একটা প্রবাদ আছে ঘরের শত্রু বিভীষণ। যে আপনার প্রকাশ্যে শত্রু সে আপনার জন্য তেমন একটা ক্ষতির কারন হবে না কারন আপনি তার ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু শত্রু যদি বন্ধুর ছদ্মবেশে আপনার সাথে ঘুরে বেড়ায় সে আপনার জন্য যমদূত সমতুল্য, কারন আপনি তার ব্যাপারে সচেতন থাকবেন না। ইতিহাস ঘাঁটলেও আপনি এই ব্যাপারটা দেখতে পাবেন। ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মুসলিম ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা মুনাফিকেরা। তাতারদের আক্রমণ থেকে শুরু করে হালের বাংলার নবাবের পতন সব জায়গায়ই এই ছদ্মবেশী শয়তানরা ছিল প্রধান নটের গুরু।
.
শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপিয়ানদের উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। উৎপাদিত বিপুল পরিমান পন্য বিক্রির বাজার এবং কাঁচামালের খোঁজে ইউরোপিয়ানরা তাদের নৌকাগুলো নিয়ে সারা দুনিয়া চষে বেড়ায়। দুনিয়ার নানা প্রান্তে এরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে গেলেও পরবর্তিতে এরা নিজেদের সামরিক শক্তি আর কুটচাল দিয়ে বিনা পয়সায় কাঁচামালের বাজার দখলে লিপ্ত হয়। এভাবে সারা দুনিয়াই মোটামুটি ইউরোপিয়ানরা ভাগ-বাটোয়া করে নিয়ে নেয়।
তো আমাদের এই উপমহাদেশ যা কিনা ব্রিটিশরা আসার আগে দুনিয়ার চার ভাগের এক ভাগ জিডিপি কন্ট্রিবিউট করত সেটা ব্রিটিশরা এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গারের মুনাফেকিতে দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা দখল করার আগে এদেশে মুসলিমদের শাসন চলছিলো, তো দেখা গেলো ৩ ভাগের এক ভাগ জনগন মুসলিম হলেও তাদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। মুসলিমদের প্রভাব বলয় থেকে বের করতে আর নিজেদের দাস প্রথা আরো সুসংহত করতে ব্রিটিশরা এদেশের মানুষদেরকে তথাকথিত আধুনিক সেক্যু শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইলো।
ব্রিটিশ কাফেরদের সাথে যেহেতু মুসলিমদের আইডোলজিক্যাল ক্লাশ ছিলো এবং হাজার বছর ধরে এদের সাথে ক্রুসেড চলছিল তাদের এই সেক্যু শিক্ষা গ্রহন করতে মুসলিম আলেমরা অস্বীকৃতি জানায়। আর এদেশের হিন্দুদের সাথে ইউরোপিয়ানদের যেহেতু ধর্মীয় দিক থেকে কিছু পার্থক্য থাকলেও আইডোলজিক্যাল কোন ক্লাশ ছিলনা, আর তারা আগেও প্রজা ছিল। তাই হিন্দুরা ব্রিটিশদের সুনজর পেতে ব্যাপাকভাবে ব্রিটিশ শিক্ষা গ্রহন করলো।
.
সেই সময়ে কেন মুসলিম আলেমরা ব্রিটিশদের প্রণীত সেক্যু শিক্ষা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো সেটা রিসেন্টলি নিজের সাথে একটা ঘটনা ঘটার কারনে বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। যখন ব্রিটিশ লর্ড ব্যাবিংটন ম্যাকলে বলেছিলেন এমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে যেন, এরা গায়ে গতরে হবে ভারতীয় কিন্তু মানসিকতায় হবে ব্রিটিশ। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আপনার খেয়াল রাখতে হবে যে, হিন্দুরা গায়ে গতরে মানসিকতায় ব্রিটিশ হলেও সমেস্যা নাই কিন্তু একজন মুসলিম কখনো ব্রিটিশ হতে পারে না। একজন প্রকৃত মুসলিমের জীবনের এক মাত্র চাওয়া হচ্ছে সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের একজন মুসলিম হবে। যে শিক্ষা নিলে নিজেদের দ্বীন সংকটে পরে যাবে সেই শিক্ষা নেওয়ার যৌক্তিকতা ছিলো না বলেই তখনকার আলেমরা এর বিরোধিতা করেন।
আসেন আগে দুইটা হাদিস দেখি তারপর বাকি আলোচনাটূকু করবো।
১. কাব ইবনু ইয়ায (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,"প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কোন না কোন ফিতনা রয়েছে। আর আমার উন্মাতের ফিতনা হলো ধন-সম্পদ।"
২. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাদিয়াল্লাহু আ'নহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,"তোমরা জমি-জায়গা, বাড়ি-বাগান ও শিল্প-ব্যবসায় বিভোর হয়ে পড়ো না। কেননা, (তাহলে) তোমরা দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে।"
উপরে উল্লেখিত দুইটি হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি পার্থিব ধন-সম্পদ মুসলিমদের জন্য ফেতনা স্বরূপ। এ ধন-সম্পদের ফেতান এতই মারাত্বক যে কোন নামকাওয়াস্তে মুসলিম তার দ্বীন পর্যন্ত বেচে দিতে পারে।
তো যা বলছিলাম, যেহেতু ব্রিটিশরা এদেশের ক্ষমতায় ছিল। তাদের প্রণীত শিক্ষা গ্রহন করে এদেশীয় হিন্দুরা অর্থ সম্পদ ক্ষমতার দিক দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলো। যে মুসলিমরা হিন্দুদেরকে শত শত বছর ধরে প্রজা দেখে অভ্যস্থ, সেই প্রজাদের এই নতুন অবস্থা অনেক মুসলিমকেই ধোঁকায় ফেলে দেয়। তখন মুসলিমরাও উন্নত জীবন ধনসম্পদের মোহে পরে সেক্যু শিক্ষা গ্রহন শুরু করে। সেই শিক্ষার ফলস্বরূপ আজ আমরা কিছু সেক্যুলার দ্বীনদার পেয়েছি।
.
আমি কিন্তু ভুলেও সেসব নামকাওয়াস্তে মুসলিমদের কথা বলছি না যাদের শুধু নামটাই মুসলিম। বলছি না তাদের কথাও যারা ভিতর ও বাইরে থেকে নিজের দ্বীন ফেলে দিয়ে লর্ড ম্যাকলের ব্রিটিশ হয়ে গেসে। আমি সেসব মুসলিমদের কথা বলছি যারা দেখতে, গায়ে গতরে মুসলিম কিন্তু আইডোলজি আগাগোড়াই সেক্যুলার। এরা ঘরের শত্রু বিভীষণের মত। দূর থেকে দেখলে এদেরকে আপনার সাচ্চা মুসলিম মনে হবে কিন্তু কাছে গেলে দেখবেন এরা আসলে লর্ড ম্যাকলের তৈরিকৃত ব্রিটিশ। এরা স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক লাখো লাখো মুসলিমকে ধোকা দিচ্ছে। এরা ধোঁকা দিচ্ছে ইসলামের লেবাস পরে। যারা নতুন দ্বীনের পথে আসতে চায় এসব লেবাসধারি মুসলিমদের দেখে তারা ধোঁকায় পরে যায়। মদিনার মুনাফিকরাও জামাতে স্বলাত পরতো কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিফাকি রাখতো। এই সেক্যু মুসলিমদের অবস্থাও তাই, বাইরের লেবাস কিছু নামকাওয়াস্তে ইসলামিক রিচুয়ালস পালন করে বটে কিন্তু নিজের জীবন ব্যবস্থা হিসাবে সেক্যুলার জীবন ব্যবস্থাকে কবুল করেছে।
.
এই ধরনের মুসলিমকে কেন ঘরের শত্রু বললাম সেটার একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। সাধারণত আমরা চিহ্নিত শত্রুদের ব্যাপারে সবসময় নিজেদেরকে নানানভাবে প্রস্তুত রাখি যাতে করে শত্রু আমাদের ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু যে আপনার বন্ধু, আপনি সাধারণত তার থেকে সাহায্য আশা করবেন তার থেকে কোন রকম থ্রেটতো আপনার দুরতম চিন্তায়ও আসবে না। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে মুসলিমদের যত পরাজয় হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘরের শত্রুই ছিলো প্রধান নটের ভূমিকায়।
যেসব মুসলিমরা তথাকথিত আধুনিক বা সেক্যু শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের দ্বীনের উপর পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিচ্ছে তারা যে শুধু নিজেদের আখিরাতকেই ধংস করছে তানা বরঞ্চ তারা উম্মাহর বিশাল একটা অংশেরও ক্ষতি করছে। মানসিকতায় সেক্যুলার এসব মুসলিমরা টুকটাক যতটুকু দ্বীনই পালন করে সেটাকে তারা পশ্চিমাকরন করতে চাচ্ছে। আসেন কয়েকটা উদাহরন দিয়ে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করি।
১. বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া একটা বিশাল রঙ্গমঞ্চ। এইখানে গেলে নানান কিসিমের মানুষের রঙ তামশা দেখা যায়। এইতো সেদিনও দেখলাম কোন এক নাদান মেয়ে বোরকা পরে তার হাসবেন্ডের সাথে পুলে নেমে পিক তুলে সোশ্যাল মিডিয়া কাপিয়ে দিচ্ছে। আর ভাই শুধু ওই মেয়ে কেন দুনিয়ার সব মেয়ে বিকিনি পরে পুলে নেমে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করলেও আমার সমেসস্যা নাই। যে নাদান মেয়ে এটা করছে তার যদি নুন্যতম ইসলামিক জ্ঞান থাকতো সে বুঝতো যে শুধু বোরকা পড়াটাই পরদা না। পর্দা প্রথা আরো ব্যাপক কিছু।
২. এক বন্ধুরে দেখি দাড়ি টুপি পাঞ্জাবি নিয়ে বার্থডে সেলিব্রেটসহ আরো যত পশ্চিমা কুপ্রথা আছে সেগুল পালন করতে। অথচ ভালো ক্রিশ্চিয়ানরা পর্যন্ত বার্থডে সেলিব্রেট করে না। এই নাদান যদি ইসলাম সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান রাখতো বুঝতো যে মুসলিমদের উৎসবগুলোও ফিক্সড। সে চাইলেই অন্য ধর্মের উৎসব পালন করতে পারবে না।
এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেয়া যাবে। যে সেক্যু পরিবেশে বড় হওয়া নামধারী মুসলিমরা কিভাবে নিজেদের দ্বীনের উপর সেক্যু লাইফ স্টাইলকে প্রাধান্য দিয়েছে। এইজে উপরে উল্লেখিত তারা যা করছে তাতে আমার মোটেও আপত্তি নাই। পশ্চিমা লাইফ স্টাইলে এটা স্বাধীনতা। কিন্তু তাদের লেবাস, যেটা তাদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দিচ্ছে সেটার জন্য আমার সমেস্যা। কারন আমি যখন আমার আশে পাশের মানুষজনদেরকে দাওয়াত দিতে যাই তারা বলে ভাই আপনি খারাপ বলছেন অথচ এইজে অমুক ভাই অমুক আপু এটা করছে সেটা করছে। তারাও তো হুজুর তারা কি কিছু জানে না? আমার তখন বলতে ইচ্ছা করে আরে নাদান কোন আপু ভাইয়া কি করছে সেটা ইসলাম না। ইসলাম হচ্ছে আমাদের নাবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলছেন। তাদের এই দুমুখি আচরণের সরলপ্রাণ মুসলিমরা ধোঁকা খাচ্ছে।
.
তো নিজের ঘটনাটা ছোট্ট করে বলে দেই যে কিভাবে মুসলিম লেবাসধারী সেক্যুদের ধোঁকা খেলাম। রিসেন্টলি বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতেছিলাম। মেয়ে দেখার ব্যাপারে আমি সবকিছুর উপর দ্বীনকে প্রাধান্য দিবো বলে সিধান্ত নেই। যাইহোক এক মেয়ে দেখলাম, আপাতদৃষ্টিতে তার পরিবার আমাদের সমাজ মতে বেশ ধার্মিক। আর আমিও এমন ধার্মিক ফ্যামিলিই খুজতেছিলাম। ভাবলাম বেশ ভালই হইলো খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হইলো না মিল মত পেয়ে গেলাম। এরপর যখন বিয়া নিয়া বাকি সব কিছু ম্যানেজ করতেছিলাম বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত তাদের একে একে সেক্যু রূপ বের হওয়া শুরু করলো। এসব দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! তাদের এই ডাবল ফেস দেখে আমি কিংকর্তব্য বিমুড় হয়ে তাদের পরিবারের বিয়ার কথা ভুলে যাই। সেই মেয়ের পরিবারের বাহিরের লেবাস ছিল ইসলামিক কিন্তু ভিতরে আগাগোড়া সেক্যুলার। তো যাইহোক শেষমেশে তারা নিজেদের আইডোলজির সাথে না মিলার কারনে রাজি না হয়ে আমাকে বাচিয়ে দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ্। (গিবত হবে দেখে এসব ডাবল ফেসওয়ালাদের ভণ্ডামির পূর্ণ বিবরণ দিলাম না)
.
মহান রব আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে মুসলিম হওয়ার তৌফিক দান করুন। সেক্যুলারসহ যত তন্ত্র মন্ত্র আছে এসব থেকে আমাদের হেফাযত করুন। আমাদেরকে সেই মুসলিম বানিয়ে দিন যে মুসলিম হয়েছিলেন সাহাবীরা। যারা শুধু ইসলাম গ্রহনের ফলে নিজেরা অন্য এক মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।
.
বিঃদ্রঃ লেখাটা বুঝার সুবিধার্থেই এমন টাইটেল দেয়া। মুসলিম কখনও সেক্যুলার হতে পারে না, আর সেক্যুলার কখনও মুসলিম হতে পারে না। ইসলাম একটা ঘরের মত এখানে অর্ধেক ভিতরে আর অর্ধেক বাইরের রাখার সুযোগ নাই। হয় কেউ ইসলামে পরিপূর্ণ প্রবেশ করবে নচেৎ সে ইসলামের বাইরে থাকবে।
**আপনি গণতন্ত্র ব্যবস্থায় আছেন এখানে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। আপনার মতের সাথে না মিললে তাকে ভিন্নমত বলে তার কমেন্ট বক্সে এসে ঝাগড়া ঝাঁটি করবেন না। আপনার কমেন্টই আপনার বংশের পরিচায়ক।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২৩ ভোর ৫:৪০