সকাল ৬ টা ৩২। এত ভোরে জরুরী কোন কাজ না থাকলে ঘুম থেকে সাধারণত ওঠে না রাতুল। গত কয়েক মাস ধরেই সকাল ছয়টা, সাড়ে ছয়টার মধ্যেই উঠতে হচ্ছে। উঠে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে রীতিমত একবার হাজিরা দিতে হয়। সশরীরে নয়, অনলাইনে।
ডাক্তার ফিলিপ রাতুলের চিকিৎসা করেন। বছরে একবার সে বাংলাদেশে আসে, এসে দেখে যায়, চেকাপ সেই সময়েই হয়। বাকী বছর সপ্তাহে একবার সকাল সকাল এভাবে অনলাইনে ভিডিওর মাধ্যমে রাতুলকে হাজিরা দিতে হয় ডাক্তার ফিলিপ এর কাছে।
চিকিৎসক ফিলিপ, থাকে অস্ট্রেলিয়াতে। রাতুলের চিকিৎসার জন্য তিনি কোন ফি নেন না। নিতে চাইলে অবশ্য দিতে কোন আপত্তি নেই। টাকা পয়সার কোন অভাব নেই রাতুলের। তাই ডক্টর ফিলিপ ভিজিটের টাকা নিলেন কি নিলেন না সেটা রাতুলের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য হচ্ছে সাত দিনে একদিন সকাল ৬ টায় উঠতে হয়। এমনিতেই রাতুল ঘুমাতে যায় অনেক দেরী করে তার উপর আবার সকাল সকাল ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য ওর জন্য। যে একদিন সকালে উঠতে হয় সেই একদিন রাতুল চেষ্টা করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতে। চাইলেও পারে না। বরং সেদিনই ঘুমাতে অনেক দেরী হয়ে যায়।
সপ্তাহের প্রতি শনিবারে চলে এই ই-চিকিৎসা বা টেলি-মেডিসিন। সকালে উঠে প্রথমেই ল্যাপটপটা অন করে রাতুল। তারপর মিউজিক প্লে করে। প্লেলিষ্টে নজরুল সংগীত বেশি থাকে। হাতমুখ ধোয়া, চা বানানো, চা খাওয়া এসব করতে করতে পাঁচটা নজরুল সংগীত শেষ হয়ে যায়। পাঁচ নম্বর গানের শেষ লাইনে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় যখন গেয়ে ওঠে তোমারে ঘিরিয়া গাহিবে আমার কবিতার বুলবুল, তখন নিজের ডেস্কে এসে বসে রাতুল। মিউজিক অফ করে দিয়ে হেড-ফোন লাগায়। স্কাইপ চালু করে ডঃফিলিপ অনলাইনে আছেন কিনা দেখে। ডঃফিলিপ প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই অনলাইনে থাকেন। তাকে থাকতে হয়।
ভিডিও কল দেয় রাতুল। প্রথম প্রথম যখন কল দিত ডঃফিলিপের কাছে তখন বেশ অস্বস্তি লাগত। ছয় মাস হয়ে গেছে, এখন আর সেই অস্বস্তিকর ভাবটা নেই। এখন প্রায় ফ্যামিলি মেম্বারের মতই কথা বলে।
রাতুলের ফ্যামিলিতে ওর একটা ছয় বছরের মেয়ে আর বউ আছে। বাবা মা দুজনেই থাকে ছোট ছেলের সাথে। রাতুল বাবা মায়ের বড় ছেলে, এখানে তারা মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসে।
মেয়ের নাম রিশা আর বউএর নাম ঝিলমিল। আগে যখন বাবা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠত তখন রিশাও উঠে যেত, বাবাকে সাহায্য করত। পানি ঢেলে দিত, গিজার অন করে দিত।
এত ভোরে মেয়েকে উঠতে না করে দিয়েছে রাতুল। রিশার স্কুল আছে। সকালে উঠে এসব করলে স্কুলের দেরী হয়ে যায়। দুদিন স্কুলে যেতে দেরী করেছে, গার্জিয়ান কল করেছিল। রাতুল যায় নি, মেয়ের সবকিছু তার মা সামলায়। এরপর আর রিশাকে সকাল সকাল উঠে এসব করতে দেয় না। তবুও দুইএক দিন লুকিয়ে লুকিয়ে ওঠে রিশা। চুপিচুপি দেখে বাবা কি করে। মাঝেমাঝে বাবার সাথে চোখাচোখি হয়। তখন দৌড়ে পালায়।
সকালের নাস্তা রাতুল বউ ও মেয়ের সাথে করতে পারে না। আগের রাতে বানানো থাকে খাবার। সেটা ওভেনে গরম করে খেয়ে অফিসে চলে যায়। বাসা থেকে খুব দূরে নয় অফিস। চার/পাঁচ কিলোমিটার হবে। চাইলেই লাঞ্চ করতে বাসায় আসতে পারে। কিন্তু আসে না। অনেক আগে লাঞ্চ করতে বাসায় আসত, ঝিলমিল আর রাতুল একসঙ্গে বসে খেত। দুজন খেতে খেতে গল্প করত। রাতুল মুখে তুলে খাইয়ে দিত ঝিলমিলকে। খেতে খেতে ঠোঁট, হাতের আঙ্গুল এসব নিয়ে খেলা করত দুজনেই। হঠাৎ আকাশে মেঘ ডেকে উঠলে রাতুল আর সেদিন অফিসে যেত না। খাওয়া অসমাপ্ত রেখেই ওরা চলে যেত ভেতরের ঘরে। ভেতরের ঘর বাইরের ঘর বলতে যদিও এ-বাসায় কিছুই নেই। তবুও কিসের যেন একটা লজ্জাবোধ থেকেই এসব কাজে ওরা বেডরুমকেই বেশি প্রাধান্য দিত। তখন ওদের নতুন সংসার ছিল। রোমান্সটা তখন ভরপুর ছিল। এরপর বিয়ের বয়স বাড়তে লাগলো। বাসায় এসে লাঞ্চ করার বদলে গাড়ির পাশের সিটে করে খাবারের হট পট নিয়ে যেত লাগলো রাতুল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই হটপট নিয়ে যেত না, লাঞ্চ টাইমে বাসায় এসে উপস্থিত হত। এখন আর হটপটও নিয়ে যায় না, লাঞ্চ টাইমে বাসায় এসেও উপস্থিত হয় না।
রিশা বুঝতে পারে, ওর বাবা আর মায়ের মধ্যে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। কেউ খুব একটা কথা বলে না কারো সাথেই। রিশা খুব মিস করে। আগে ওরা তিনজনে মিলে কত জায়গায় ঘুরেছে! কখনো চিড়িয়াখানা, কখনো আহসান মঞ্জিল, কখনো সোনারগাঁও। কখনোবা ঢাকার বাইরে। শেষবার ওরা যখন একত্রে ঘুরতে গিয়েছিল তখন রিশার বয়স পাঁচ। এক বছর আগের কথা। সমুদ্রে ঘুরতে গিয়েছিল ওরা। সমুদ্রে রিশা বেশ লাফালাফি করেছিল। বাবা ওর সেই লাফঝাঁপ এর কতগুলো ছবি তুলেছিল। ছবিগুলো এ্যালবামে আছে। কিন্তু এ্যালবামটা কোথায় আছে রিশার তা জানা নেই। মনে হয় বাবা জানে। বাবাকে সে জিজ্ঞেস করবে এলবামের কথা। কিন্তু বাবাকে একদম কাছে পায় না। শুধু রাতে পায় একটু দুই আড়াই ঘণ্টার জন্য। বাবা ফেরে সেই রাত ৯টায়। বের হয় সকাল ৮ টায়। এতক্ষণ বাইরে কি করে রিশা তা জানে না। বড় হয়ে গেলে মনে হয় কেউই আর খুব একটা ঘরে ফেরে না। রিশা ভাবে, সে সকালে স্কুলে যায় বেলা বারোটার মধ্যে বাসায় ফেরে। আর বাবা? বাবা তো অনেক বড়। তাই ঘরে ফেরে না।
ঘরে ফিরে রিশা মায়ের সাথে টিভি দেখে। মায়ের সাথে টিভি দেখে বললে ভুল হয়ে যায়। মা বসে থাকে পাশে। বসে অন্য কাজ করে। কোলের মধ্যে ল্যাপটপ নিয়ে নানা কাজ করে। রিশা যখন আরও ছোট ছিল তখন ল্যাপটপের জায়গায় সে থাকত।
টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে একা একা হাসে সে। জেরি যখন টমকে ধোঁকা দেয় তখন সে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে, হাসতে হাসতে মায়ের দিকে তাকায়, দেখে নেয় মা হাসছে কিনা! মা সেটা বুঝতে পারে। তাই রিশা যখন তাকায় তখন সেও মুচকি হেসে মেয়ের দিকে তাকায়।
রাতুলকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিল ঝিলমিল। রাতুল বলত ঝিমমিলের নামের মধ্যে একটা আর্ট আছে। ঝিলম নদীর তীরের ঢেউ যেভাবে ভেঙে পড়ে সেভাবেই নাকি ঝিলমিল রাতুলের মনের কোণে ভেঙে পড়েছিল। পাহাড়ি নদী ঝিলমের সৌন্দর্য তখন মুগ্ধ করেছিল রাতুলকে। প্রেমে পড়েছিল একে অন্যের।
রাতুলের বয়স এই মার্চে ৩৮ হবে। ঝিলমিল জানে সেটা। সাত বছর আগে বিয়ে করেছিল রাতুলকে।
রাতুল তখন দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম ছিল। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি, ৬৮ কেজি ওজন। ভরাট চেহারা। ত্রিশ একত্রিশ বছরের যুবক, চোখে মায়া আছে, ঠোঁটে কথা আছে, মুখ-ভর্তি দাড়ি, কিন্তু ক্লিন শেভ করে রোজ। দেখলে যেকোনো মেয়েই প্রেমে পড়ে যাবে। ঝিলমিলেরও তাই হয়েছিল। রাতুলের ব্যক্তিত্ব বোধটা প্রচণ্ড টেনেছিল। আড়াই বছরের প্রেম, শেষে বিয়ে। বিয়ের আগে একটা কর্পোরেট জব করত ঝিলমিল। বিয়ের পরেও করেছিল বছর-খানিক। কিন্তু রিশার জন্মের পর আর করতে পারল না। করতে পারল না বলে কোন আফসোস নেই ঝিলমিলের। চাকরী বাকরী করার কোন ইচ্ছেও ছিল না বিয়ের পরে। রাতুলই বলত, চাকরী করি পেটের দায়ে। অঢেল টাকা থাকলে কি আর কেউ অন্যের গোলামী করে!
রাতুল বাসায় ফেরে রাত সাড়ে নটায়। সোফায় বসে জামা জুতো ছাড়ে। ফ্রেশ হয়ে খেতে যায়। রাতের ডিনার তিনজনে একত্রেই করে। ইদানীং বেশ চুপচাপ খাওয়া শেষ করে সবাই। রিশা হঠাৎ বলে ওঠে,
“বাবা, আজ সকালে ডাঃ আংকেল কি বলল? তুমি আর কতদিন বাঁচবে?
প্রশ্নটা শুনে রাতুল কিছুটা ভড়কে যায়। কি বলছে এই মেয়ে! ওকে এসব কে জানিয়েছে? ঝিলমিলের দিকে তাকায় রাতুল। ঝিলমিল তাকায় রিশার দিকে। দুজনেরই চোখ বড় হয়ে আসে।
রিশা আবার বলে,
“আমি সব জানি বাবা”
রাতুল আর ঝিলমিলের দুজনেরই মনে হতে লাগলো তাদের ছয় বছরের মেয়েটা আজ যেন হঠাৎ ছাব্বিশ বছরের বুড়ি হয়ে গেল।
খাওয়ার টেবিল ছেড়ে তিনজনেই উঠে যায় প্রায় একই সাথে। রিশা ঘুমিয়ে যায় নিজের ঘরে।
রাতুল বেডরুমে গিয়ে বালিশ টেনে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে। কিছুক্ষণ পরে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঘরে প্রবেশ করে ঝিলমিল। এসেই শুয়ে পড়ে। ঘুমায় না কেউই। দুজনেই জেগে থাকে। রাতুলের খুব ইচ্ছে করে ঝিলমিলের বুকের উপর হাতটা রাখে। ছুঁতে গিয়েও আবার ছোঁয় না। থরথর কাঁপা হাত আবার পেছনে ফিরে যায়। ঝিলমিল একটা বাতাসের অস্তিত্ব টের পায়। দমকা বাতাসের। ছয় মাস ধরে বয়ে যাওয়া এই একই দমকা হাওয়া আর সহ্য করতে পারছে না ওরা কেউই।
একসময়ে দুজনেই দুপাশ ফিরে ঘুমিয়ে যায়। একটা গান জেগে থাকে, যে গানটা চলছে প্রায় যেন হাজার রাত ধরে। অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় এবার গেয়ে ওঠেন ,
মহুয়া বনে বন-পাপিয়া
একলা ঝুরে নিশি জাগিয়া।।
ফিরিয়া কবে প্রিয় আসিবে
ধরিয়া বুকে কহিবে প্রিয়া।।
শুনি নীরবে, গগনে বসি’
কহ যে কথা বিরহী শশী,
তব রোদনে বঁধূ, এ মনে
যমুনা বহে কূল-প্লাবিয়া।।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১:৩৫