আগের মত করে আমি মুভি রিভিউ লিখতে পারি না আর। অত কথা বলতে বা লিখতে ভালোও লাগে না। মনে হয়, কোনও মুভি সম্পর্কে লিখতে গেলে সংক্ষেপে লেখাই ভালো, পড়তেও ভালো লাগে, অতিরিক্ত স্পয়লারও দেয়া হয় না কাজেই যিনি পড়বেন তারও দেখার একটা আগ্রহ বজায় থাকে। অত লেখার আমার সুযোগই বা কোথায়? আর আজকে যে ভদ্রলোককে নিয়ে লিখছি ওনাকে নিয়ে অমনিই অনেক লেখা হয়ে গেছে, আমি আর নতুন করে কিই বা বলতে পারি?

অনেক রকমের কাহিনী বা চরিত্র তার করা আছে, আমার কাছে যেগুলো একটু ব্যতিক্রম মনে হয়ছে বা মনে একটু বেশি দাগ কেটেছে সেরকম কয়েকটার কথা বলি।
বনপলাশীর পদাবলী
আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, এই ছবির মূল কাহিনীটা তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস থেকে নেয়া। বনপলাশী নামক একটা গ্রামের কিছু মানুষের গল্প। তাদের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া, ভালোবাসাবাসি... আলাদা আলাদা কিছু গল্প জোড়া দিয়ে পুরো মুভিটা বানানো (Pulp Fiction টাইপের???)। অনেকগুলো গল্প বলেই চরিত্রও অনেকগুলো, কিন্তু একটু ধৈর্য ধরে দেখতে পারলে আর উঠতে ইচ্ছে করবে না। জানি না কেন এই ছবির দৃশ্যগুলো আমাকে কেমন যেন টেনে নিতে থাকে, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতে থাকি। মেকিংটা খুব মাটির কাছাকাছি বলেই হয়তো। উদাস (উত্তম কুমার) কিংবা পদ্ম (সুপ্রিয়া দেবী)'র মুখের দেহাতী ভাষা আর পরষ্পরকে পাগলের মত ভালোবেসেও কাছে আসতে না পারার যন্ত্রণাগুলো অদ্ভুত বাঙ্ময়।
শেষের দিকে যখন উদাস যখন পদ্ম'র মৃতদেহটা কোলে করে বয়ে এনে ডাক্তারের কাছে মিনতি করে বলে "তুই তো কত লোকের প্রাণ ফিরায়ে দিস ডাক্তার, আমার পদ্ম’র প্রাণটা ফিরায়ে দে... দে না ক্যানে!" অনেক চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকে রাখা যায় না।
নাহ, উত্তম কুমার লোকটা আসলেই জোস অভিনয় করতো।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি
বারবার দেখেও আশ মেটে না মুভিটা। ভারতীয় এক অ্যাংলো যুবক কিভাবে বাংলা গানকে ভালোবেসে ফেলে, তারপর কবিয়াল হবে বলে কবি গানের লড়াইয়ে নাম লেখায়, সাধনা করতে করতে কিভাবে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি নিদারুণভাবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে (তনুজা) হারায়, এই নিয়েই গল্প। মুভিটা যেমন সুন্দর, তারচেয়েও বেশি পাওয়ারফুল হলো গানগুলো, পুরা মাথা নষ্ট করা মিউজিক এই ছবির! একটা ট্র্যাক আমার অস্বাভাবিক প্রিয়, অনেক আগে ভিডিওটা আমার মান্না দে’কে নিয়ে লেখা পোস্টে দিয়েছিলাম, আজকে আবার দিলাম।
বিকেলে ভোরের ফুল
এটা হলো একটা অসম ভালোবাসার কাহিনী (সমরেশ বসুর উপন্যাস)। প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নামকরা লেখক ভালোবেসে ফেলে বাচ্চা একটি মেয়েকে (সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়)। বাচ্চা মেয়ে বলতে যতটা না বয়সে বাচ্চা তারচেয়েও বেশি মননে বাচ্চা, ছেলেমানুষ। তারা জানে যে তাদের মিলন সম্ভব নয় তবু কিছুতেই এত তীব্র ভালোবাসা ছেড়ে যেতে পারে না... যদিও শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার কারণে আসলে তাদের কিছুই করার থাকে না।
এই মুভিটাও দেখতে অদ্ভুত ভালো লাগে। একটা দৃশ্য আছে সমুদ্রস্নানের, যেখানে অনীশ রায়ের (উত্তম কুমার) বাহুবন্ধনে টুকু (সুমিত্রা)... They are having the fun of bathing together under the blue sky… বর্ণনা দেয়ার ভাষা নেই আমার।
এগুলো ছাড়াও এই ছবিতে চরম ভৌতিক একটা দৃশ্য আছে, মহা ভীতু বলে আমাকে ওটা প্রায়ই স্কিপ করে যেতে হয়।

সপ্তপদী
এতক্ষণে একটা মুভির নাম এলো যেটায় উত্তম কুমারের সাথে সুচিত্রা সেনের নাম পাওয়া যাবে। আসলে উত্তম-সুচিত্রা জুটিটা আমার খারাপ লাগে না তবে এই জুটির অধিকাংশ ছবিই আমার কাছে একটু টিপিক্যাল মনে হয়... অবশ্য আমার ভুলও হয়ে থাকতে পারে। এটাও ভালো মুভি, গানের কথাও বলাই বাহুল্য (এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?)

নায়ক
এটা তো সত্যজিৎ রায়ের ছবি, আর সেজন্যেই আরও বেশি করে তুলনাহীন। পুরো গল্পটাই একটা ট্রেন ভ্রমণের মধ্যে। একেবারে ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে একজন অভিনেতার উত্তরণ, তুমুল খ্যাতি কিন্তু অতীতকে মনে করে ফেরা, একজন সাংবাদিকের কাছে (শর্মিলা ঠাকুর) নিজেকে খুলে-মেলে দেয়া, নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করতে থাকা... সত্যজিৎ রায় সম্ভবতঃ এই একটিই ছবি করেছেন উত্তম কুমারকে নিয়ে, এবং আসলেই পারফেক্ট চয়েস। এই ছবিতে উত্তম কুমারের ডায়ালগ ডেলিভারি এত চমৎকার যে প্রতিটা কথা প্রায় বাস্তব বলে ভ্রম হয়।
[নেটে এই ভদ্রলোকের প্রচুর ছবি আছে, কিন্তু কেন যেন একটাও দিতে ইচ্ছে করছে না। অনেক খুঁজেও সবগুলো মুভির পোস্টার পেলাম না, যে দু'একটা মুভির পেলাম সেগুলোও ভালো লাগছে না। এই পোস্টটা এভাবেই থাক। পরে নেহাতই যদি ভালো লাগে তাহলে আর দু’একটা দেয়া যাবে... অবশ্য সে সম্ভাবনাও কম।
