বাড়িওয়ালীর মেয়ে মিহিকে একটু আগে বকা দিয়ে যখন ঘর থেকে বাহির করে দিচ্ছিলাম তখন মিহি আমার দিকে রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে বললো “আপনার জীবনেও বিয়ে হবে না।” এই কথা শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি শুধু বলেছিলাম “ফাজিল মেয়ে গেলি?” মিহি দৌড় দিয়ে বলতে লাগলো “এক মাঘে শীত যায় না। আপনার চুল আমি টাইনা টাইনা ছিড়বো।” আমি শুধু মনে মনে হাসলাম। পরে দৌড়ানি দিয়ে ওকে ঘর থেকে বাহির করে দেই। মাঝে মাঝে আমার কেমন যেন মনে হয় মিহিকে। ভাবি ও একটা লজ্জাবতী গাছ। একটু ছুয়ে দিলেই চুপসে যাবে। কিন্তু এই লজ্জাবতী গাছটা আমার কাব্যের মাঝে প্রবেশ হয়ে কাব্যের শব্দগুলো নিয়ে ছুটাছুটি করে। কাব্যের বাক্যগুলোকে এলোমেলো করে দেয় তখন আমি চুপ করে ওর তামশা দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আমি পুনরায় কাব্যগুলোকে সাঁজাতে চেষ্টা করি কিন্তু আমি আর এই কাব্যকে একটা রুপ দিতে পারি না। এই কাব্যকে রুপ দিতে আমার আর ইচ্ছে করে না। কিছুক্ষন আগে যখন এসে বললো “শীতকাল তো চলে আসছে। শীতকালে আমার গোসল করতে ভয় লাগে। আপনার লাগে না?” আমি কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার কেন যেন প্রায় মনে হয় ও ইচ্ছে করে এইসব অহেতুক কথা আমার সাথে বলে। আর কেন বলে আমার অনুভূতির গভীরে তা কখনো বুঝে উঠতে পারি না। আমি ইতস্তত করে বলেছিলাম “তুমি কি এই কথা বলার জন্য এখানে আসছো?” সে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক দিয়ে বললো “না মানে আরও অনেক কথা আছে। কত কথাই তো আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চাই। কিন্তু ভয় লাগে। আপনি তো আমার কথায় প্রায় রেগে যান। আমি তারপরও আপনার সাথে কথা বলতে আসি। কেন আসি আমি নিজেও জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানেন আমি না একটা বেহাইয়া মেয়ে। আচ্ছা আমি কি সত্যি একটা বেহাইয়া মেয়ে?” ওর কথায় আমার হাসার উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম “সত্যটা বললে কি তুমি খুঁশি হবে?” সে একটু চুপ করে থাকলো তারপর বললো “একটা কথা বলি?” আমি মাথা নেড়ে হুম নামক শব্দ উচ্চারণ করার পরই ও বললো “আপনাকে আমার টেডি বিয়ার মনে হয়।মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে আপনার নাকটা ধরে টান দেই।” আমি মনে মনে হেসে একটু গম্ভীর হয়ে বললাম “তুমি এই মুহুর্তে আর একটা কথা না বলে আমার সামনে থেকে যাবে কেমন?” সে আমার কথা শুনে কানে দু হাত ছুয়ে বললো “আচ্ছা আর এমন বলবো না। স্যরি।” আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার এমন তাকানো দেখে বললো “এমন করে কি দেখেন? এমন করে তাকালে আমার হঠাৎ করে মনে হয় আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন। প্রেমের কথা শুনলে না আমার খুব লজ্জা লাগে। আচ্ছা আপনি কি আমার প্রেমে পড়েছেন? সত্যি করে বলুন তো?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আর এই কারণে মনে মনে একটু রেগে ওকে বাসা থেকে বের করে দেই।
আসাদ ভাইকে দেখলে আমার ভিতরে মায়া তৈরি হয়। মায়া জিনিসটা দেখতে কেমন আমি জানি না। এই মানুষটার সাথে যেদিন আমার পরিচয় হয় সেদিন থেকে বুঝতে পারলাম মানুষের ভিতরেও একটা আকাশ আছে। এই আকাশটার ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা যায় না। দেখা যায় না আকাশের বুকে উড়ে যাওয়া কাক গুলোকে। কিন্তু ভালোবাসা গুলোকে চুপ করে অনুভব করা যায়। ভালোবাসা গুলো আকাশটার বুকে জমা থাকে। আমি প্রায় অনুধাবন করি আমাদের মাথার উপরের আকাশটার থেকেও কি বুকের ভিতরেরর আকাশটা অনেক বিশাল? আমি আসাদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। উনি আমাকে বললেন “একটা কাজ করতে পারবি জাহেদ?” আমি বললাম “কি কাজ ভাই বলেন। আমি পারবো।” উনি একটা হাসি দিল। যার অর্থ আমার উপর ভরসা করা যায়। উনি বললেন “পরশু দিন কানাডায় চলে যাচ্ছি। এক মাস পর আবার আসবো। আমি যে স্বপ্নটা প্রায় দেখি সেই স্বপ্নটা পূরণ করতে বুঝলি? আমার কাছে যে ছেলেমেয়ে গুলো দেখা করতে আসে তাদেরকে একটু পড়াস কেমন? পারলে ওদের একটু ঘুরাতে নিয়ে যাস। পারবি তো?” আমি মাথা নেড়ে বুঝালাম জ্বি ভাই পারবো। আসাদ ভাই এর বাবা মা কারা উনি জানে না। আসাদ ভাই তখন অনেক ছোট। উনি টোকাই ছিল। পড়তে পারতো না। ছোট বেলা কোন কাগজে যদি কোন ছবি দেখতো বা লেখা দেখতো উনি সেগুলোর উপর হাত বুলাতেন, চেয়ে থাকতেন। একদিন একটা পেপার পেয়ে পথচারীতে হাটা একজন মহিলার কাছে গিয়ে বললো “এখানে কি লেখা আছে?” মহিলাটা কিছুক্ষন বিষ্মিত চোখে তাকিয়ে বললো “তুমি পড়তে পারো না?” আসাদ ভাই মাথা দিয়ে না সূচক ইশারা দেয়। তারপর মহিলাটা তাকে পড়ে শোনায় এবং বলে কিভাবে পড়ে তুমি শিখবে? তুমি চাইলে আমি তোমকে শিখাতে পারি।” আসাদ ভাই শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আসাদ ভাই কি করে, কোথায় থাকে, সব কিছু জেনে উনি আসাদ ভাইকে সাথে করে নিয়ে যান। এই যে নিয়ে গেলেন সেই নিয়ে যাওয়ার পরই আজকের এই আসাদ ভাই। নিজের ছেলের মত দেখতো। উনারও একটা ছেলে আছে। কিন্তু কখনো দুইটা চোখে আলাদা ভাবে দেখেনি। স্কুলে ভর্তি করালেন, পড়ালেন, খাওয়াতেন, রাত ঘুমানোর সময় রুপকথার গল্প শোনাতেন। আসাদ ভাই এর এস এস সি দেওয়ার পরই উনারা সিফট হয়ে কানাডা চলে গেলেন। আর এ সব কিছুই আসাদ ভাই আমাকে বলেছে। আমি প্রায় ভাবি এই পৃথিবীতে কি এমনও মানুষ আছে যাদের ছোয়ায় আরেকটা মানুষ পাল্টে যেতে পারে। হাজার মানুষের ভিতরে এই কিছু সংখ্যক মানুষের স্বাক্ষাতটা আমরাও অনেকে পাইনা। এই মানুষগুলার জন্য আমার ভিতরে ভালোবাসা জন্মায়। আমি যদি কখনো আসাদ ভাই এর মা কে সামনে দেখি পা ধরে সালাম করবো এবং বলবো আন্টি আপানকে খুব ভালোবাসি। কেন ভালোবাসি জানি না। এই ভালোবাসাটা আমাকে না বলেই আমার ভিতরে প্রবেশ করেছে। আপনি কি আমার ভালোবাস গ্রহণ করবেন? এই ভালোবাসটা হলো একজন মায়ের ভালোবাসা। আপনি আমার কাছে একটা আকাশ।” আসাদ ভাই দেশে এসেছেন তিন মাস হলো। আমি উনাকে প্রায় দেখতাম ছেলেমেয়েদের পড়াতেন।এদিক ওদিক নিয়ে যেতেন। আর এই কৌতুহলেই উনার সাথে গিয়ে পরিচয় হই। উনার একটা স্বপ্ন আছে এ সমস্ত ছেলেমেয়েদের নিয়ে কিছু একটা করবে। কিছু সময় পর অনেকগুলো ছেলেমেয়ে এসে আসাদ ভাইকে ঘিরে ধরে। আসাদ ভাই বললেন “তোমরা কেমন আছো?” সবাই একটা চিৎকার দিয়ে বললো ভালো আছি। আমি চুপ করে অনুভব করি এইগুলা শুধু একটা চিৎকার না। এইগুলা একেকটা ভালোবাসা।এই ভালোবাসা গুলা যখন চোখে ভাসে তখন বুকটা কেমন করে যেন উঠে। আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে চায়। উনি এক মাস থাকবে না এ কথা তাদের জানায়। যখন জানালো তখন ছেলেমেয়েদের মুখটা আমি কেমন যেন হয়ে যেতে দেখলাম।
বাসায় ঢুকতেই আম্মা আমাকে বললো “জাহেদ তুই মিহিকে বকছিস কেন?” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম “তুমি তো বাজারে গেছিলা তাই দেখো নাই। অহেতুক নানা রকমের কথা নিয়ে আমার কাছে হাজির হয়।তোমার কাছে নালিশ দিয়েছে তাই না? কোন ব্যাপার না ঘন্টাখানেক পরই দেখবা আমার কাছে আবার আসবে। আর এই গুলাতো তুমি জানোই।” কথা শেষ করে যেই আমি নিজের রুমে যাবো ঠিক তখন দরজার কলিং বেল বাজলো। আম্মা দরজা খুলতেই দেখি মিহি। আমি মনে মনে বললাম বাহ নাম মুখে না আনতেই হাজির। তবে তার হাতে কিছু কাপড়। আমি আম্মাকে চোখের ইশারা দিয়ে বুঝালাম এখন কি হয় তুমি দেখো এই টাইপের। মিহি একটা হাসি দিয়ে একবার আম্মার দিকে তাকিয়ে তারপর আমাকে বললো “একটু পর আমার বান্ধবীর বোনের বিয়েতে যাবো। এই শাড়ি তিনটার মধ্যে কোনটা পড়লে আমাকে মানাবে? একটু বলবেন?” আম্মা একটু হাসলো। আমিও ঘটানার পরিস্থিতিতে হেসে দিয়ে বললাম “শাড়ি পড়ার দরকার নেই। তুমি শাড়ি পড়ে হাটতে পারবা না। তোমার তো অভ্যাস নেই শাড়ি পড়ার।” সে বললো “আমি পারি তো পড়তে। কেন গতমাসে না আপনাকে পড়ে দেখালাম কেমন হয়েছে। আচ্ছা বুঝছি আপনি কেন আমায় শাড়ি পড়তে নিষেধ করছেন। শাড়ি পড়লে তো আমাকে মিষ্টি মিষ্টি লাগে। বিয়েতে যাওয়ার পর কেউ যদি আমাকে পছন্দ করে ফেলে তখন কি হবে? তখন তো আপনি কষ্ট পাবেন। আচ্ছা আপনি কি সত্যি কষ্ট পাবেন?” আমি ওর কথা শুনে অবাক হয়ে আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মাও একটু অবাক হয়ে হাসলো। মিহি আম্মার হাসি দেখে সে নিজেই হেসে দিল। মাঝে মাঝে ভাবি এই মেয়ের লাজ শরম কি একেবারেই নেই? আমি চেহারায় একটা রাগের ভাব এনে কিছু বলতে যাবো তখন আম্মা হাসতে হাসতে বললো “এই তুই ভিতরে যা। আর এই যে ম্যাডাম তুমি আমার সাথে আসো। কোনটা পড়লে তোমাকে সুন্দর লাগবে আমি বলে দিচ্ছি।” মিহি একটা হাসি দিয়ে বললো “না আন্টি শাড়ি পড়ার ইচ্ছা চলে গেছে।আমি যাই হ্যাঁ।”
রুমে এসে জানালার সামনে থাকা চেয়ারটা টেনে বসে পা দুটো জানালার মাঝে তুলে দিয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে থাকলাম। সন্ধ্যার আকাশটা আমার কাছে কোন কালেই ভালো লাগেনি।সন্ধ্যার আকাশটা কেমন যেন লালচে রুপ নিয়ে থাকে। কেমন যেন মনে হয় যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।আকাশের বুকে যেন রক্তের ছড়াছড়ি। এই লাল রং টা আমার পছন্দ না। কেন পছন্দ না তা আমি নিজেও জানি না। কিন্তু আকাশের বুকে একা চাঁদটার জন্য আমার মাঝে মাঝে মায়া হয়। মনে হয় তার কেউ নাই। কিন্তু ছেলেদের মাঝে এমন মায়া মানায় না। এমন মায়া থাকতে হয় মেয়েদের। মেয়েদের এই মায়া জিনিসটাকে আমার অদ্ভুত মনে হয়। আমি মনে করি এই মায়া জিনিসটা দিয়ে তারা অনেক কিছুই তাদের করে নিতে পারে। কিছুদিন আগে মিহি বাসায় এসে মুখটায় এমন একটা ভাব নিয়ে বললো “আমাদের বাসায় একটু আসুন তো।” আমি ওর চেহারায় অস্থিরতার আভা দেখে মনে মনে বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। বললাম “কোন সমস্যা?” সে মাথা নেড়ে বলে “হ্যাঁ অনেক সমস্যা। আসুন না।” আমি কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর ডান হাতে মেহেদী দিয়েছে। তাও পাতা বেটে দেওয়া মেহেদী। আমি ওর পিছন পিছন বাসায় যেতেই ও বললো “ক্ষিধে লেগেছে। ভার্সিটি থেকে এসে দেখি আম্মা বাসায় নেই। ফোন দিলাম বললো ফাহাদকে নিয়ে খালার বাসায় গিয়েছে। বুয়াকে বলেছিলাম নিচের মেহেদী গাছ থেকে মেহেদী পাতা ছিড়ে বেটে রাখতে। রেখে গিয়েছে। এই মেহেদী আমি দিতে পারি না। তবুও ইচ্ছে হয়েছে দিতে। নিজের গাছের মেহেদী তো তাই। হাতের তালুতে আর আঙ্গুলের মাথায় গোল করে মেহেদী দিয়েছি তাই কিছু খেতে পারছি না। একটু সাহায্য করুন না। বুয়া টেবিলে সব কিছু রেখে গিয়েছে। আপনি একটু আমাকে খাওয়াই দিবেন?” ওর কথা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কি মায়া মায়া চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলেছিল। কিন্তু এই মায়া মায়া কথাকে আমি উপেক্ষা করে বললাম “থাপ্পড় খেয়েছো কখনো? থাপড়াইয়া তোমার দাঁত ফেলে দিব আমি। তুমি জানো আমি মনে মনে কি ভাবছিলাম? এতো ঢং কেন তোমার? আর এই গুলা কি সব কথা? তুমি না ভার্সিটিতে পড়ো।” এই গুলা যখন বললাম দেখলাম ও মুখটা কেমন করে যেন ফেলেছে। তারপর মুখটা নিচের দিকে করে বললো “আমি কি একটু বেশি কথা বলি? আসলে আমার এমনটা করা উচিৎ হয়নি বুঝতে পারছি। আমি জানি আমার আচরণ গুলা অনেকটা বাচ্চাদের মত। কিন্তু আমি এমন না। আমি জানি না আমি কেন আপনার সাথে এমন করে কথা বলি। আমাকে মাফ করবেন।” আমি কিছু না বলে দরজা দিয়ে বের হয়ে সিড়ির কয়েক ধাপ উঠে কি মনে করে যেন আবার ওর কাছে গিয়ে দেখি ও তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। আমি বললাম “আমাকে কি ঢং করে বলতে হবে যে চেয়ারে বসো মেয়ে।” সে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চুপচাপ চেয়ারে বসে বললো “বকা দিয়ে এখন অভিনয় করতে আসছে যত্তসব।” আমি কিছু না বলে মনে মনে হাসলাম আর বললাম এমন মায়া মাখানো কথার ভিতর কেন আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। এমনটা করাতো আমার উচিৎ না। এমন মায়াকে আমার প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক না। এসব কান্ড চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে একটা কেলেংকারী হয়ে যাবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। কিন্তু তারপরও ওকে নিজ হাতে খাওয়াই দেই। আমার তখন কি অনুভূতিটা হচ্ছিলো আমি জানি না। সে খেতে খেতে খুব গভীর হয়ে বললো “আপনি কি জানেন আপনি ভালো একটা মানুষ? কিন্তু মাঝে মাঝে আমাকে এমন ধমক দিয়ে কথা বলেন কেন? আমার বুঝি ভয় লাগে না? খারাপ লাগে না বুঝি?” আমি এর কি প্রত্যুত্তর দিব জানা ছিল না। শুধু একটু হেসে বলেছিলাম “এমন কেন তুমি?” সে বললো “জানি না।আমি এমোনি।” এই গুলা ভাবলে বা মনে করলেই আমার কেমন যেন হাসি পায়। কি একটা অদ্ভুত মেয়ে। আমি জানি না সে আমার সাথে কেন এমন করে কথা বলে। কেন তার সমস্ত আবেগ, অনুভূতি, ভালো লাগা আমার মাঝে শেয়ার করে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম।
এমন চমৎকার একটা বিকেলের স্বাক্ষাত হবে আমি ভাবিনি। এই সমু্দ্রের এপারে দাঁড়িয়ে আকাশের মাঝে উড়ে যাওয়া মেঘের ভেলা গুলোকে খুব কাছ থেকে দেখা যায়। আসাদ ভাই এর কথা মত ওদের আমি প্রথমেই ঘুরাতে নিয়ে আসি এই সমুদ্র সৈকতে। আমি খুব ভালো করেই জানি কারও সাথে মিশতে হলে প্রথমে বন্ধু হওয়া দরকার, তার মনে প্রবেশ করা দরকার। এই ছেলে মেয়েদের সাথে প্রথমে আমার বন্ধু হতে হবে। রাশেদ আমার শার্টের কোনা ধরে টান দিয়ে বললো “ভাইজান গোসল দেই?” আমি কেন যেন বাধা দিলাম না। মাথা নেড়ে বললাম “আবার জিগায়। কক্স-বাজারে আসছি তার আলো বাতাস, পানি শরীরে না মাখালে কি চলে? চল বেটা। তবে একদম কাছ থেকে। এইখানে দাঁড়ায় থাকবো সমুদ্রের পানি আমাদের দুর থেকে ছুয়ে দিয়ে যাবে। আমরা এই সমুদ্রের সাথে ছোয়াছুয়ি খেলা খেলবো। কি খেলবি?” সবাই জোরে হ্যাঁ বলে একটা চিৎকার দেয়। এই চিৎকারে আমার ভিতরটা কেপে উঠে। এই কেপে উঠার মাঝে আমি ভালোবাসাগুলাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাই। কেন যেন এই ভালোবাসা গুলো দেখে আমার চোখে জল আসে। সাতজন ছেলে আমার সাথে আসছে। মেয়েরা ভয়ে আসে নাই। আমরা পানির সাথে ছোয়াছুয়ি খেলা খেলি। এরপর ওরা আমার পুরো শরীর বালির ভিতর বন্ধি করে। শুধু মাথাটা দেখা যায়। আমি এই বালির ভিতর শুয়ে থেকে আকাশটার মাঝে তাকাই। আকাশটা কত বিশাল। কিন্তু আমি অনুধাবন করি এই বিশাল আকাশটার থেকে এই ছোট ছোট ভালোবাসা গুলা আরও বেশি বিশাল। রাত্রের বেলা এই সমুদ্রের শহরটা কেমন যেন রুপ ধারন করে।এই রুপের মাঝে কত সৌন্দর্য আর ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। এসব ভালোবাসা আর সৌন্দর্য চুপ করে অনুভব করতে হয়। আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না এমন ভালোবাসা গুলার সাথে কিভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি। আমি এই সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে একটা জোরে চিৎকার দিতেই শব্দের প্রতিধ্বনি পুনরায় আমার কাছে ফিরে আসে। আমার এই চিৎকারের আওয়াজ শুনে ওরাও এক এক করে চিৎকার দিতে থাকে। আমি শুধু চুপ করে এই শব্দগুলোকে আমার ভিতরে জমা করে নিচ্ছি। এই শব্দ গুলা যে অনেক দামী অনেক।
একটা ভয়ংকর ব্যাপার হলো ইদানিং মিহিকে নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ করেইে আমি ভাবতে শুরু করেছি। এই ভাবনার জগতে অগ্রসর হলে আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই। এই হারানোর মাঝে আমি অনুভব করি তার দুষ্টামি আর অদ্ভুত সুন্দর ন্যাকামি করা আচরণ গুলোকে। এইগুলা ভাবতেই ছাদে যখন মিহির সাথে দেখা হলো মিহি আমাকে দেখে চুপ করে আমার পাশে দু তিন হাত দুরে এসে ছাদের রেলিং ধরে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো “এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখেন?” আমি কিছু বলি না। আমার কাছ থেকে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে খুব গভীর হয়ে বললো “আমাদের জীবনটা অনেক সুন্দর জানেন।এই সুন্দর জীবনের মধ্যে মাঝে মাঝে মনে হয় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। যখন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় তখন কেন যেন আমার খুব ইচ্ছে করে এই আকাশটার মাঝে উড়তে। আমি ছোট্ট একটা হামিং বার্ড হয়ে পুরো আকাশ জুড়ে উড়বো। এই ছোট্ট হামিং বার্ডটা প্রায় ভাবে আপনার সামনে আসবো না। আপনার সাথে এমন করে কথা বলবো না। তারপরও একটা অপ্রাপ্তির চেহারা নিয়ে আপনার কাছে আসি।আমার উদ্ভট কথার জন্য যতবার আপনার কাছ থেকে বকা শুনেছি ঠিক ততবার আমি বাসায় এসে রুমের দরজা বন্ধ করে কেঁদেছি এবং মনে মনে বলেছি আমি আর আপনার সামনে আসবো না। কিন্তু দেখেন এই হামিং বার্ডটার লাজ লজ্জা একদম নেই।” এইটুকু বলে মিহি থামে।আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “এখন কি সিদ্ধান্ত নিলে?” সে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে সময় নিয়ে বললো “এই হামিং বার্ড আর স্বপ্ন দেখবে না।ব্যর্থ প্রার্থনা নিয়েই আকাশটায় উড়বে।” আমিও ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটু হেসে বললাম “আমারও খুব ইচ্ছে করে এই শহরটা উড়ে দেখার। তুমি যখন উড়বে তখন আমাকে সাথে নিও কেমন? একা উড়তে নেই মেয়ে।” এই কথাটা বলে আমি চলে যাওয়ার জন্য হাটা দেই।ও আমার কথার ধরন বুঝলো কিনা আমি জানি না। আমি পিছনে ফিরে দেখি ও বিষন্ন মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমাকে বললো “আপনি আসলে একটা খারাপ খুব খারাপ। আমাকে কাঁদাতে আপনার ভালো লাগে?” আমি বললাম “আমি জানি আমি খারাপ।এই খারাপকে ভালো করার দায়িত্ব তোমার।দায়িত্বটা দিলাম তোমাকে, আমাকে ভালো করে নিও।” এইটা বলে আমি চলে আসি। আমি জানি সে এখন আবার কাঁদবে। আকাশটার দিকে তাকিয়ে কাঁদবে।এই কান্নাটা কষ্টের না। এই কান্নাটা কাউকে কাছে পাওয়ার।কান্না করতে করতে একটু হেসে চোখের জল মুছবে। আমি না হয় অপেক্ষা করি হামিং বার্ডের সাথে উড়ার জন্য। ততক্ষন এই হামিং বার্ডটা একটু কান্না করুক…
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫১