প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, হঠাৎ দেখি ফোনটা বাজছে।
এত রাতে আবার কে ফোন করে রে বাবা!
স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখি যথারীতি আমাদের দোস্ত বিজু বাবাজী কল করেছেন (কেবল মধ্যরাত্রেই তেনার আমাদের কল করার সাধ জাগে এবং আমরাও একেবারে ধন্য হয়ে যাই আর কি)।
- কি রে বাপ তোর কি খায়া দায়া আর কাজ নাই তুই আবার মাঝরাতে ফোন করছিস?
- ওরে এইদফা আমার বোধহয় আর বিয়ে করা হলো না রে!
- কেন, কি সমস্যা?
- রানুর ফ্যামিলি থেকে খুব চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য।
- হ্যাঁ তো অসুবিধা কোথায়? করে ফ্যাল বিয়ে।
- আরে আমার বাসায় তো একদম রাজি না। মাথার ওপর দুই দুইটা বড় ভাই বোন থাকতে আগ বাড়িয়ে আমাকে আগে বিয়ে দেবে নাকি? বাবা বারবার বলেছেন আমি এখন বিয়ে করলে আমার বিয়েতে উনি যাবেন না। মায়েরও কথা ঐরকমই। ভাই বোন দুটো নেহাত মুখ ফুটে কিছু বলছে না কিন্তু তারাও আমার বিয়ে নিয়ে লাফালাফি দেখে অবাক।
- হ্যাঁ, তা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। কি আর করবি বল, ম্যানেজ করার চেষ্টা কর।
- আরে আমার একটা বড় বোন আছে, তার বিয়ে হওয়ার আগেই আমি বিয়ে করতে চাইবো কেন? কিন্তু পরিস্থিতিটা যে এরকম দাঁড়িয়ে যাবে তা কি আর জানতাম?
'পরিস্থিতি'টা কিরকম একটু দেখা যাক।
রানু এবং বিজু আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধু এবং সতীর্থ। বরাবরই তারা ভালো বন্ধু ছিলো কিন্তু তাদের মধ্যে প্রেম বলে কিছু ছিলো না। পাশ করে চাকরি পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর বিজুকে রানুর পরিবার থেকে জানানো হলো যে জামাই হিসেবে তাকে ওনাদের বেশ পছন্দ, সে যেন এই ব্যাপারটা নিয়ে রানুর সাথে আলোচনা করে। স্বাভাবিকভাবেই বিজু ধরে নিয়েছিলো যে এতে রানুর মত আছে এবং সে খুব ফরমালি বিয়ের প্রস্তাব দিলো রানুকে। কিন্তু রানুর অন্য একটি ছেলের প্রতি একটা Crush ছিলো এবং সে কোনওভাবেই মাথা থেকে সেটা তাড়াতে পারতো না। কাজেই বিজুর প্রস্তাবে সে রাজি হতে পারলো না।
রানু বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পরপরই বিজু খুব অবাক হয়ে খেয়াল করলো যে সে রানুর প্রেমে পড়ে গেছে!
তারপর পদ্মা যমুনায় কত জল গড়িয়ে গেলো। বিজু চাকরি নিয়ে চলে গেলো আবুধাবি, রানুর জন্যও কত পাত্র দেখা হলো, আমরা তাকে কত করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, যে ছেলেটিকে নিয়ে রানু স্বপ্ন দেখতো তারও এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো, সে নিজে থেকে রানুকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে তাকে নিয়ে পড়ে থেকে লাভ নেই, সে কখনও রানুর ছিলোও না হবেও না, বিজুও বুকের কষ্ট বুকেই চেপে কত দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী পার করে দিলো... তবু সবকিছু যেমন ছিলো তেমনই রয়ে গেলো।
অনেকদিন পর বিজু একদিন দেশে ফিরলে আবারও বন্ধু বান্ধুবের সহায়তায় রানুর মত ফেরানোর চেষ্টা করা হলো। রানু নিজেও বোধহয় খুব ডেসপারেট হয়ে গেছিলো ব্যাপারটা নিয়ে, বিজুর সাথে হাড্ডাহাড্ডি একটা শোডাউনের পর সে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলো।
স্বপ্নের মত একটা দিন ছিলো সেটা। আমি নিজে অন্ততঃ ওদের দুজনকে অন্য কারও পাশে কল্পনাও করতে পারতাম না। অনেক আগে থেকেই ওদেরকে আমার একেবারে মেড ফর ইচ আদার জুটি মনে হয়। মনে মনে কতবার যে চেয়েছি এই ব্যাপারটা হোক... সেজন্যই ঐদিনটা আমার কাছে অনেকগুলো ঈদের দিনের চেয়েও অনেক বেশি আনন্দময়।
তারপরই যথারীতি পারিবারিক সমস্যাগুলো দেখা দিলো এবং সেখান থেকেই ঐ ফোনকলের অবতারণা...
- এখন তুই বল ভেবু আমি কি করবো।।
- আরে ধুর ধুর, এগুলো সব ঠিক হয়ে যাবে।
- বলছিস! সত্যি! কিন্তু ক্যামনে কি?
- Baby just wait n see! তুই এগুলো নিয়ে কোনও চিন্তাই করিস না। তুই বরং চিন্তা কর পাত্রীপক্ষের লোক হিসেবে আমি তোর বিয়েতে গেট ধরলে তুই আমাকে কি দিবি। হা হা হা...
- সত্যি যদি বিয়ে হয়, তাহলে তুই যা চাইবি আমি তাই দেবো। প্রমিজ।
- ধুরো ব্যাটা, আমি তো ঠাট্টা করলাম। আমাকে কিছু দিতে হবে না। তুই এখন শুধু ভাব কিভাবে কার্যসমাধা করা যায়। কিন্তু বেশি টেনশন নিস না, জানি না কেন আমার মন বলছে শেষপর্যন্ত ভয় পাওয়ার মত কিছুই হবে না। তোমার বিয়ের সানাই এই বাজলো বলে, বাছাধন!

তারপর ধীরে ধীরে সেই দিনটা ঘনিয়ে এলো। পাত্রীর অর্থাৎ রানুর বাড়ি রাজশাহীতে কাজেই প্রোগ্রামটাও সেখানে। আল্লাহর ওয়াস্তে একাই রওনা দিলাম (আসলে আমার 'জোড়েই' যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু যার সঙ্গে যাবো তিনি ম্যালা ব্যস্ত মানুষ, তাই আমাকে বললেন সকালের বাস ধরতে, তিনি রাতের বাসে আসবেন)। সেদিন এনগেজমেন্ট হবে বলেই ঠিক করা ছিলো, তবে পাত্রীপক্ষ অন দ্য স্পট বিয়ের দাবীতে সোচ্চার ছিলো (কারণ খুব অল্পকিছুদিন পরেই বিজু আবার আবুধাবি ফিরে যাবে, তারপর আবার কবে ফিরবে তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই)। আর পাত্রপক্ষও অনড়, এভাবে তারা পরিবারের ছোটছেলের (তায় একমাত্র ইঞ্জিনিয়ারের) বিয়ে দেবে না, অন্তত বড় একটি মেয়েকে অবিবাহিত রেখে তো নয়ই।
তো পাত্রপক্ষ ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ধুন্ধুমার বেধে গেলো। তাদের বক্তব্য হচ্ছে তাদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাগত জানানো হয়নি এবং শরবত-মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়নি (তাদেরও দোষ দেয়া যায় না, একে তো এটা বাংলাদেশ তারওপর তাঁরা আবার বিয়ের অতিথি এবং পাত্রপক্ষ, কিছু খাতিরদারি তো অবশ্যই তাদের প্রাপ্য ছিলো)। অশেষ বাকবিতন্ডার মধ্য দিয়ে আংটি পরানো পর্ব শেষ হলো এবং বিয়ে হবে কি হবে না তারও খুব ফিক্সড কোনও সিদ্ধান্ত হলো না। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিলো যার ম্যানেজারিয়াল এবিলিটি খুবই উচ্চমানের, সে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলো বিয়ের ব্যাপারে সবাইকে রাজি করানোর, লাভ কিছুটা হলোও তবে আড়ালে আবডালে, সামনাসামনি নয়। বিজুর মামা খুব রসিক ব্যক্তি, তিনি খুব ভালো বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর ভাগ্নে মনেপ্রাণে চাইছে বিয়েটা করে ফেলতে, কাজেই তিনিও চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁর দুলাভাইকে (অর্থাৎ আমাদের আঙ্কেল বিজুর বাবাকে) রাজি করানোর। আর বিজুর বড়খালাও ছিলেন ঠিক সেরকম। এত বয়স হয়েছে কিন্তু রসবোধ রয়ে গেছে অল্পবয়সের মত। শি অলসো ডিড আ লট ফর দেম। মামা চুপিচুপি আমাদের জানিয়ে গেলেন যে পরেরদিন এসে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
ফলশ্রুতিতে পরদিন বেলা দুপুর গড়ানোর আগেই বিবাহপর্ব সমাধা হয়ে গেলো।
অসম্ভব গরম পড়েছিলো সেদিন। আশ্বিনের একদম শুরুর দিককার সময় ছিলো কিন্তু গরমটা ছিলো একেবারে জৈষ্ঠ্য মাসের মত। খুব সাদামাটা একটা পুরনো শাড়ি পরে বসেছিলো রানু। আমিই পরিয়ে দিয়েছিলাম। এমনিতেই সে একেবারে শিশুর মত সরল, সেদিন আরোই বাচ্চা লাগছিলো তাকে। গেট ধরা বলতে কেবল ছিলো বেডরুমের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। আমি পড়েছিলাম মহাফাঁপরে, যেদিকেই যাই উল্টোদিক থেকে লোকে ডাকতে থাকে। পাত্রীপক্ষ হয়ে গেট ধরার জো নেই, বিজুর (মতান্তরে আমাদের রুয়েট জীবনের) বন্ধুগুলো "আরে তুমি ঐদিকে কেন! তুমি কি খালি রানুর ফ্রেন্ড, বিজুর ফ্রেন্ড না? তুমি এদিকে আমাদের দলে এসো" বলে চিল্লায়। আবার সেদিকে যদিবা যাই সঙ্গে সঙ্গে রানুর খালাতো বোনগুলো চেঁচাতে থাকে "আপু তুমি ওদিকে কেন? তুমি তো পাত্রীপক্ষ! শিগগির এদিকে এসো।" খাবার বলতে আগের রাতে ক্যাটারারদের সার্ভ করা কিছু বাসি খাবার রয়ে গেছিলো, আর ছিলো বাড়ি ভর্তি মিষ্টি। সবাই রোজা ছিলো তাই কারুরই বিশেষ খাওয়ার চিন্তা ছিলো না। ভয়াবহ গরম পড়েছে দেখে নিজ দায়িত্বে বর বউকে লেবুর শরবত করে খাইয়েছিলাম (ওদের খাওয়াতে গিয়ে নিজেই ভুল করে খেয়ে ফেলেছিলাম, মনেই ছিলো না যে রোজা আছি)।

অফিসের ছুটি আর বাকি ছিলো না বলে আমরা দু'জন সেই রাতেই ঢাকা ফিরে এসেছিলাম।
পরদিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় ভাবলাম ফোন করে ওদের খোঁজখবর নিই। ফোন করতে গিয়ে খুব অবাক হয়ে দেখি, দুজনেরই ফোন বন্ধ। তাহলে কি...
আসলে ওদের বিয়ে হয়ে গেলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছিলো না। বিজুর বাবা মা খুব মন ছোট করে ছিলেন কাজেই শুধু বিয়েটাই হয়েছিলো, ওদের পক্ষে একত্রে থাকাটা সম্ভব ছিল না... অর্থাৎ They were not supposed to spend the night together. অনেক পরে বিজুকে ফোনে পাওয়া গেলে সে জানালো যে মামাই তাকে বলেছিলেন "আরে বিয়ে করলা আর একসাথে থাকবা না এ আবার কেমন কথা!"
এই কাহিনী শুনে আমি এমন মদন হয়েছিলাম যে আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো, "কেমন কাটলো রে বাসররাত?"
বিজুও রাম ফাজিল, চোখ মটকে বলেছিলো "অসসসসাধারণ!"

আমিও মুখ ঝামটা মেরে বলেছিলাম, "চুপ থাক শয়তান বান্দর বেহায়া বেয়াদব বেতমিজ বেশরম বেলাজ বেয়াড়া বে... বে... বে....."....

মধুচন্দ্রিমায় তারা কক্সবাজার ঘুরতে গেছিলো। সেই ছবিগুলোর দিকে আমরা বন্ধুরা এখনও তাকিয়ে থাকি। মনে হয় যেন ওরা বিয়ে করে নিজেরা যত সুখী হয়েছে, তারচেয়েও বেশি খুশী হয়েছি আমরা (সবচেয়ে বেশি হয়েছি আমি)।
বিজু আবার আবুধাবি ফিরে গিয়েছিলো, কিন্তু কিছুদিন বাদেই অতি মূল্যবান চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলো। একে তো ওখানে চাকরির নানান সমস্যা, তারওপর রানুকে ছেড়ে বিদেশ বিভুঁয়ে সে শান্তি পেত না কোনওভাবেই। রানুও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলো বিজু ফিরে আসায়।
প্রথম প্রথম ওদেরকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। দেশে ফিরে বিজুর তখনো চাকরি হয়নি। রানু একটা ভালো চাকরি করতো কিন্তু নতুন করে সংসার সাজানোর খরচ সামলে তার আর সেভিংস বলে কিছু বাকি ছিলো না। আমি বারবার করে বলে দিয়েছিলাম সংসারের জন্য আর যা কিছুই কিনুক না কেন বিছানা চাদর বালিশ কাঁথা এসব যেন কিছু না কেনে, ওগুলো আমি দেবো, উপহার হিসেবে। ওদের বিয়েটা এত অনাড়ম্বরভাবে হয়েছিলো যে ওরা কোনও গিফট পর্যন্ত পায়নি, মা বাবার কাছে মুখ ফুটে লজ্জার মাথা খেয়ে কিছু চাইতেও পারেনি। আমি খুব শখ করে বড় ডাবল বেড একটা ফোম, মনিপুরি চাদর, বালিশ, দুটো কুশন, ক্রুশ কাঁটায় কাজ করা কুশন কভার দিয়েছিলাম। পরে আমাদের অন্য ফ্রেন্ডরা ওদের ফ্রিজ কিনে দিয়েছিলো। একজন ফ্রেন্ড টাকা ধার দিয়েছিলো বেশ কিছু। আসলে আমাদের অনেকের জন্যই এটা ছিলো একটা ড্রিম রিলেশনশিপ, এর জন্য এটুকু তো করবোই।

আমার দেয়া শয্যাটার একটা ছবি দেয়ার খুবই ইচ্ছে ছিলো কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও একটা ভালো ছবি বার করতে পারলাম না।
এতগুলো দিন পেরিয়ে গেলো তবু এখনও ওদেরকে দেখতে একটুও পুরনো লাগে না। রানু রান্না করতে পারতো না, বিজু তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে। রানুও একেবারে বিজু অন্তপ্রাণ, একটু চাপা স্বভাবের বলে সে কখনও তার ভালোবাসা নিয়ে কোনও বাগাড়ম্বর করে না কিন্তু আসলে যে ঠিক কতটা ভালোবাসে সেটা খুব স্পষ্ট বোঝা যায়। রানুর বেশ বড় ধরনের একটা অসুখ আছে, কিছুদিন আগে বিজু প্রচুর খরচ আর খাটনি করে তাকে ইন্ডিয়া থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনলো। এখনো ওরা মেতে থাকে সেই আগের মতই। আমি আর আমরা মাঝেমাঝেই হানা দিই তদের টোনাটুনির সংসারে, দুপুরের খাবারে আলু ভর্তা কে করবে এটা নিয়ে আমার আর বিজুর মধ্যে মারামারি লেগে যায় আর রানু দেখে হেসে গড়িয়ে পড়তে থাকে...
তারপর কপট ভঙ্গিতে বিজু চেঁচায়, রানু! এই রানু! এটা হয়নি কেন! ওটা হয়নি কেন! (বিশাল একটা মুরুব্বি টাইপ ভাব নেয় আর কি)
আমিও গলা ফাটিয়ে বলি, ওরে বান্দর এত চিল্লাস ক্যান? কপালগুণে রানুর মত একখান বউ পাইছিস তাও এরকম করিস। তোর গলার জোর দেখে তো মনে হয় কোন প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার!
বিজুও দাঁত ক্যালায়, আরে প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার হবো না তো হবো কি? যেটাকে সামলাই সেটা তো কেজি ক্লাসের ছাত্রী!

সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:০৪