রেখে নিজেই রওনা হল ছবি আনতে। ব্যাস্ত মিউজিয়ামের দর্শকদের ভিড় দিয়ে অনেক কষ্টে পৌঁছতে পারল কিউরেটরের অফিসে। ওকে ভেতরে নিয়ে এলেন তিনি। ছবি চায় শুনে কম্পিউটার থেকে একটা ছবি বের করে দিলেন। রায়ানকে চা অফার করলেন উনি, রায়ান অসম্মতি জানাতে পরে আরেকদিন আসার প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছাড়লেন। সেখান থেকে বের হয়ে আবার রওনা হল ওরা।
গুলশানের এক সাজানো গোছানো বিশাল অ্যান্টিক শপে ঢুকল ওরা। রায়ানকে দেখেই ছুটে এল দোকানের মালিক মাঝবয়সী এক লোক। দেখে পানবিড়ির দোকানদার মনে হল নাফিজের কাছে। কিন্তু মুখে সেভাব প্রকাশ পেল না। দোকানের পেছনে ওর অফিসে ঢুকে চমকে উঠল নাফিজ। পুলিশ রেকর্ডে থাকা বেশ কিছু অ্যান্টিক চিনতে ভুল হল না ওর। মুখ ফস্কে বলে ফেলল ও,
-আরেহ! এই টেরাকোটা না অক্টোবরে এক কালেক্টরের বাসা থেকে চুরি হয়েছিলো! আপনি পেলেন কিভাবে?
চোখ বড় বড় করে তাকাল দোকানদার,
-আপনি পুলিশে আছেন?
-অবশ্যই!
প্রতিক্রিয়া হল দেখার মতো,
-বাইর হন! এক্ষুনি আমার দোকান থেকে বাইরন!
রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-স্যার, আপনে আমারে বাইন্দা পিডাইতে চাইলেও আমি রাজি। কিন্তু কোন পুলিশ আমার দোকানে থাকব না। এরে বাইরতে কন স্যার!
নাফিজকে বলল রায়ান,
-তোমাকে পরে বলব, এখন বাহিরে গিয়ে গাড়িতে বস। আর এখানে কি দেখেছ তা নিয়ে কোন শব্দ যাতে না বের হয়।
বিহ্বলভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল নাফিজ।

আয়েস করে চেয়ারে বসল রায়ান। দোকানদার ফজলুর হাতে মূর্তির ছবিটা তুলে দিল,
-এইটার ব্যাপারে কি জান?
কিছুক্ষণ ছবিটা দেখে বলল ফজলু,
-এইটাতো স্যার মোঘল আমলের একটা মূর্তি মনে হইতাসে! এইটারে মোঘলমূর্তি বলা হয়।
-আচ্ছা! আর কি জান?
-তেমন কিছুই না স্যার! এইটা তো জাদুঘরেরটা মনে হইতাছে।
-যাদুঘরেরটা মানে? আর কোন মূর্তি আছে নাকি?
-সেটাই তো শুনলাম দুই হপ্তাহ আগে! এক কাস্টমার জানাইল।
ড্রয়ার থেকে খুঁজে আরেকটা ছবি বের করে দিল সে। হুবুহু দেখতে জাদুঘরের ছবিরটার মতো। ভ্রু কুঁচকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল ছবির দিকে।
-এতো মিল কিভাবে সম্ভব??
-সম্ভব স্যার! এরকম কিছু কিছু মাস্টারপিস আছে যা একের বেশী বানানো।
-হুম। তোমার কাস্টমার জিনিস দেবে কবে?
-সেটাই তো সমস্যা! কইল হেয় একটা মোঘলমূর্তি বেচবো। আমিও খোঁজ নিয়া জানলাম যে মূর্তি আরেকটা আছিল। রাজি হইয়া গেলাম। আইজ সকালে দেওনের কথা আছিল! কিন্তু এখনও আইল না। এদিকে আমি এক শেখ সাবের লগে ডিল কইরা ফেলাইছিলাম। উনি জিনিসের জন্য বারবার খোঁজ করতাছে। ঝামেলাতেই পড়ছি!
উঠতে উঠতে বলল রায়ান,
-ঠিক আছে। ও যদি আসে তাহলে আমার সাথে আগে যোগাযোগ করো। কোন পরিচয় দিয়েছে তোমার কাছে?
-তেমন কোন পরিচয় দেয় নাই, তবে কইছে উনি নাকি উত্তরাধিকার সুত্রে ওটা পাইছেন।
-ঠিক আছে, চললাম।
পেছন থেকে ডাকল ফজলু,
-স্যার, একটা কথা চালু আছে। এই মূর্তিগুলোর মইদ্দে একটা সৌভাগ্য এবং আরেকটা মরণের দুর্ভাগ্য। সুতরাং সাবধানে থাইকেন একটু।
মৃদু হেসে বেরিয়ে এল রায়ান।

গাড়িতে এসে উঠল রায়ান। ওকে দেখে রীতিমত ফুঁসে উঠল নাফিজ,
-একজন ক্রিমিনালকে আপনি কিভাবে প্রশ্রয় দেন? নীতিতে বাধে না?
-ফজলু আমাদের অনেক বড় একজন ইনফরমার। পৃথিবীর অনেক বড় বড় ক্রিমিনালরাই অ্যান্টিকের ব্যাপারে আগ্রহী থাকে। খেয়াল। ব্যাবসার ছলে তাঁদের সঙ্গে ফজলু মিশে যায় এবং আমাদের জন্য অনেক তথ্য যোগাড় করে আনে। তাছাড়া যাদের জিনিস ওর দোকানে আসে তারা সবাই করাপ্টেড আবর্জনা। ওদের সব কেড়ে নিলেও আমি বাঁধা দেব না।
-পুলিশদের দেখতে পারেনা কেন? আপনিও তো একরকমের পুলিশই!
-ডিপার্টমেন্টে কি ধরণের করাপশন আছে তাকি তোমার জানা নেই? ও শুধুমাত্র আমি ছাড়া আর কারও সাথে যোগাযোগ করে না। কাউকে বিশ্বাসও করে না।
আর কিছু বলার মতো পেল না নাফিজ। চুপচাপ গাড়ি চালাল।
ওরা আরও কিছু অ্যান্টিক শপে খোঁজ নিয়েছিল এর পরেও। কিন্তু আর কারও কাছে কোন খবর পাওয়া গেল না। আসলে দেশে সবচেয়ে বড় দোকান ফজলুরটাই।

পরদিন আবার কিউরেটরের কাছে আসল ওরা। ওদের জন্য চা আনালেন তিনি। বললেন,
-স্পেশাল চা। খেয়ে দেখেন, জীবনেও ভুলবেন না।
চায়ে চুমুক দিল ওরা। ভুল বলেননি কিউরেটর। আসলেই স্পেশাল। প্রশ্ন করল রায়ান,
-মোঘলমূর্তি নাকি দুটো ছিল? এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন?
মৃদু হাসলেন উনি। বললেন,
-শুনেছেন তাহলে? তাহলে অভিশাপের কথাও নিশ্চয়ই শুনেছেন?
-কিছুটা। আপনি পুরোটা বললেই ভাল হয়।
-ঠিক আছে বলছি। এক সম্রাট একবার এক রাজ্য জয় করার পর সেই রাজ্যের রত্নভাণ্ডারে পেয়েছিল এই মূর্তি দুটো। সম্রাটের বেশ মনে ধরে মূর্তি দুটো। সে রাজ্যের এক বৃদ্ধা তখন তাকে জানায় এই মূর্তি হল এক ভয়ংকর পরিহাস। এর একটা হল সৌভাগ্য অপরটা দুর্ভাগ্য। সৌভাগ্য আর দুর্ভাগ্য একসাথে থাকলে সেটা জীবন, কিন্তু তাদের আলাদা করলে দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে ধ্বংস! সম্রাট এই কথা আর কাউকে জানায় না। তিনি বেশী চকচক করা মূর্তিটাকে সৌভাগ্য ধরে নিয়ে সেটা নিয়ে কয়েকজন সৈন্যসহ নিজের দেশে রওনা দেন। আর কম চকচক করা মূর্তিটাকে রেখে যান ধংস হওয়া রাজ্যে। পথে ঘোড়ার পিঠ থেকে পরে গিয়ে খুড়ের চাপে মৃত্যু হয় তার। সম্রাটের মৃত্যুর পর বাকি সৈন্যরা অন্যান্য রত্নের সাথে অন্য মূর্তিটাও নিয়ে চলে আসে। সম্রাটের দুই ছেলে ছিল। মূর্তি দুটো তারা নিজেরা নিয়ে নেয়। কিছুকাল পরে তারা সম্রাট হয় দুই রাজ্যের। বড় ভাই একের পর এক রাজ্য জয় করতে থাকে আর ছোট ভাই একের পর এক রাজ্যের অংশ হারাতে থাকে। বড় ভাইয়ের রাজ্যে একদিন সেই বুড়ি আসে। সে সম্রাটের মূর্তির কথা নতুন সম্রাটকে জানায়। সম্রাট চিন্তায় পরে তার ছোট ভাইকে লোক মারফত খবর পাঠায়। ছোট ভাই তাকে তার রাজ্যে মূর্তি নিয়ে চলে আসতে আহ্বান জানায়। বড় ভাই রওনা দেয়। গিয়ে দেখে তার ভাই সিঁড়ি থেকে পরে মারা গিয়েছে। বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর সব দোষ মূর্তির উপর দেয়। মূর্তি দুটো পুরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয় সে। কিন্তু আগুনে পুড়ে এই মূর্তির কিছুই হল না। শুধু আগে দুটোর মাঝে উজ্জ্বলতার যে পার্থক্য ছিল সেটাও চলে যায়। সম্রাট মূর্তি দুটো লুকিয়ে ফেলে। এরপর অনেক বছর এগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে। একসময় বেরিয়ে আসে একটা মূর্তি, অপরটা পাওয়া যায় না। এ যুগে কুসংস্কারে কে বিশ্বাস করে? তাই মিউজিয়ামকে দান করা হয় মূর্তিটা। অন্য মূর্তি এখনও লাপাত্তা। কেউ কেউ বিশ্বাস করে আসলে মূর্তি একটাই। তবে মূর্তি যে দুটো ছিল তার প্রমান ইতিহাসের অনেক জায়গাতেই আছে।
হক সাহেব থামতে জানতে চাইল রায়ান,
-আপনার কি ধারনা, কি কারনে মূর্তিটা চুরি হতে পারে?
-অভিশাপের কথায় মনে পড়ল কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ জোর দাবী তুলেছিল এই মূর্তি মিউজিয়াম থেকে দূর করতে। তাঁদের ধারনা ছিল এটা দুর্ভাগ্যের মূর্তিটা। তবে দেখা যাচ্ছে কুসংস্কার সত্যি হলেও এটা তা ছিল না। এই মূর্তি পাবার পর থেকে ধীরে ধীরে মিউজিয়ামের উন্নতিই হয়েছে। কোন ক্ষতি হয়নি সেদিন রাতের আগে।
-যারা প্রতিবাদ করেছিল তাদের লিস্ট আছে?
-আছে। অনেকটা নিজস্ব খেয়ালের বশেই তৈরি করেছিলাম।
নাফিজ জানতে চাইল,
-আর যিনি আপনাদের মূর্তিটা দিয়েছিলেন তার নাম ঠিকানা।
-তিনি তো মারা গিয়েছেন। তবে তার ছেলে এখনও বেঁচে আছেন। তার ঠিকানা দেয়া যাবে।
কিছুক্ষণ কম্পিউটার ঘেঁটে দুটো প্রিন্টআউট বের করে দিলেন উনি। ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠল ওরা।

দরজা খোলার জন্য টান দিতেই ভারসাম্য হারিয়ে এক মেয়ে এসে পড়ল রায়ানের উপর। রায়ান পাশে সরে খপ করে তার হাত ধরে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাল। দরজার বাইরে থতমত চেহারায় ক্যামেরা হাতে এক ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। নাফিজ জিগ্যেস করল,
-ব্যাপার কি! মিউজিয়ামে কোন ছবির শুটিং হচ্ছে নাকি?
জবাব দিল কিউরেটর সাহেব,
-নাতো!
মেয়েটাকে জিগ্যেস করলেন তিনি,
-কে আপনি? মিউজিয়ামে ক্যামেরা ব্যবহার নিষেধ জানেন না?
-আমি ভোরের খবর চ্যানেলের রিপোর্টার।
-এখানে কি?
-কালকে মিউজিয়ামে চুরির খবর শুনলাম। তাই একটা ইন্টার্ভিউ নিতে চেয়েছিলাম আপনার।
গুঙিয়ে উঠলেন কিউরেটর সাহেব,
-মিডিয়ার জ্বালাতন শুরু!
রায়ান মুখ খুলল এতক্ষণে,
-দরজায় আড়ি পেতে অন্যদের কথা শোনাও আপনার কাজের মধ্যে আছে নাকি?
রিপোর্টারও কম যায় না। সমান তেজে জবাব দিল,
-খবর সংগ্রহ ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসীদের মারার মতো সোজা কাজ না। আমাদেরও অপ্রীতিকর অনেক কাজ করতে হয়। বুঝতে পেরেছেন?
-খুব বোঝা যাচ্ছে। নাফিজ, চল।
-স্যার শুনুন।
নাফিজ ওর হাত ধরে এক কোনায় নিয়ে গেল,
-স্যার আপনার মনে হয় না এই মেয়ে আমাদের সব কথা প্রচার করে দিলে বেশ ঝামেলা হবে?
-হতেই পারে। কিন্তু একে থামানর তো কোনও উপায় নেই।
-একটা উপায় আছে স্যার।
-কি উপায়?
-লিস্টের লোকেরা আইনের লোকের কাছে মুখ খোলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু যদি আমরা ওনাকে অফার করি যে আমাদের হয়ে এদের ইন্টার্ভিউ নেয়ার জন্য, তাহলে হয়ত ইনি কেস সলভ হওয়ার আগে কিছু প্রকাশ করবে না।
একমিনিট ভাবল রায়ান। এরপর মেয়েটাকে ডাকল,
-এই মেয়ে শুনুন।
-আমার নামটা জিগ্যেস করলেই পারেন।
-আপনি বলে দিলে আমার জিগ্যেস করতে হয় না।
-সাগরিকা রুনি।
-আপনি আমাদের সব কথা শুনেছেন?
-জি।
-তাহলে এও জানেন আমাদের এখন বেশ কিছু মানুষের সাথে দেখা করতে হবে।
-জানি।
-আমাদের হয়ে কাজটা আপনি করতে পারেন। তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন উপকারি তথ্য যোগাড় করে আমাদের দেবেন। বিনিময়ে কেস সলভ হওয়ার পর আপনাকে আমরা কেসের পুরোটা জানাব। রাজি?
-আমি রাজি।
-ব্যাপারটা বিপদজনক হতে পারে।
-আমার কাজই বিপদ নিয়ে।
-ঠিক আছে। এই নিন লিস্ট। এদের সাথে তিন দিনের মধ্যে যোগাযোগ করে যা জানা সম্ভব জেনে নেবেন। কি ধরনের তথ্য আমাদের প্রয়োজন বুঝতে পারছেন তো?
-পারছি।
-ঠিক আছে। তিন দিন পরেই দেখা হবে। গুডবাই।


তিনদিন পর,
ফোন বেজে উঠতে ধরল রায়ান,
-হ্যালো।
-আমি রুনি।
-কি খবর আপনার ইনভেস্টিগেশনের?
-আপনার লিস্টের সবটা চেক করলাম। কোনও লাভ হল না। সবাই ধোঁয়া তুলসী পাতার মতো। সবাই এক বাক্যে চায় মূর্তির অপসারণ কিন্তু সবারই জোড়াল অ্যালিবাই আছে।
-হুম। কাল সকাল নটায় সময় হবে আপনার?
-কেন? ডেট এ যাবেন?
-নাহ! ভাবছিলাম চন্দ্রিমা উদ্যানে হাওয়া খেতে যাব। যাবেন?
-একটা মেয়ের সাথে ভদ্রভাবে কথা বলা জানা নেই আপনার। আপনার মেয়েদের সম্মান করতে শেখা উচিত।
-কেন? মেয়েরা কি বাঘ না ভাল্লুক?
-সেটা সময় হলেই বুঝবেন।
-সেটাই তো কথা, আপনার কাল সময় হবে?
-হবে।
-ঠিক আছে। আমি নটায় আপনাকে অফিস থেকে তুলে নেব।
-ওকে। সি ইউ দেন।
-গুডবাই।

গাড়িতে এসে উঠল রুনি,
-সরি, লেট হয়ে গেল।
-স্বাভাবিক। মেয়ে বলে কথা।
-কেন? আপনারা ছেলেরা কি কখনও লেট করেননা?
-করি। তবে সবাই না, আর কেউই এতো বেশি লেট করিনা।
-যাই হোক। আমার আপনি আপনি করে কথা বলতে খুব বিরক্ত লাগে। আপনার এখনও চুল-দাড়িও পাকেনি। তুমি করে বললে আপনার ইগোতে চোট লাগবে?
-নাহ! ভাল আইডিয়া। তবে এখন মুখটা বন্ধ রাখলে বেঁচে যাই। ড্রাইভিঙের সময় খোশ গল্প করতে করতে উপরে পৌঁছার ইচ্ছে আমার নেই। অন্তত আজ না।
-আজ না কেন? আমাকেও সাথে নেবে তাই?
-ঠিক! তোমার আইকিউ অতটা খারাপ না। ব্যাপার হল আমি উপরে গিয়ে তোমার বকবকানি সহ্য করতে পারব না। আর সাথে কাউকে নিতে হলে বুদ্ধিমান, সুন্দরী, ভদ্র, গুণবতী কোনও আগুন সুন্দরীকে নিয়ে যেতে চাইব আমি।
-সাথে নিয়ে মারার জন্য কোয়ালিফিকেশন দিলেন নাকি বিয়ে করার জন্য পাত্রী!
হাসিঠাট্টার মধ্যে সময় কাটাতে কাটাতে একসময় বিশাল এক বাগানবাড়ির ড্রাইভওয়েতে গাড়ি থামাল রায়ান। নামতে নামতে বলল,
-এখানে আমি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমরা পুরনো হিস্ট্রি এবং অ্যান্টিকের ব্যাপারে গবেষণামূলক এক ম্যাগাজিনে কাজ করছি। সে ব্যাপারেই এনার কাছে এসেছি তথ্যের জন্য। এই নাও আইডি কার্ড।
আইডি কার্ড এগিয়ে দিল রায়ান। রুনি জিগ্যেস করল,
-ব্যাপার কি! আইডি দেখে তো আসলই মনে হচ্ছে।
-আসলই। আমাদের ইমারজেন্সির কথা বিবেচনা করে ব্ল্যাঙ্ক আইডি অনেক রাখা থাকে।
-ও আচ্ছা। নতুন কিছু জানা গেল।
-হুম।
-ও ভাল কথা। ইনি কে?
-ইনি একজন শখের অ্যান্টিক সংগ্রহকারী। এছাড়াও আরেকটা পরিচয় আছে ওনার। উনিই সেই মোঘলদের উত্তরাধিকারি যিনি মিউজিয়ামকে এই মূর্তিটি দিয়েছিলেন। আসগর চৌধুরী।


রায়ান আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিল। তাই ভেতরে ঢুকতে কোনও সমস্যাও হল না। চৌধুরী সাহেবের অ্যাসিস্ট্যান্ট ওদেরকে স্টাডিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল। পথে থেমে থেমে বিভিন্ন রকমের অ্যান্টিক বিভিন্ন জায়গায় সাজানো দেখল ওরা। অ্যাসিস্ট্যান্ট তাদের মধ্যে কয়েকটির নামসহ হালকা বর্ণনা দিল ওদের অনুরধে। চৌধুরী সাহেব ইজি চেয়ারে শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ওরা পৌঁছতে ওদেরকে বসতে অনুরোধ করলেন। চোখ খুলে অনেকক্ষণ অবাক হয়ে রায়ানের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। রুনি খুক খুক করে কাশতে হুশ ফিরল। হেসে রায়ানকে বললেন,
-আসলে আপনি দেখতে অনেকটা আমার ছেলের মতো। তাই অবাক হয়েছিলাম। এত মিল মেলা ভার। আসুন, কাজের কথায় আসি।
রুনি কথা শুরু করল,
-আসলে আমরা আমাদের দেশের অ্যান্টিককে প্রাধান্য দিচ্ছি। এজন্য মিউজিয়ামে বেশ কিছুদিন আমরা ঘুরে তথ্য যোগাড় করেছি। ওখানকার একটা মূর্তি খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে আমাদের। আমার সহকারি কিউরেটর সাহেবকে জিগ্যেস করে আপনার কথা জেনে নিল। ওটার ব্যাপারেই আমরা শুনতে চাই।
হঠাৎ কথা বলে উঠল রায়ান,
-মাফ করবেন, আপনার ওয়াশরুমটা ব্যবহার করতে পারি?
-হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। যে করিডোর ধরে এসেছেন তার অপরদিকে দুটো রুম পরেই পাবেন। আপনি চিনবেন নাকি খানসামাকে ডাকব?
-ধন্যবাদ। আমিই যেতে পারব।


কিছুক্ষণ পর ফিরে এল রায়ান। ততোক্ষণে অভিশাপের কথা শেষ করেছেন চৌধুরী সাহেব। রায়ান প্রশ্ন করল,
-মিউজিয়ামের মূর্তিটা যে চুরি হয়েছে জানেন?
-হ্যাঁ। পরদিন সকালেই আমাকে কিউরেটর সাহেব ফোন করে জানিয়েছেন। অনেক বিপদে ফেলে দিল।
-কেন? ওটা চুরির সাথে আপনার কি বিপদ?
-মিউজিয়ামকে আমার বাবা দিয়েছিলেন ওটা। তাও ফেরত শর্তে। শুধুমাত্র প্রদর্শনীর জন্য। কোন প্রয়োজন হলে বিনা শর্তে ফেরত পাবার নিয়ম আছে। ব্যাবসার দিনকাল বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই খারাপ হওয়া শুরু করেছিল। আমার ছেলেটাও গত বছর মারা গেল। ভাবছিলাম হয়ত মূর্তিটা বিক্রি করে বাপদাদার সম্পত্তি রক্ষা করব। কিন্তু সেটাও হল না।
রুনি বলল,
-ভেঙ্গে পড়ছেন কেন? আমরা তো খুঁজছি। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
-আপনারা খুজছেন মানে? আপনারা গোয়েন্দা নাকি?
থতমত খেয়ে গেল রুনি। ফস করে বলে ফেলেছে। সামাল দিল রায়ান,
-কেন? সাংবাদিকতাও তো এক ধরনের গোয়েন্দাগিরি। জানেন না? আমরাও খোঁজ খবর করছি আর কি। যদি পেয়ে যাই...
-পেলেই ভাল। একজন ডিলারের সাথেও যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই মূর্তি গেল।
ফজলুর সাথে কে যোগাযোগ করেছিল বুঝতে পারল রায়ান। অন্য ব্যাপারে জানতে চাইল,
-আচ্ছা আপনাদের বংশের এই মূর্তি তো দুটো ছিল। আরেকটা গেল কই?
-আসলে অনেকের বিশ্বাস ওটা নেই। আবার অনেকের বিশ্বাস আছে।
-আপনার কি মত?
-আমার ধারনা আছে। আমাদের গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদারের আমল থেকেই ওটার কোন খোঁজ নেই। উনি অবশ্য রহস্য করে তার ছেলেকে বলতেন, “সৌভাগ্যকে আর দুর্ভাগ্যকে আলাদাভাবে দেখ না। সৌভাগ্যেই লুকিয়ে আছে সে, সৌভাগ্যেই তার বন্দিত্ব, তার ঠিকানা।” যদিও এর কোন অর্থ এখন পর্যন্ত কেউই বের করতে পারেনি।
আর তেমন কিছু জানার নেই, তাই উঠতে চাইল রায়ান। চৌধুরী সাহেব বললেন,
-চলুন, এগিয়ে দিয়ে আসি আপনাদের।


একটা ঘর পার হওয়ার সময় দুজন লোককে একটা বড় মূর্তি সরিয়ে আনতে দেখতে রুনি। হেসে ফেলল। চৌধুরী সাহেবের সাথে সামনে এগিয়ে গিয়েছিল রায়ান। হাসির শব্দে থমকে দাঁড়াল,
-কি ব্যাপার?
-না তেমন কিছু নয়। আসলে এমন জুটি খুব কমই দেখা যায়, তাই হেসে ফেললাম।
ওর নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে লোকগুলোকে দেখল রায়ান। একজন ভীষণ মোটা, অপরজন ভীষণ হ্যাংলা। রুনি চৌধুরী সাহেবকে প্রশ্ন করল,
-মূর্তিটা অনেক পরিচিত লাগছে!
-লাগতেই পারে। এটাও অনেক পুরনো মূর্তি। সৌভাগ্যের মূর্তিটার একটা বড় কপি এটা। আমার গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার এটা কেন তৈরি করিয়েছিলেন কে জানে!
-কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এরা?
-আসলে মিউজিয়ামের মূর্তিটা চুরি যাওয়ায় আমার সামনে বেশ কিছু অ্যান্টিক বিক্রি করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। মিউজিয়াম মূর্তিটা দিতেও একটু গড়িমসি করছিল, বাবার সাথে চুক্তির সেই কাগজপত্র পাচ্ছিলাম না খুঁজে। এখন আমও গেল, ছালাও গেল। এগুলোই বিক্রি করতে হচ্ছে।
-শুনে খারাপ লাগলো।
অনেক উপরের তাকের একটা অ্যান্টিক নামাতে হবে। কিন্তু কোন মই পাওয়া যাচ্ছে না। ওদেরকে অবাক করে দিয়ে মোটা লোকটা লাফ দিয়ে ঐ তাক ধরে ঝুলে পড়ল। অন্য হাতে অ্যান্টিকটা তুলে নিয়ে আলতোভাবে নেমে এল। রায়ানের কুচকে থাকা ভুরু আরও কুচকে গেল। রুনির মুখ হা হয়ে গিয়েছে। তা দেখে চৌধুরী সাহেব হেসে বললেন,
-শম্ভু আর রম্ভু আগে সার্কাসে ছিল। শম্ভুর মতো লম্ফবীর আর রম্ভুর মতো দরাবাজিকর খুব কমই আছে।
-ওহ। আচ্ছা, আমরা তাহলে চলি?
-ঠিক আছে। খোদা হাফেজ।


বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠেই জিগ্যেস করল রুনি,
-ব্যাপার কি? এতো চুপচাপ কেন?
-লোকগুলো বেশ চিন্তার উদ্রেক করল।
-মানে?
-চুরির রাতে ভিডিও ফুটেজে মুখোশ পড়া যে দুটো লোককে দেখতে পাই, তাদের সাথে হুবুহু মিলে যায় এদের বিবরন।
-যাহ! এরকম তো কতই থাকে!
কড়া ব্রেক কষে গাড়ি থামাল রায়ান। রুনির দিকে ফিরে বলল,
-চৌধুরী সাহেবের জরুরি টাকার প্রয়োজন, মিউজিয়ামের মূর্তি আদায়ে ঝামেলা, অমূল্য মূর্তি চুরি, এখন সেই লোকগুলো । শম্ভু আর রম্ভু। আসগর চৌধুরীকে দায়ী করতে আর কি প্রয়োজন?
-নাহ। কথা ঠিকই আছে। তবে সব কিছু খুব সহজ মনে হচ্ছে না?
-পানির মতো সহজ। এখন পানিকে বিশ্লেষণ করতেই যত ঝামেলা। একটা কাজ করতে পারবে?
-ফর ইউ স্যার? নো। বাট ফর নিউজ? এনিথিং। কি কাজ?
-মিউজিয়ামের সব স্টাফদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে হবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যাংক ব্যালেন্স। গত কিছুদিনে কারও অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কিনা, সেসব।
-পারব। তুমি নিজের ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে কাজটা করাচ্ছ না কেন?
-তাতে বহুদিন সময় লাগবে। ওখানে তোমার মতো কাজ পাগল মানুষের অনেক অভাব।
-ঠিক আছে। আমি তোমাকে যত দ্রুত সম্ভব জানাব। এখন গাড়িটা চালু করবে?
-গাড়ি থামিয়েছে কে!?
গাড়ি যে ব্রেক করে থামিয়েছে সেটা ভুলেই গিয়েছিল রায়ান। সেটা দেখে একচোট হেসে নিল রুনি। গাড়ি চালু করল রায়ান।


এক সপ্তাহ পর। ভোর পাঁচটা।
ফোন বেজে উঠল রায়ানের। চুপচাপ বসে বসে গান শুনছিল রায়ান। দুবার রিং হতে তুলে নিল,
-এসময় আমি কারও বিরক্ত করা পছন্দ করি না। সুতরাং আশা করি কোনও জরুরি কারনেই ফোন করেছ।
থমথমে শোনাল ওপাশে নাফিজের গলাটা,
-আপনি কি একটু সাগরিকা রুনির বাসায় আসতে পারবেন?
-কেন?
-উনি আত্মহত্যা করেছেন।
-হোয়াট?
-আপনি আসবেন স্যার?
-আসছি।

আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল রায়ান। দরজায় দাঁড়ানো কনস্টেবল ওকে দেখে স্যালুট দিল। উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকল রায়ান। বেডরুমে লাশটা রাখা। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে লাশের মুখের উপর থেকে কাপড় সরাল রায়ান। কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে নাফিজ। মুখটা এক নজর দেখেই আবার ঢেকে দিল। নাফিজ বলল,
-ফ্যানের হুকের সাথে দড়ি বেধে ঝুলেছে।
চাপাস্বরে গর্জে উঠল রায়ান,
-ভুল।
-জি স্যার?
-তুমি আমি দুজনই জানি এটা আত্মহত্যা হতে পারে না।
-সব প্রমান আত্মহত্যার দিকেই নির্দেশ করছে। আপনার বুঝা উচিত স্যার।
-ও একটা কাজের মাঝখানে ছিল, ও ভাল ছিল, সুখি ছিল। আত্মহত্যার মতো বাজে একটা কাজ করার মতো মেয়ে ও না।
আর কিছুই না বলে চুপচাপ বেরিয়ে এল রায়ান।


সারাদিন ঘরে পায়চারি করে কাটালো। ও ভাবছে যে ওর ভুলের কারনেই মারা গেছে রুনি। রুনিকে কিছুতেই এতে জরানো উচিত হয়নি। কোন কাজ না পেয়ে শেষে কম্পিউটার ওপেন করল। বেশ কিছু মেইল অ্যালার্ট জমে আছে। প্রথম মেসেজটা রুনির! গতরাতে পাঠানো! দ্রুত ওপেন করল রায়ান। ওটা রুনির যোগাড় করা মিউজিয়ামের স্টাফদের তথ্য। পড়তে পড়তে চোখমুখ শক্ত হয়ে এল রায়ানের। ফোন করল নাফিজকে,
-জি স্যার, বলুন।
-শাহাদাতকে নিয়ে থানায় থাক, আমি আসছি।
কিছুক্ষনের মধ্যেই রায়ান পৌঁছে গেল থানায়। ওদেরকে সব কথা জানিয়ে নিজের প্ল্যানটা খুলে বলল রায়ান। এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল ওরা।


পরদিন সকালে পুলিশ আসগর চৌধুরীকে গ্রেফতার করল মূর্তি চুরির মূল হোতা হিসেবে। তার দুই সাগরেদকে পাওয়া গেল না। দুজনই একরাত আগে থেকে লাপাত্তা। সরকারের তরফ থেকে ১৫দিনের রিমান্ড মঞ্জুর।


দুই দিন পর কিউরেটর সাহেবের চায়ের দাওয়াতে তার অফিসে এল রায়ান এবং নাফিজ। ওদের যত্ন করে বসিয়ে চা পরিবেশন করল কিউরেটর। এরপর বললেন,
-কংগ্রাচুলেশনস। আপনারা তো সত্যিই অবাক করে দিলেন আমাকে। এখন আমার মূর্তিটা পাওয়া গেলেই হল।
নাফিজ বলল,
-নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। পুলিশের গুঁতা যে খায় সে সারাজীবনেও আর কখনও কথা লুকানর কথা ভাবতে পারেনা। পনেরদিন তো কিছুই না। আমি আগামী দুইদিনের মধ্যেই ঐ ব্যাটার কথা বলার নিশ্চয়তা দিতে পারি। তবে যদি ওর স্যাঙ্গাত দুটোকে পাওয়া যেত তাহলে আরও আগে তথ্য বের করা যেত আর কি!
-হুম।
চিন্তিত দেখাল কিউরেটর সাহেবকে। খুক খুক করে কেশে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল নাফিজ,
-আমরা পুরো শহরে জাল পেতে রেখেছি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই ওরা ধরা পড়বে আশা করা যায়।
-ভাল, ভাল।
-চায়ের জন্য ধন্যবাদ। খজাখুজির কাজে তদারকি করতে হবে আমাদের। আমরা তাহলে এখন চলি?
-নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
কিউরেটর আবার ভাবনায় ডুবে গেলেন। ওরা বিরক্ত না করে বেরিয়ে এল।

অন্ধকার ঘরে বসে অপেক্ষা করছে রায়ান, নাফিজ, শাহাদাত। ফোনটা বেজে উঠতে ধরল রায়ান। ওপাশের কথা শুনে চুপচাপ রিসিভার নামিয়ে রাখল। বলল,
-সময় হয়েছে, চল সবাই।

ফজলুর দোকানের ভেতরের দুনম্বুরি দোকান।
চাদর মুড়ি দেয়া এক লোক ঢুকল। কোলে একটা ভারি বস্তা। রুমে ঢুকে টেবিলের অন্যপাশে বসলো ফজলু। লোকটা টেবিলের ওপর জিনিসটা রেখে বস্তা সরিয়ে নিল। বেরিয়ে পড়ল সেই চুরি হওয়া অমূল্য মোঘলমূর্তি। সেই সাথে ঘরের কোনের দুটি বড় মূর্তির আড়াল থেকে উদ্যত পিস্তল হাতে বেরিয়ে এল রায়ান আর নাফিজ। ওদের দেখে গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে কোমরে গোঁজা রিভলভার ফজলুর দিকে তাক করল আগন্তুক। ওদের বলল,
-অস্ত্র ফেলে দিন নাহলে আমি গুলি করব!
নাফিজ জবাব দিল,
-বোকামি করবেন না কিউরেটর সাহেব। আপনি পালাতে পারবেন না।
-পারি কিনা সেটা আমি দেখব। আমি তিন গুনব, অস্র না ফেললে আমি ওর মাথায় গুলি করব। ১...
পিস্তল নামাল নাফিজ। রায়ান পিস্তল নামানর ধারেকাছেও গেল না। ফজলুকে কাভার হিসেবে ব্যবহার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কিউরেটর হক। যাওয়ার পথে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাহিরের দরজা বন্ধ হতেই দরজায় এক সাথে ঝাপিয়ে পড়ল নাফিজ আর রায়ান। ভারি দরজার কিছুই হল না। বাহিরে একটা গুলির শব্দ শোনা গেল। দরজার লক আন্দাজ করে পিস্তলের ম্যাগাজিন খালি করল ওরা দুজন। এবার হাতল ঘুরাতেই খুলে গেল দরজা। পিস্তলে নতুন ম্যাগাজিন ভরে বেরিয়ে এল ওরা।


রাস্তায় ফজলুকে বসে থাকতে দেখল ওরা, পায়ে গুলি খেয়েছে। ওদের দেখে রাস্তার একদিক দেখিয়ে চিৎকার করল ফজলু,
-ঐদিক গেছে স্যার, ঐদিকে।
নাফিজকে ফজলুর গাড়ি নিয়ে যেতে বলে দ্রুত ফজলুকে বয়ে দোকানে নিয়ে এল রায়ান। ফজলু বলল,
-আমি ব্যান্ডেজ করতাসি স্যার, আপনে যান।
নিজের গাড়ির দিকে রওনা হল রায়ান। গাড়িতে বসে এজেন্সির আনিসকে ফোন করল। কিউরেটরের ফোনের জিপিএস লোকেশন পয়েন্ট করে রায়ানকে এক্সেসেস কোড দিল আনিস। রায়ানের গাড়ির জিপিএস ট্র্যাকারে ফুটে উঠল কিউরেটরের ছুটন্ত গাড়ির অবস্থান। গাড়ি ঘুরিয়ে নিল ও।


ফজলুর দেখান ডিরেকশনে ঝড়ের গতিতে কিছুক্ষণ এগোতেই কিউরেটরের গাড়ি দেখতে পেল নাফিজ। ধাওয়া করতে লাগলো। কিন্তু কিউরেটরও ওস্তাদ ড্রাইভার। কিছুতেই ধরা দিল না। কয়েকবার এক্সিডেন্ট করতে করতে বেঁচে গেল দুটো গাড়িই। কিছুতেই মাঝের দূরত্ব কমাতে পারছে না নাফিজ। আসতে আসতে দূরত্ব বাড়ছেই। নাফিজের মনে হতে লাগলো কিউরেটরকে আর ধরতে পারবে না। এমন সময় দূরে তাকিয়ে চমকে গেল ও। একটা বাঁক ঘুরে কিউরেটরের গাড়ির সরাসরি সামনে এসে থেমেছে রায়ানের গাড়ি। চমকে গিয়ে ব্রেক করল কিউরেটর। শেষ রক্ষা হল না। স্কিড করে রায়ানের গাড়িতে বাড়ি খেয়ে থামল কিউরেটরের গাড়ি। পিস্তল হাতে গাড়ি থেকে নামল কিউরেটর হক। গাড়িতে বসে থেকেই গুলি করল রায়ান। কিউরেটরের হাতে গুলি লেগে ঝাকি খেয়ে পিছিয়ে গেল। আহত হাত থেকে রিভলভার ফেলে দিয়ে হাত চেপে বসে পড়ল সে।
তাকে বলল রায়ান,
-দ্বিতীয়বার কোন ভুল করার আগে একটা কথা জেনে রাখুন মিঃ হক, পরের গুলিটা আমি আপনার মাথার জন্য বরাদ্ধ রেখেছি।
পরাজিত রাজার মতো থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে কিউরেটর মাহবুব হক। ওর রিভলভার কুড়িয়ে নিল নাফিজ। একটা পরিস্কার কাপড় দিয়ে গুলি লাগা জায়গাটা ব্যান্ডেজ করে দিল। রায়ানকে জিগ্যেস করল,
-এখন কি স্যার? কোথায় যাব?
-চলো যেখান থেকে আসলাম, সেখানেই যাই। সবাইকে সেখানেই আসতে বলেছি।
রায়ানের জীপের পেছনে বসলো রায়ান আর কিউরেটর। ড্রাইভ করল নাফিজ। ফিরে এল অ্যান্টিক শপে। দুনম্বর দোকানে ঢুকল। ঢোকার পর ঘরে শাহাদাত, হাতকড়া পড়ানো শম্ভু-রম্ভু আর মুক্ত আসগর সাহেবকে দেখে চমকে উঠল কিউরেটর। টলে উঠল। একটা চেয়ার এগিয়ে দিল ফজলু, কিউরেটরের বসার জন্য। রায়ান জানতে চাইল,
-লোকটার এতদিনের প্ল্যান নষ্ট করলাম, অন্তত সব জানার অধিকার আছে তার। সান্ত্বনা পুরস্কার। কি বল তোমরা?
নাফিজ মাথা ঝাঁকাল। ফজলু বলল,
-আপনার যা মর্জি। তার আগে গেস্টদের ডাকি স্যার?
-নিশ্চয়ই।

পাশের ঘর থেকে হাতকড়া পড়া রম্ভু-শম্ভু আর মুক্ত আসগর সাহেবকে নিয়ে এল ফজলু।
দেখার মতো চেহারা হল কিউরেটরের। রায়ান বলতে শুরু করল।

-তোমার উপর সন্দেহটা প্রথম দিকে একবারেও আসেনি। চৌধুরী সাহেবের উপর সন্দেহ ফেলার প্ল্যানটা ভালই সাজিয়েছিলে। তোমার চৌধুরী সাহেবকে ফাঁসানর জন্য শম্ভু আর রম্ভুকে ওনার বাগানবাড়ির চাকরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া কোন কাজেই আসেনি। ওনার বাড়িতে ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে চারপাশ ঘুরে দেখছিলাম। তখন শম্ভু আর রম্ভুকে দেখে অনেক অবাকই হয়েছি। ওরা তখন একটা একটা করে অ্যান্টিক বাহিরের ট্রাকে নিয়ে তুলছিল। ওদের ব্যাপারে সিওর হওয়ার জন্য ওরা ঘর থেকে বের হতেই ওদের লিস্টের শেষের দিকের একটা আইটেম মই দিয়ে তাকের উপর উঠিয়ে রেখে দেই। তারপর মইটা স্টোররুমে লুকিয়ে ফেলি। চৌধুরী সাহেবের সাথে দ্রুত কথা শেষ করে বের হয়ে আসার সময় শম্ভুর লাফ দেওয়া দেখে আর কোন সন্দেহ থাকে না ওদের ব্যাপারে। সেই সাথে আরেকটা ব্যাপার মনে পরে যেটা অনেক আগে থেকেই মাথায় আসি আসি করেও আসছিল না। মিউজিয়ামের প্রতিটি জানালা দরজায়, এমনকি স্কাইলাইটেও সেন্সর রে অ্যালার্ম লাগানো আছে। ঐ অ্যালার্ম বন্ধ করা মিউজিয়ামের ভেতরের কারও ছাড়া সম্ভব না। এছাড়া কন্ট্রোলরুমের টেকনিশিয়ানের হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়াও আমার কাছে স্বাভাবিক লাগেনি। তখন বুঝতে পারলাম মিউজিয়ামের ভেতরের লোকও জড়িত আছে। আমাদের সাংবাদিক সঙ্গী রুনিকে বললাম স্টাফদের তথ্য যোগাড় করতে। ও তথ্য যোগাড় করে আমাকে পাঠায় ঠিকই কিন্তু তোমার স্টাফ, সেই সাথে তোমার ব্যাপারে তথ্য যোগাড় করার কথা কোনোভাবে তুমি জেনে ফেল। তারপরেই তোমার নির্দেশে রম্ভু আর শম্ভু ওকে খুন করে। ওরা জবানবন্দি দিয়েছে। রুনির যোগাড় করা তথ্যের মাধ্যমে তোমার অর্থনৈতিক অবনতি, গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে থাকা, বিদেশে যাওয়ার কাগজপত্র তৈরি করে রাখা এসব জানতে পারি। ঘটনা বুঝতে কোন সমস্যাই হয়নি। চৌধুরী সাহেব ইতোমধ্যেই তার অ্যান্টিক বিক্রি করে নিজের সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন, এছাড়াও মূর্তির চুক্তি সংক্রান্ত কাগজপত্রও খুঁজে পেয়েছেন। তাকে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। তাই তার সাহায্য চাইতেই তিনি আমাদের প্ল্যানে যোগ দিলেন। তোমার খেল খতম কিউরেটর, খেল খতম। শুধু চুরি নয়, খুনের দায়েও তোমার বিচার করা হবে।
কিউরেটর হকের মুখে কোন কথা নেই, মনে হচ্ছে সে পাথর হয়ে গেছে। শাহাদাতকে ইশারা করল রায়ান। এগিয়ে এসে টেনে তুলল তাকে শাহাদাত। সবাইকে নিয়ে বাহিরের দোকানে চলে এল ওরা। কনস্টেবলদের সাহায্যে অপরাধীদের জীপে তুলে নিয়ে চলে গেল শাহাদাত।


নাফিজ আর ফজলুকে ইশারা করতেই ওরা ভিতরের ঘরে চলে গেল।
চৌধুরী সাহেবকে বলল রায়ান,
-আমি কিন্তু শুধু একটা মিউজিয়ামে চুরির কারনে এই কেসে হাত দেইনি চৌধুরী সাহেব। এখানে আমার আসার কারণ ভিন্ন।
পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে দিল রায়ান। বলল,
-আমার প্রিয় বন্ধু সুমন মৃত্যুর আগে এই চিঠিটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিল।
-সুমন! মানে আমার ছেলে সুমন? তুমি ওকে চিনতে?
-জি, চিনতাম। আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল ও। আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওর সাথে ছিলাম। আমাকে বাঁচাতে গিয়েই ও খুন হয়েছে।
কয়েক মুহূর্ত কোন কথা বলল না চৌধুরী সাহেব। চিঠিটা খুললেন,
-
প্রিয় বাবা,
আমার সালাম নিবেন। আমি জানি আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট। আপনি চান প্রায় ভগ্নপ্রায় আমাদের পারিবারিক ব্যবসার হাল যেন আমি ধরি। কিন্তু বাবা, ব্যবসা আমি বুঝি না। তাই তো বাড়ি থেকে পালিয়ে আর্মিতে ঢুকলাম। এখানে প্রতিদিন জীবন, মৃত্যুর আনাগোনা দেখতে দেখতে কখনও ইচ্ছে করে ফিরে চলে আসি আপনার কাছে। কিন্তু তখন আমার প্রিয় বন্ধু সৌরভের কথা কানে বাজে। ও বলে, “জানিস সুমন, দেশটা আমাদের মায়ের মতো। আমাদের যাদের মা নেই তাঁদের তো এই দেশই একমাত্র মা। তাই মায়ের নিরাপত্তা রক্ষায় আমি লড়ে যাই।” আপনি ওর সাথে কখনও দেখা হলে অবাক হবেন। ও দেখতে অনেকটা আমারই মতো। কখনও যদি আপনি কোনও বিপদে পড়েন, আমার হয়ে সৌরভ আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে, দেখবেন। ভাল থাকবেন। সম্ভব হলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
ইতি,
আপনার সুমন।
রায়ান পড়া শেষ হতে বলল,
-আমার নাম রকিব রায়ান না, আমার নাম সৌরভ রায়ান।
কোনোকথা বলতে পারলেন না আসগর চৌধুরী। নিরবে কেঁদে গেলেন।

অন্যরুম থেকে মূর্তিটা নিয়ে এল নাফিজ আর ফজলু। ওদের দেখে ধাতস্থ হলেন চৌধুরী সাহেব। মূর্তিটা ছিল চৌধুরী সাহেবের বাসায় দেখা সৌভাগ্যের মূর্তির বড় কপিটা। ওটা দেখিয়ে বলল রায়ান,
-আপনার গ্রেট গ্রেট গ্রেট সেই গ্র্যান্ডফাদারের ধাঁধার সমাধান করেছি আমি। তাঁর সেই লাইনটা,“সৌভাগ্যেই লুকিয়ে আছে সে, সৌভাগ্যেই তার বন্দিত্ব, তার ঠিকানা।”
একটা হাতুরি তুলে নিয়ে সাবধানে বাড়ি দিল রায়ান। বারি দিতে দিতে আস্তে আস্তে পুরো মূর্তিটা ভেঙ্গে ফেলল। ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল হারানো সেই দুর্ভাগ্যের মোঘলমূর্তি।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চৌধুরী সাহেব। অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলেন,
-এতদিন আমাদের সাথেই ছিল! অথচ কেউ একবার ভেবেও দেখেনি!! আপনি সত্যিই জিনিয়াস রায়ান সাহেব। দা রিয়েল জিনিয়াস।
-যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করি?
-নিশ্চয়ই।
-এখন কি করবেন মূর্তিগুলোর?
-দুটো মূর্তিই মিউজিয়ামকে দিয়ে দেব। ওখানেই এর আসল স্থান। আমার সমস্যা তো সমাধান করেই ফেলেছি। এগুলোর আর দরকার নেই আমার।
সবার মুখেই হাসি ফুটে উঠল। আপাতত ফজলুর দায়িত্বেই মূর্তিগুলো রেখে বিদেয় নিলেন আসগর চৌধুরী। ফজলুর কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে রায়ান আর নাফিজও বেরিয়ে এল।



রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল নাফিজ,
-এবারকার কেসটা কিন্তু সত্যিই অনেক টাফ ছিল। তবে আপনার সাথে এরচেয়েও টাফ কেসে কাজ করতে পারলে মন্দ হয়না স্যার।
আনমনে বলল রায়ান,
-হয়ত।
-স্যার একটা প্রশ্ন করতে পারি?
-করো।
-স্যার আপনি আর্মি থেকে অবসর নিলেন কেন?
-আমার প্রিয় বন্ধু মৃত্যুর আগে আমাকে অবসর নিতে অনুরোধ করেছিল। আমি মানসিকভাবে তখন আর্মির একটিভ সার্ভিসের জন্য উপযুক্ত ছিলাম না। ওর শেষ ইচ্ছেটা সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করতে পারলাম না।
-ও আচ্ছা।
রায়ানের মুখের দিকে চাইল নাফিজ। কি যেন একটা ঠিক নেই ওখানে। বলল,
-স্যার আপনাকে ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কি ব্যাপার?
-যে যাই বলুক রুনির মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী নাফিজ। সবাই এই কেস আমার সাফল্য হিসেবে দেখলেও আমি একে আমার ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য করি।
পরিচিত এক স্বর শোনা গেল,
-তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি সকল অনুভুতির ঊর্ধ্বে!
শব্দের উৎস খুঁজতে পিছনে তাকাল রায়ান। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রুনির হাসিমুখের দিকে! নিজের হাতে চিমটি কাটবে নাকি কাটবে না বুঝতে পারছে না। এগিয়ে এল রুনি, হাত বাড়িয়ে চিমটি কাটল রায়ানের হাতে। নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইল রায়ান। বিরক্ত হয়ে বলল রুনি,
-এতো দেখছি মানুষ না, রীতিমতো গণ্ডার! এই...
ওকে ধরে ঝাঁকাল রুনি। সাহায্যের আশায় নাফিজের দিকে তাকাল রায়ান। কিন্তু কোথায় নাফিজ? সে উধাও! আবার রুনির দিকে ফিরল রায়ান। ওকে তখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-কিভাবে সম্ভব?
-বলছি। হাঁটতে হাঁটতে বলি?
মাথা ঝাঁকাল রায়ান। ফুটপাথে হাঁটা শুরু করল ওরা।
রুনি বলল,
-অফিসের কম্পিউটার থেকে মিউজিয়ামের প্রাইভেট ডাটাবেজে হ্যাক করে ঢুকেছিলাম ইনফরমেশনের জন্য। সরকারের পক্ষ হতে কিউরেটরকে বেশ কয়েকবার ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে দেখলাম, মিউজিয়ামের ফান্ডের হেরফের সংক্রান্ত। সন্দেহ হয়, তাই একবার কিউরেটরের পার্সোনাল কম্পিউটার হ্যাক করার চেষ্টা করি। সেখানে পেলাম তার সব অনিয়ম, অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর নিচু মনমানসিকতার পরিচয়। কাজের মধ্যে এতো ব্যাস্ত ছিলাম যে কখন কিউরেটরের সেফ গার্ডে ধরা পড়ে গিয়েছি তা টেরই পাইনি। কিউরেটরের সেফগার্ড আমার লোকেশন, অফিসের ঠিকানা ট্রেস করে ফেলে। বিপদ টের পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। বুঝতে পেরেছিলাম কিউরেটরের বুঝতে কোন সমস্যা হবে না কার কাজ এটা। রাতে বাসায় ফেরার পথে টের পেলাম পেছনে শম্ভু আর রম্ভু লেগেছে। তোমাকে ফোন করে পেলাম না। দ্রুত এক সাইবার ক্যাফেতে বসে তোমাকে তথ্যগুলো মেইল করে দেই। অফিসার নাফিজের থানা আমার বাসার কাছেই। তাই নাফিজকে ফোনে অনুসরণকারীর কথা জানালাম। সে প্রোটেকশনের জন্য দুজন পুলিশ নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে আসার জন্য রওনা দেয়। আমি বাসায় পৌঁছে দরজা লক করে দেই। কিন্তু এরই মাঝে জানালা দিয়ে দড়ির সাহায্যে আমার ঘরে ঢুকে পরে রম্ভু। ওর সাথে শক্তিতে পারলাম না। গলায় দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। শেষ চেষ্টা হিসেবে দম বন্ধ করে মরে যাওয়ার ভান করলাম। আল্লাহ্‌র রহমতে কাজে লেগে গেল। শ্বাস না পেয়ে ভাবল আমি মরে গেছি। জানালা দিয়ে নেমে যাওয়ার পথে নিচে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল শম্ভু। ওকে দেখে ফেলে নাফিজ। রম্ভুও নিচে নেমে ধরা পড়ল ওদের হাতে। পুলিশদের জিম্মায় ওদের রেখে ছুটে উপরে এল নাফিজ। আমি বেঁচে আছি বুঝতে পেরে পানির ঝাপটা দিয়ে, পা ম্যাসেজ করে, পানি খাইয়ে আমাকে সুস্থ করে তুলল। ভেবে দেখলাম তোমাকে না জানালেই ভাল।
ততক্ষণে ঘটনা বুঝতে পেরে নিজের ভাবমূর্তি গ্রহন করল রায়ান। বলল,
-আমাকে জানালে কি ক্ষতি হত?
-বারেহ! যদি আমাকে খুন করা হয়েছে এই কথা তোমার মাথায় না থাকতো তাহলে কি আর এভাবে উঠেপড়ে লেগে এতো তাড়াতাড়ি কেসটা সলভ করতে পারতে?
নিশ্চুপ রইল রায়ান। আবার বলল রুনি,
-তো, বন্ধুত্বে আপত্তি আছে এখনও?
-ভেবে দেখতে হবে।
হেসে ফেলল রুনি।
-এবার ডিল সম্পূর্ণ করো। এই কেসের খুঁটিনাটি সব কিছু জানাও আমাকে।
-সব কিছু তো আর বলা যায় না। কিছু অফিশিয়াল সিক্রেট আছে। এছাড়া বাকিটা বলা যাবে। তুমি তা দিয়ে বেশ ভালই একটা প্রতিবেদন করতে পারবে আশা করি।
-ফেয়ার এনাফ। সেটা শুনতে কোথায় যাছি আমরা?
-যেখানে পথের শেষ হয়...


সমাপ্তি
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিরপেক্ষতা চাই, তবে রিমোট কন্ট্রোলটা আমাদের হাতে থাক !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:০২



যখন কেউ রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে, "আমরা নির্বাচনে অংশ নিবো , তবে নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ছাড়া নয়," তখন বুঝতে হবে—ব্যাপারটা ঠিক ভোট নয়, বিষয়টা আম্পায়ার। আম্পায়ার যদি আগেই খেলার স্কোর জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সরকার রক্ষার আন্দোলন

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:২৭



৩রা অগাস্ট , ২০২৪ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঐতিহাসিক এক দফায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন সহ সকল গুম, খুনের বিচারের আওয়াজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৮ মাসে এক কোটি চাকরি—রাজনীতি হবে সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা!

লিখেছেন মুনতাসির, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:১৩

দেশের বড় এক রাজনৈতিক শক্তি ঘোষণা দিয়েছে, ক্ষমতায় আসলেই মাত্র ১৮ মাসে সৃষ্টি হবে এক কোটি নতুন চাকরি। দেশের সাধারণ মানুষ তো খুশিতে আতঙ্কিত—খুশি এ কারণে যে চাকরি আসবে, আতঙ্কিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

রিযিক ও হিকমাহ: আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত নিয়ামতের অন্তরঙ্গ উপলব্ধি

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৮:৫১

রিযিক ও হিকমাহ: আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত নিয়ামতের অন্তরঙ্গ উপলব্ধি

ছবি অন্তর্জাল থেকে।

মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় নিয়ামত কী? অনেকেই বলবেন—অঢেল ধন-সম্পদ, বিলাসবহুল জীবনযাপন, উচ্চশিক্ষিতা ও রূপবতী স্ত্রী, কিংবা দামি গাড়ি। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসসালামু আলাইকুম। শুভ সকাল!

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:০৪





মাঝেমধ্যে খুব বেশি মন চায় চলে যাই চিরঘুমের দেশে।
এতো বেশি চষে বেড়িয়ে মূর্খের মতো ভেবেছিলাম জমেছে কিছু সঞ্চয়।
কিন্তু বেলা শেষে দেখি সবই অনাদায়ী দেনা সঞ্চিতি!



মাঝেমধ্যে মনে হয় নিদেনপক্ষে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×