মারে একটা স্বপ্ন দেখেছিলো।
বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান উভয়েই, স্বপ্নজগতে আমাদের অশরীরী স্বত্তার ভ্রমণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অনেক হাতড়ে অবশেষে মানতে বাধ্য হয়েছে যে, ঘুম হলো মৃত্যুর যমজ ভাই। এই গল্পটি কিন্তু স্বপ্নের মত মায়াবী কিছু নয়, এটি কেবল মারে’র সেই স্বপ্নের বয়ান ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্পূর্ণ জাগ্রত সেই ঘুমের সবচেয়ে গোলমেলে অংশগুলোর মধ্যে একটা হলো তখন, যখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড কিংবা কয়েক মিনিটের মধ্যে দীর্ঘ কয়েক মাস বা কয়েক বছর কেটে গেছে বলে ভ্রম হয়।
মারে কারাগারে তার সেলের ভেতর বসেছিলো। করিডরে একটা বৈদ্যুতিক বাতি ঝকঝকে আলো ফেলছিলো তার টেবলের ওপর। সেখানে এক টুকরো সাদা কাগজে একটা পিঁপড়া দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে এদিক ওদিক ছুটছিলো আর যেদিকেই যাচ্ছিলো, মারে সেদিকেই একটা খাম দিয়ে ওটার পথরোধ করছিলো। রাত আটটায় বৈদ্যুতিক চেয়ারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা ছিলো। কীটজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান সদস্যটির কাণ্ডকারখানা দেখে মারে হাসছিলো আপনমনে।
সেই চেম্বারটায় আরও ৭জন অপরাধী বন্দী ছিলো। মারে এখানে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩জনকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে চলে যেতে হয়েছে- প্রথমজন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিলো, ফাঁদে পড়া নেকড়ের মত ক্রুদ্ধ গর্জন করতো; ২য়জনেরও প্রায় একই অবস্থা, খালি পার্থক্য এই যে সে একেবারে পাগলের মত ধর্মাসক্ত হয়ে পড়েছিলো, সারাক্ষণ আকাশের দিকে মুখ তুলে ঈশ্বরের কাছে বিড়বিড় করে কি সব প্রার্থনা করতো; আর ৩য় জন শারিরীকভাবে একেবারে ভগ্ন ও পঙ্গু হয়ে পড়েছিলো, তাকে বোর্ডের সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো। সে নিজে যে সম্পূর্ণ অক্ষত দেহ নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারছিলো এটা ভেবেই সে অবাক হচ্ছিলো ভীষণ। আসলে সেদিনের সন্ধ্যাটাই ছিলো তার জন্য শেষ সন্ধ্যা। আটটা বোধহয় বাজতে চললো, সে ভাবছিলো বসে।
তার উল্টোদিকের সেলে বোনাফ্যাসিও’র সেল ছিলো- সিসিলির অধিবাসী সেই বোনাফ্যাসিও, যে কিনা তার নিজের বাগদত্তা এবং তাকে অ্যারেস্ট করতে আসা দু’জন অফিসারকে হত্যা করেছিলো। যার সাথে মারে ঘন্টার পর ঘন্টা চেকার খেলতো, পরষ্পরকে না দেখেই তারা তাদের অদেখা প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে চাল ছুঁড়ে দিতো।
দারুণ সুরেলা সঙ্গীতময় আর গমগমে একটা কন্ঠস্বর ছিলো বোনাফ্যাসিওর। সেই চমৎকার কন্ঠটিতে ঢেউ তুলে বোনাফ্যাসিও হাঁকলো--- দোস্ত মারে, কেমন লাগছে তোমার, হুঁ?
পিঁপড়াটাকে খামের ওপর তুলে নিয়ে তাকে টেবলের ওপর থেকে আলতো করে পাথরের মেঝেতে ফেলে দিয়ে মৃদু হেসে মারে উত্তর দিলো--- হ্যাঁ দোস্ত, ভালোই লাগছে।
ভালো-ও লাগা তো ভালো-ও, বুঝলে কিনা-আ? আমাদের মত মানুষদে-এর সত্যিকারের পুরুষের মত-অই মরা উচিত। আগামী-ই সপ্তাহে আমার পালা আসছে। বন্ধু, মনে রেখো, শে-এষ গেমটায় কিন্তু আমি তোমাকে হারি-ইয়েছিলাম। ভাগ্যে থাকলে আবারও-ও একদিন আমরা এরকম খেলতে বসবো, যদিও জানিনা-আ এমন হবে কিনা। হয়তো এরা আমাদেরকে এমন এক জায়গায় পাঠাবে যেখানে এখানকার চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে -এ হেঁকে চাল দিতে হবে--- সিসিলিয়ান উচ্চারণে টেনে টেনে বোনাফ্যাসিও বললো।
বোনাফ্যাসিওর সেই দৃঢ় দর্শন আর তারপর গাঢ়স্বরে তীব্র অট্টহাসি মারে'র অসাড় হয়ে যাওয়া মনটাকে কিছুটা হলেও চাঙ্গা করে তুললো। বেচারার হাতে এখন আর কেবল একটা সপ্তাহ বাকী আছে- ভাবছিলো মারে।
কারারক্ষীরা করিডরের সর্বশেষ প্রান্তটার কুলুপ সরিয়ে দিলে সেলের অধিবাসীরা তাদের বহু পরিচিত সেই ইস্পাতের তালাচাবির আওয়াজটা শুনতে পেলো আবার। তিনজন লোক এসে মারে'র সেলের তালা খুলে দিলো। তাদের মধ্যে দু’জন ছিলো গার্ড, আর একজন ছিলো 'লেন'--- না, ঐ নামে তাকে আগে এককালে ডাকা যেতো, এখন আর যায় না- এখন তাকে বলতে হবে রেভারেন্ড লিওনার্ড উইনস্টন, মারে'র ছোট্টবেলার প্রতিবেশী এবং বন্ধু।
ভদ্রলোকের বাম হাতে ধরা ছিলো একটা বাইবেল, সেখানে তর্জনী দিয়ে একটা বিশেষ পেজ মার্ক করে রাখা।
মৃদু হেসে মারে তার ছোট্ট টেবলটায় কয়েকটা বই আর কলমদানী গুছিয়ে রাখলো, সাত তাড়াতাড়ি। তার কিছু একটা বলতে খুব মন চাইছিলো কিন্তু ঠিক বলার মত কিছু সে ভেবে পাচ্ছিলো না কিছুতেই।
বন্দীরা এই সেলহাউসটার নাম দিয়েছে লিম্বো লেন, সাকুল্যে দৈর্ঘ্যে আশি ফিট আর প্রস্থে আটাশ ফিট।
লিম্বো লেনের রোজকার পাহারাদার, বিশালদেহী রুক্ষ কিন্তু দয়ালু লোকটা পকেট থেকে একটা হুইস্কির পাইন্ট বোতল বার করে মারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো- এটা আসলে স্বাভাবিক ব্যাপার, জানোই তো। একটু দুর্বল বোধ করলে যে কেউ এটা খেতে পারে। এতে বদঅভ্যাস হয়ে যাওয়ার কিছু নেই।
মারে বোতলটায় গভীর একটা চুমুক দিলো।
এই তো ভালো ছেলে! – গার্ডটি বললো। সামান্য একটু নার্ভ টনিক নিয়ে নাও, তারপর দেখবে সবকিছু কেমন সুন্দরভাবে হয়।
করিডরের বাইরে পা বাড়ালো তারা। মনে হতে পারে লিম্বো লেন জায়গাটা পৃথিবীর বাইরে কোথাও, কিন্তু একটা জিনিস সে ঠিকই তার কয়েদীদের শিখিয়েছে - পঞ্চেন্দ্রিয়ের কোনও একটা বা দু’টো যদি বিকল হয়ে পড়ে তবে অন্য আরেকটা এমনভাবে কাজ করে যে ঠিকই সে বিকল ইন্দ্রিয়টার অভাবটা পুষিয়ে দেয়। তারা সবাই জানতো যে রাত আটটা প্রায় বাজতে চললো, এবং আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই অমোঘ মৃত্যু এসে আলিঙ্গন করবে মারেকে। অপরাধ সাম্রাজ্যে এরকম আরও কত অজস্র লিম্বো লেন আছে। মানুষ দিনের আলোয় হত্যা করে, শত্রুকে হারায়, আদিম আবেগের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধ করার মনোভাব পোষণ করে- কারণ সে যতই মানুষ হোক না কেন, আসলে সে নিজের ভেতর ইঁদুর, মাকড়সা কিংবা সাপের মত নিম্নশ্রেণীর প্রাণীকেই ধারণ করে।
তো, চিরবিদায়ের পথে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবার সময় সেই সাতজন অপরাধীর মধ্যে মারে মাত্র তিনজনকে বিদায় দিতে পেরেছিলো--- বোনাফ্যাসিও, মারভিন- যে জেল থেকে পালানোর সময় ধরা পড়ে যাওয়ায় একজন গার্ডকে হত্যা করেছিলো, ব্যাসেট- ট্রেন ডাকাত, জোর করে ট্রেনটা ডাকাতি করতে বাধ্য হয়েছিলো কারণ সে হাত দেখানোর পরও গার্ড ট্রেনটা থামায়নি বলে। সাতজনের বাকি চারজন ছিলো স্তব্ধ, নিশ্চুপ... আইনের অবমাননা করে যে অপরাধ তারা করেছে তারচেয়েও বেশি এই লিম্বো লেনের ভেতরে একঘরে হয়ে যাওয়ার অনুভূতিটাই তাদের বুকে বাজছিলো বেশি।
এমন একটা অবস্থায় আসার পরও মারে তার নিজের উদাসীনতা আর স্থিরতা দেখে অবাক হচ্ছিলো। মৃত্যুদণ্ড কক্ষে প্রায় কুড়িজন লোক ছিলো, একদল জেলার, খবরের কাগজের সাংবাদিক, এবং বেশকিছু দর্শক যারা-
.
.
.
************************************************
.
.
.
.
গল্পটা এটুকু পর্যন্ত লিখেই ও’ হেনরী সাহেব মারা যান। গল্পে মারে'র মৃত্যুদন্ড দৃশ্যের ঠিক মাঝামাঝি আসতে না আসতেই বাস্তব জীবনে মৃত্যু তাঁর কন্ঠরোধ করে দেয় চিরতরে। তাঁর অন্যান্য লেখাগুলোর চেয়ে তিনি এই লেখাটাকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন, একটা নতুন ধরণ শুরু করতে চেয়েছিলেন যা তিনি আগে কখনও করেননি। তিনি বলেছিলেন- আমি মানুষকে দেখাতে চাই যে আমিও নতুন কিছু লিখতে পারি, এমন কিছু যা আমার জন্য নতুন- যাতে কোনও নোংরা কথা থাকবে না... আমি এমন কিছু লিখতে চাই যা সত্যিকারের একটা গল্প বলতে আমি যা বুঝি তার খুব কাছাকাছি যাবে, খুব সোজাসাপটা এবং নাটকীয়তায় ভরপুর একটা কাহিনী হবে। এই গল্পটি লিখতে শুরু করার আগে তিনি অল্প কথায় এর একটা আইডিয়া দাঁড় করিয়েছিলেন যেটা ছিলো এরকম--- মারে নামে একজন খুনীর গল্প, সে নির্মমভাবে তার প্রেমিকাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়; তীব্র ঈর্ষান্বিত হয়ে করা হয়েছিলো সেই খুন। মৃত্যুর কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে আসতে আসতে একসময় সে শান্ত, স্থবির এবং সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যায়। ইলেক্ট্রিক চেয়ারের দিকে এগোতে এগোতে এক পর্যায়ে সে খুব তীব্র অনুভূতির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে প্রায় স্থাণু এবং অসাড় হয়ে পড়ে। মৃত্যুকক্ষ, সাক্ষী, দর্শক, হত্যাকাণ্ডের ব্যবস্থা- সবকিছুই তার কাছে একটা ভ্রম বলে মনে হতে থাকে। বিদ্যুচ্চমকের মত তার শুধু মনে হয়, কোথাও খুব বড় একটা ভুল হচ্ছে। কেন তাকে ইলেক্ট্রিক চেয়ারের সাথে বাঁধা হচ্ছে? সে কি করেছে? কি তার অপরাধ? তার শরীরের সাথে চেয়ারের স্ট্র্যাপগুলো আটকে দেবার সময় সে একটা নতুন স্বপ্নদৃশ্য দেখতে পায়। ছবির মত সুন্দর একটা গ্রাম, মায়াবী প্রকৃতির মাঝে ছোট্ট একটা বাড়ি, উজ্জ্বল সূর্যের আলো, একপাশে ফুলের বাগান- তার পাশে একজন নারী, একটা ছোট্ট শিশু। নারীটি তারই স্ত্রী, শিশুটিও তাদের, তারা সবাই কথা বলছে একে অপরের সাথে। বাড়িটাও তাদেরই। শুধু এটাই সত্যি, আর সবকিছু ভ্রম! নিশ্চয়ই কোথাও কেউ খুব বড় কোনও ভুল করেছে- খুব ভয়াবহ সেই ভুল, যে ভুলের কোনও সংশোধন হয় না। তার অপরাধ, এই বিচার, এই রায়, এই মৃত্যুদণ্ড- আসলে সব স্বপ্ন! সে তার স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে, শিশুটির মুখে চুমু খায়। হ্যাঁ, এই তো সুখ! কিন্তু এটাই ছিলো স্বপ্ন।
তারপর শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, জেলের ওয়ার্ডেন ইলেক্ট্রিক চেয়ারের সুইচ অন করে দিচ্ছেন।
মারে আসলে একটা ভুল স্বপ্ন দেখেছিলো।
... ... ...
ও হেনরী
আসল নাম- উইলিয়াম সিডনি পোর্টার
ছদ্মনাম- ও হেনরী, অলিভার হেনরী, অলিভিয়ের হেনরী
জন্ম- ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৮৬২// গ্রীনসবোরো, নর্থ ক্যারোলিনা
মৃত্যু- ৫ই জুন, ১৯১০// নিউইয়র্ক
মূল লেখার লিংক
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১:৪১