বরাবরই দলছুট ছিলাম। অভিমানে বুক জ্বালা-পোড়া রোগে আক্রান্ত হয়ে খানিকটা দূরত্বে বসে দেখেছি সচল জটলা। দেখেছি বক্তার মুখ থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি বাক্যসম্ভার বেরিয়ে পড়ছে, তারপর থপ থপ করে এদিক ওদিক এগিয়ে পিছিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে আনাচে কানাচে, কখনো হাঁচড়ে পাঁচড়ে অমনোযোগি শ্রোতার কান অব্দি বেয়ে উঠার চেষ্টা করে পিছলে যাচ্ছে কতকটা অংশ, কাঁধে চেপে খানিক ইতঃস্তত করে আবার ফিরে যাচ্ছে বক্তার কাছে। ভীষন ব্যস্ত আর বিভিন্ন রকম মুদ্রারত হাতের আঙুলে উল্টা হয়ে ঝুলে থাকে তারা। একাধিক বক্তার সম্মিলিত বাক্যাংশ জমতে জমতে ঝুলতে ঝুলতে শেষ মেষ দলে ভারী হয়ে লম্ফ নৃত্য শুরু করে জটলা ঘিরে। কোলাহলে অনীহা আমাকে আরেকটু তফাতে সরিয়ে নেয়।
চোখ বুজি। দেখি শাল শেগুনের বন। ঘুরে ঘুরে পড়ছে একটা, দুটা... হাজারটা শাদা ফুল। ছোট্ট আমার মত। অথবা আমার নাকফুলের মত। গিরগিটি লুকিয়ে গেলো ওই শুকনো ঝোপে। নিমিষেই রঙ পালটে খটখটে খয়েরী। চোখাচোখি হতেই লাজুক হাসি হেসে ফেলে। চেনে আমায়। ওরই দলের একজন কিনা! কেমোফ্লাজ - ঘাপটি মারা লোক!
লোক জানান দিয়ে নয়, তাই নীরবে তোর চোখপুকুরে ডুবে থাকাতেই ছিল আমার সুখ। বনগোলাপ আর রক্ত করবী খুঁজে পেতে আনবি, কাঁটায় হাত ছড়বি, কাঠগোলাপের মড়মড়ে ডাল ভেঙে চিৎপাত হবি- এই ছিল আমার অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা। ওদিকে গিরগিটিটার মত তুইও একবার পরখ করে নিরীক্ষণ করলি আমাকে। চামড়া আর এক পরত মাংসের আড়ালে ভেতরের কাঠবিড়ালিটাকে চিনলি।
কী করে, বলতো? তোর মনেও কি ছিল একটা চড়ুই ? উড়ুই উড়ুই ছটফটে তুই। রোদের সাথে সমঝতা করে আমায় বললি , "দেখা হবে কুয়াশায়... রুপালি মাছের ঝাঁক যখন কিনারে এসে ধরা দেয়। জলভরা হাতের তালুতে ওদের নিয়ে খানিক খেলা করো তুমি। যদি ভুলে সে জলে আঙ্গুল ডুবোই, ভেবে নিও মাছের লেজেরা বুঝি সুড়সুড়ি দিয়েছে। নরম সূর্য দেখো খেজুরের আঁকাবাঁকা পাতায়। কুয়াশা মিলালে চমকে হঠাৎ পালিয়ে যেও না, কাঠবেড়ালি... হ্রদের জলে মৎসপুচ্ছ আর আমার পাতানো হাতে তোমার কাগজে বন্দী কথামালা রেখে যেও এক ফোঁটা যত্ন করে।"
সপ্ত সহস্র সকাল জুড়ে কুয়াশা পেতে বসে আছি আমি। সরষে ক্ষেতে ভিজে কুয়াশা গড়িয়ে জল নামে চুইয়ে চুইয়ে। সাপেরা খোলস ছাড়ে তালপুকুরে।
ফিরে আয় চড়ুই। বড্ড একলা , দলছুট আমি। গিরগিটিকেও আর পাইনা খুঁজে। চারপাশে শুধু থপথপিয়ে ব্যাঙের মত অনর্থক বকবকানি আমায় তাড়া করে।
অম্ল নয়, অভিমানের জ্বালা বুকে।
অ্যান্টাসিড নয়, চাই তোকে।