ছবি সুত্রঃ shadow.com
নজরুলের মাহযাবঃ
আমি সাধারনত পাগল, ছাগল এবং আঁতেল এই তিন শ্রেনীর মানুষ দেখলেই সাথে সাথে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক সময় তা সম্ভব হয় না, নুন্যতম ফরমালিটির কারনে আপনাকে কথা চালিয়ে যেতে হয়। একবার এমনই এক ব্যক্তির সাথে আলাপ হলো যার মধ্যে উপরের তিনটি বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান অর্থাৎ থ্রি ইন ওয়ান। অল্প কিছুক্ষন কথা চালানোর পর বুঝলাম তিনি দ্বিতীয় শ্রেনী ছাগু। তো এই ছাগ ব্যক্তিটির ধারনা, মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে ঠকানো হয়েছে। তার লেখা বাদ দিয়ে হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাকে জাতীয় সংগীত বানানো আমাদের জাতীয়তাবাদের উপর নগ্ন আঘাত। এইভাবে হিন্দুরা দিন দিন মুসলিমদের উপর প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তি পেতে অবিলম্বনে মুসলিম বিশ্বের অহংকার কবি নজরুলের ইসলামের কবিতা থেকে জাতীয় সংগীত বানানো হোক।
আমি ধৈর্য্য ধরে কথাগুলো শুনলাম। অনেক সময় নির্বুদ্ধিতা মানুষ কে বলদে পরিনত করে। লেখাপড়া না জেনে কেউ বলদ হলে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু যারা লেখাপড়া করেও এই ধরনের কথা বলেন তাদেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বলদ হিসাবে চিহ্নিত করি এবং প্রয়োজনীয় দুরত্ব অবলম্বন করি। কিন্তু এবারের ক্ষেত্রে হাস্যকর ও বিব্রতকর সমস্যা হলো- আমার জানামতে উনি একবার 'নৌকা' মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন। তাই সমীকরণ মেলাতে না পেরে আমি বহুত দিগদারির মধ্যে পড়লাম।
ইদানিং অবশ্য সর্ষেতেই ভুতের দেখা বেশি মিলছে, তাই প্রাথমিকভাবে চেপে গিয়ে বললাম, ইয়ে মানে, কালী সাধনা সম্পর্কে আপনার ধারনা আছে?
তিনি বললেন, নাউজুবিল্লাহ! এই সব জেনে আমি কি করব?
আমি বললাম, শুনেন, শাস্ত্র মতে যারাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তারাই কালীসাধক।
তিনি বললেন, তো?
বললাম, তো মানে 'শ্যামা সংগীত' নামে নজরুলের বিশেষ কিছু রচনা আছে, যেখানে তিনি কালীর গুনগান গেয়েছেন। যেমন তিনি লিখেছেন, আমি সাধ-করে মোর গৌরী মেয়ের/নাম রেখেছি কালী।
আবার লিখেছেন, আমার কালো মেয়ের আঁধার কোলে/ শিশু রবি শশী দোলে।
তিনি শুকনো কন্ঠে বললেন, এর মানে কি?
আমি বললাম, এর মানে হলো আপনার মুসলিম নজরুল একজন কালীসাধক ছিলেন।
এই কালীসাধকই আবার লিখেছেন - তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/মধুপূর্ণিমারই সেথা চাঁদও দোলে’। আরো লিখেছেন, ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়/ আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।
ভদ্রলোকের কপালে কিঞ্চিত ঘাম দেখা গেল। আমার মনে মনে হাসি পেল,আমার মত দুই লাইন জানা বকলমের সামনের পড়ে উনার এই অবস্থা আর যারা নজরুল গবেষক তাদের সামনে পড়লে উনার কি হতো?
আমি বললাম, উনাকে কি মনে মনে হিন্দু ভাবছেন? ইয়ে মানে উনি আবার লিখেছিলেন,
" জগদীশ্বর ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য/ আমি বিদ্রোহী ভুগু,ভগবান বুকে
একে দিই পদচিহ্ন;"
এখন বলেন, মানুষ কি ভগবানের বুকে পদচিহ্ন আকার অধিকার রাখেন? ভগবানের বুকে পদচিহ্ন দেয়ার এই চেষ্টা যদি ভগবান প্রেমিরা টের পায় তাহলে নজরুলের কি অবস্থা হবে?
উনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন - তিনি তো ভগবানের বুকে পা দিতে চাইছেন, ভগবান আর আল্লাহ তো এক না।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, যতদুর জানি, ভগবান, গড, আল্লাহ, স্রষ্টা সব কিছুই মানেই এক।
তিনি বললেন, আপনাদের মত মানসিকতার লোকজন এই সব বলে।
আমি বললাম, ঠিক আছে বাদ দেন। উনি আরো কি লিখেছেন শুনেন, এই বলে ইন্টারনেট সার্চ করে শোনালাম কাজী নজরুলের বিখ্যাত কবিতা 'মানুষের' কিছু লাইনঃ
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন’ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে!
আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ,
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।
এইবার ভদ্রলোক কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, এই গুলো উনি লিখছে? কোন প্রমান আছে? কিছু কিছু মাহযাবের লোক অবশ্য এই সব বলে। আপনে বলেন, নজরুলের মাহজাব কি? তিনি কি ছিলেন? তাইলেই উত্তর পাওয়া যাবে।
অট্রহাসি দিয়া বললাম, ভদ্রলোক একজন মানুষ ছিলেন। যা আপনি এখনও হতে পারেন নাই। মক্কা বহুত দুর।
এই বলে উক্ত আত্মীয়ের বাসা থেকে আপন নিবাসে হাটা দিলাম। নজরুল কি ছিলেন, এই প্রসঙ্গে ব্লগার কুনোব্যাঙ একটি যুগান্তকারী উক্তি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন বাংলা ব্লগে নজরুল ইসলাম যদি কখনও ব্লগিং করতেন, বিদুষী ব্লগাররা তার আস্তিক নাস্তিক পরিচয় নিয়া বিরক্ত হইয়া শেষ পর্যন্ত 'হিটসিকার' ট্যাগ দিয়া ঢেঁকুর তুলিত।
বিশ্বকবি নজরুল
আমি অফিসে আসার সময় সাধারনত গাড়িতে এফএম রেডিও শুনি। নজরুলের কোন এক জন্মদিন উপলক্ষে আরজে বললেন, আজকে বিশ্বকবি কাজী নজরুলের জন্মদিন। এই উপলক্ষে চলুন নজরুলের একটা বিখ্যাত গান শুনে আসি। এরপর তিনি ক্লোজআপ ওয়ান খ্যাত এক তরুন শিল্পীর দ্বারা রিমিক্স কৃত 'আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন' গানটি বাজালেন। এই গানটি ইতিমধ্যে অনেকেই গেয়েছেন, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় বা শ্রোতাদের মনে দাগ কেটেছে মোহাম্মদ রফির কন্ঠে গাওয়া গানটি।
নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের কোন গানকে নিজের মত করে গাওয়া দোষের কিছু নয়, আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারেও আমি দোষের কিছু দেখি না। তবে, নিজের মত করে গাইতে গিয়ে যদি কেউ সুরের বিকৃতি করেন, সেটা নৈতিকভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। এখানে কপিরাইট বিষয়ক বিবেচনা পরে আসবে। উল্লেখ্য, তরুন শিল্পীটি এই গানটিকে রুপান্তর করার সময় অনেক আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছেন, কিন্তু নষ্ট করেছেন এই গানটির গায়কীর ধরনকে, আবেগের গভীরতার স্থানটিকে। তবুও তার এই চেষ্টাকে ভিন্নতর চেষ্টা হিসেবে আমি স্বাগতই জানাই। যদিও উনার গাওয়া এই গানটি কোনভাবেই নজরুলগীতির সৌন্দর্য, শ্রুতি মাধুর্য্য তরুন প্রজন্মের শ্রোতাদেরকে নজরুলকে চিনতে সাহায্য করবে না। অথচ বিভিন্ন এফএম চ্যানেলে যখনই এই গানটি শুনতে কেউ অনুরোধ করেন, তখনই আমি শুনেছি ঐ তরুন শিল্পীর রিমিক্সটি বাজানো হয়, মুল সুরের গানটি কেউ বাজান না। আমাদের দেশের কত বিখ্যাত নজরুল শিল্পী রয়েছেন, তাদের গাওয়া গান বাজাতে খুবই কম শুনি। কিছুদিন পর মানুষ হয়ত নজরুল সংগীত চিনবেন, কিন্তু তারা ফিরোজা বেগমকে আর চিনবেনও না।
অথচ বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে, নজরুল সংগীতকে তরুন প্রজন্মকে সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কাজটি কিন্তু আমাদের এই এফএম চ্যানেলগুলো চমৎকারভাবে করতে পারত। শুধু তাই নয়, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, লালন, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, ইত্যাদি ঘরনার গানগুলোকে তারাও প্রমোট করতে পারতেন। বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের নিজেদের যদি সম্মানবোধ না থাকে এবং কোন গান কিভাবে রুপান্তর করতে হয়, কতটুকু রুপান্তর করতে সেই সম্পর্কে ধারনা না থাকে, তাহলে কালের বিবর্তনে এই সকল হারিয়ে যাবে এটা নিশ্চিত। আমাদের এফএম রেডিওগুলোতে যারা আরজে রয়েছেন, অনুষ্ঠান পরিচালক রয়েছেন, তারা এই বিষয়ে দৃষ্টি দিবেন, এগিয়ে আসবেন, এটাই আমি কামনা করি। পাশাপাশি, রেডিও জকিদের জানা উচিত, কে বিশ্বকবি, কে বিদ্রোহী কবি। এটা বেসিক ব্যাপার। গোড়াতেই গলদ লজ্জাজনক।
যাইহোক, আমি ঐ রেডিও উপস্থাপিকার কথা শুনে, তাঁকে এসএমএস পাঠিয়ে বিষয়টি সংশোধনের অনুরোধ করি এবং আরো অনুরোধ করি, রুপান্তর ব্যাতীত কোন বিখ্যাত শিল্পীর নজরুলের গান পরিবেশন করতে। তিনি আমার এসএমএসটি পড়েছেন, ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং অনুপ জালোটার গাওয়া "খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে" গানটি বাজিয়েছেন। তাঁকে ধন্যবাদ।
সমস্যা হচ্ছে এই অনুষ্ঠানটি কাকতালীয়ভাবে আমার স্ত্রীও শুনছিলেন। কিছুক্ষন পর আমাকে ফোন দিয়ে হিসহিস করতে করতে বললেন - মহিলা আরজের সাথে এত মাখামাখি কিসের?
আমি বললাম, নজরু..।
স্ত্রী বললেন, ভাড়মে...।
তসলিমা নাসরিন
যাইহোক, নজরুল প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলে শেষ করছি। বছর কয়েক আগের কথা। সেবার জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মদিনের উপলক্ষে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বেশ কিছু ফিচার ছাপা হয়েছিলো। বাংলাদেশ প্রতিদিন নামক পত্রিকাও কবিকে নিয়ে বিশাল ফিচার ছাপিয়েছিলেন। হঠাৎ পাশের পৃষ্ঠায় তসলিমা নাসরিনের কলাম দেখে পিলে চমকে উঠল।
মনে মনে আতংকিত হয়ে ভাবলাম, সর্বনাস! তসলিমা নাসরিন কি নজরুলকে নিয়ে কোন স্মৃতিচারন করেছেন কিনা? সাধারন মানুষের স্মৃতিচারনে সমস্যা থাকে না, কিন্তু "সাহিত্য" প্রেক্ষাপটে আমাদের তসলিমা নাসরিন যতটি স্মৃতিকাহিনী বর্ণনা করেছেন তার প্রায় সবগুলোতে দেখা গেছে দেশের স্বনামধন্য কবি, সাহিত্যিকরা নাকি প্রায় সকলেই তাঁর গায়ে 'হাত' দিয়েছেন। উনার লেখা পড়ে আমার ধারনা জন্মেছিলো, ভালো লেখক হইতে হলে তসলিমা নাসরিনের গায়ে 'হাত' দেয়া নিপাতনে সিদ্ধ।
পরবর্তীতে অবশ্য আমার আশংকা অমুলক প্রমানিত হয়েছিলো। সেবার তিনি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রামকে নিয়ে কলাম লিখেছিলেন। বেঁচে গিয়েছেন নজরুল। সাথে সাথে মন থেকে ভার নেমে গেলো। আনন্দ নিয়ে বললাম, শুভ জন্মদিন নজরুল। মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। বেঁচে থাকলে আপনার জীবন এই দেশে বিপন্ন হতো।
দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, তারুন্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি রইল আমার গভীর সম্মান এবং ভালোবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২৩ বিকাল ৪:৫৬