somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে চাঁদ দেখা প্রসঙ্গ

১১ ই মার্চ, ২০২৪ সকাল ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে চাঁদ দেখা প্রসঙ্গ

বিবরণ: সরাসরি খালি চোখ দিয়ে চাঁদ দেখাই হচ্ছে মূলনীতি। ইসলামের প্রথম যুগ থেকে এই মূলনীতির ওপরই আমল হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমান যুগে কোনো কিছুকে বড় করে দেখার জন্য টেলিস্কোপসহ আধুনিক অনেক যন্ত্রপাতিই আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে চাঁদ দেখা সম্ভব।



প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে চাঁদ দেখলে শরী'আতের দৃষ্টিতে তা কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে?
পর্যালোচনা: শরী'আতের দৃষ্টিতে চাঁদ দেখা বা না দেখাই হচ্ছে মূল ব্যাপার। রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
1 মূল বইয়ের ৩৯৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।


إِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَصُومُوا، وَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَأَفْطِرُوا

"তোমরা চাঁদ দেখে সাওম পালন করবে এবং চাঁদ দেখেই সাওম ছেড়ে দিবে"।²
তবে বর্তমান যুগের কোনো কোনো আলিম মনে করেন যে, সরাসরি চোখ দিয়ে চাঁদ দেখলেই কেবল তা শরী'আতের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে, অন্যথায় নয়। তাদের মতে, চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক এসব যন্ত্রপাতির সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে, তবে সম্পূর্ণরূপে সেগুলোর ওপর নির্ভর করা যাবে না।
পড়ুন - রোজার নিয়ত ও ইফতারের দোয়া – রোযার নিয়তের মাসয়ালা

সুতরাং খালি চোখে যদি চাঁদ দেখা না যায়, কিন্তু এসব যন্ত্রপাতির মাধ্যমে দেখা যায়, তাহলে এই দর্শন গ্রহণযোগ্য হবে না। তাদের মতে, হাদীসে গ্রহণযোগ্য চাঁদ দেখার যে বিষয়টি এসেছে, তা শুধুমাত্র খালি চোখে দেখার সাথে সম্পৃক্ত। কেননা এসব যন্ত্রপাতি রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ছিল না।
2 সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮০।



অবশ্য বর্তমান যুগের অধিকাংশ আলিমের মতে, যে কোনো উপায়েই হোক না কেন চাঁদ দেখাই হচ্ছে বড় কথা। সউদী আরবের উচ্চ উলামা পরিষদ 'মাজলিসু হাইআতি কিবারিল ওলামাও এই মতের পক্ষাবলম্বন করেছে। ১৬/৫/১৪০৩ হিজরী তারিখে পরিষদের সকল সদস্য নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তসমূহে একমত হন:
১. চাঁদ দেখার কাজে সহযোগী হিসেবে মানমন্দির নির্মাণ করা যেতে পারে, এতে শর'ঈ কোনো বাধা বা নিষেধ নেই।
২. খালি চোখে চাঁদ দেখা গেলে তা গ্রহণযোগ্য হবে, যদিও মানমন্দিরের মাধ্যমে তা দেখা না যায়।
৩. টেলিস্কোপের মাধ্যমে যদি সত্যি সত্যি চাঁদ দেখা সম্ভব হয়, তাহলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে, যদিও খালি চোখে তা দেখা না যায়। মহান আল্লাহ বলেন,

فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ﴾ [البقرة: ١٨٥]

"ফলে তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের সাওম পালন করবে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]

রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

لَا تَصُومُوا حَتَّى تَرَوْهُ، وَلَا تُفْطِرُوْا حَتَّى تَرَوْهُ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلَاثِينَ يَوْمًا»

"(রমযানের) চাঁদ না দেখা পর্যন্ত তোমরা সাওম পালন করবে না। পক্ষান্তরে (শাওয়ালের) চাঁদ না দেখা পর্যন্ত তোমরা সাওম ছেড়ে দিবে না। মেঘ বা অন্য কোনো কারণে যদি চাঁদ দেখা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে শা'বান মাস ৩০ দিন পূর্ণ করবে"।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেন,
صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ

"তোমরা চাঁদ দেখে সাওম পালন করবে এবং চাঁদ দেখে সাওম ছেড়ে দিবে। যদি মেঘের কারণে চাঁদ দেখা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে..."। উপরোক্ত হাদীসগুলোতে চাঁদ দেখার শর্তারোপ করা হয়েছে মাত্র, সেগুলোতে খালি চোখ, টেলিস্কোপ বা অন্য কোনো মাধ্যমে দেখা বা না দেখার কোনো শর্তারোপ করা হয় নি। তাছাড়া হাঁ-সূচক )المثبت( দলীল না-সূচক ((النافي)) দলীলের ওপর অগ্রাধিকারযোগ্য।
৪. চাঁদ দেখার সম্ভাবনা থাক বা না থাক মানমন্দিরগুলোর বিশেষজ্ঞ দলের নিকট চাঁদ দেখতে পাওয়ার সম্ভাব্য রাত্রিতে চাঁদ দেখার প্রয়াস চালানোর অনুরোধ করা হচ্ছে।
৫. সউদী আরবের চারটি বিভাগকে সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ যন্ত্রপাতি সম্বলিত মানমন্দির গড়ে তোলা ভাল মনে করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক মানমন্দির নির্মাণের স্থান এবং খরচ নির্ধারণ করা হবে।
৬. চাঁদ দেখতে পাওয়ার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে চাঁদ দেখার প্রয়াস চালানোর জন্য ভ্রাম্যমান মানমন্দির গড়ে তোলা হবে। সাথে সাথে তীক্ষ্মদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষদের থেকে চাঁদ দেখার কাজে সহযোগিতা নিতে হবে। তবে কাযীর নিকটে চাঁদ দর্শনকারীর শরী'আত নির্ধারিত ন্যায়পরায়ণতা প্রমাণিত হতে হবে।

চাঁদ প্রমাণের ক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশের ওপর নির্ভর করার বিধানও

বিবরণ: চাঁদ প্রমাণের জন্য চাঁদ দর্শনই ইসলামী শরী'আতে গ্রহণযোগ্য পন্থা; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশের ওপর নির্ভর করা যাবে কি? বিশেষ করে বর্তমান যুগের কোনো কোনো বিদ্যান বলে থাকেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত। কেননা আল্লাহ বলেন,
وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ ﴾ [يس:
[٣٩
"চাঁদের জন্য আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সেটি পুরাতন খেজুর শাখার আকার লাভ করে”। [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৩৯]

অন্যত্র তিনি বলেন,

الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانِ ﴾ [الرحمن: ٥]
"সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব মতো চলে"। [সূরা আর- রহমান, আয়াত: ৫] অর্থাৎ সূর্য এবং চন্দ্র সুনির্দিষ্ট হিসেব অনুযায়ী পরিচালিত, যে হিসাবের কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। অনুরূপভাবে চার ঋতুর হিসেবেরও কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তাছাড়া কোনো অভ্যাস যখন একই নিয়ম- নীতিতে চলতে থাকে, তখন তা নিশ্চয়তার ফায়দা দেয়।

তারা বলেন, বর্তমান যুগে জ্যোতির্বিদ্যা চরম উন্নতি সাধন করেছে এবং সূক্ষ্মভাবে তারকা, নক্ষত্র এবং ছায়াপথের হিসাব-নিকাশ রাখা সহজসাধ্য হয়েছে। আর সূর্য ও চন্দ্রের হিসাবতো জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণের নিকট খুব স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশকে চূড়ান্ত বলে দৃঢ়তা প্রকাশ করে থাকেন। এসব কিছুই উপরোক্ত বক্তব্যকে আরো শক্তিশালী করে। তাহলে শরী'আত যেহেতু চাঁদ প্রমাণের জন্য চাঁদ দর্শনের নিয়ম নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেহেতু জ্যোতির্বিজ্ঞানের এসব হিসাব-নিকাশ কি কোনো আমলেই আনা যাবে না? নাকি শুধুমাত্র চাঁদ না দেখার পক্ষের প্রমাণ হিসাবে এগুলোর প্রতি নির্ভর করা যাবে, চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে নয়?

পর্যালোচনা: আগের এবং বর্তমান যুগের আলিমগণ এই মাসআলায় তিনটি মত প্রকাশ করেছেন:
প্রথম মত: হানাফী, শাফে'ঈ, মালেকী এবং হাম্বলী
মাযহাবের অধিকাংশ ফকীহ'র মতে, চাঁদ দেখা বা না দেখা কোনোটার প্রমাণে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশের ওপর নির্ভর করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,
فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ﴾ [البقرة: ١٨٥]

"ফলে তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের সাওম পালন করবে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫]
উক্ত আয়াতে )الشهادة(-এর অর্থই হচ্ছে চাঁদ দর্শন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا، وَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَأَفْطِرُوا، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَصُومُوا ثَلَاثِينَ يَوْمًا
"তোমরা (রমযানের) চাঁদ দেখে সাওম পালন করবে এবং (শাওয়ালের) চাঁদ দেখে সাওম ছেড়ে দিবে। মেঘ বা অন্য কোনো কারণে যদি চাঁদ দেখা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে ৩০ দিন সাওম পালন করবে"।

অন্য বর্ণনায় এসেছে,
فَإِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا، وَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَأَفْطِرُوا، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَاقْدِرُوا لَهُ
"তোমরা চাঁদ দেখে সাওম পালন করবে এবং চাঁদ দেখে সাওম ছেড়ে দিবে। যদি (মেঘ বা অনুরূপ কারণে) চাঁদ দেখা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে (৩০ দিন) হিসাব কর"।
* সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮১০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮১। 5 সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮০।

এই পক্ষাবলম্বনকারীগণ বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাঁদ দেখার সাথে সাওম পালন এবং সাওম ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিকে শর্তযুক্ত করেছেন। সাথে সাথে তিনি উম্মতকে এমর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, ত্রিশতম রাতে যদি মেঘ বা অন্য কোনো কারণে চাঁদ দর্শন বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে তারা যেন ৩০দিন পূর্ণ করে নেয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাঁদ প্রমাণের জন্য এতসব হিসাব-নিকাশের নির্দেশ উম্মতকে দেন নি; বরং কেবল চাঁদ দর্শনের মধ্যেই নতুন মাস শুরু হওয়া না হওয়ার বিষয়টি সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। অতএব, শরী'আতের দৃষ্টিতে চাঁদ দর্শন ব্যতীত অন্য কোনো উপায় চাঁদ প্রমাণের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।

এই বিধানটি কিয়ামত পর্যন্ত শহুরে এবং বেদুঈন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। যদি সময় নির্ধারণের অন্য কোনো উপায় থাকত, তাহলে আল্লাহ তা তাঁর বান্দাদেরকে বলে দিতেন।
'রাবেত্বাতুল আলাম আল-ইসলামী-এর প্রতিষ্ঠান 'ইসলামী ফিক্বহ একাডেমী' এই মতের পক্ষাবলম্বন করেছে।

এমনকি যেসব এলাকার আকাশে বেশির ভাগ সময় মেঘ থাকে, সেসব এলাকাতেও এই বিধান প্রযোজ্য বলে মন্তব্য পেশ করেছে।
'মুনাযযামাতুত-তা'আউন আল-ইসলামী'-এর প্রতিষ্ঠান 'আন্তর্জাতিক ইসলামী ফিকহ একাডেমী' বলেছে, চাঁদ দর্শনের ওপর নির্ভর করা অপরিহার্য, তবে হাদীস এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি খেয়াল রেখে এক্ষেত্রে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
সউদী আরবের ফাতওয়া বোর্ডের স্থায়ী কমিটি 'আল- লাজনাহ আদ-দায়েমাহ লিল-বুহুছ আল-ইলমিয়্যাহ ওয়াল- ইফতা'-ও এই মত সমর্থন করেছেন।

দ্বিতীয়ত: জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য যে
কোনো শাখা কতটা উন্নতি লাভ করেছে বা করবে, সে বিষয়ে মহান আল্লাহ সম্যক অবগত। এতদসত্ত্বেও তিনি বলেছেন, )فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْةٌ﴿ ফলে তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের সাওম পালন করবে" এবং
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন ,
صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ

তোমরা চাঁদ দেখে সাওম রাখো এবং চাঁদ দেখে সাওম ছেড়ে দাও"। এখানে আল্লাহ চাঁদ দেখার সাথে সাওম পালন এবং সাওম ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিকে শর্তযুক্ত করেছেন, জ্যোতির্বিদ্যার হিসাব-নিকাশের সাথে শর্তযুক্ত করেন নি, অথচ আল্লাহ জানতেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ জ্যোতিষশাস্ত্রে এতো বেশি উন্নতি সাধন করবে।

অতএব, চাঁদ দেখে সাওম পালন করা এবং চাঁদ দেখে সাওম ছেড়ে দেওয়ার ইলাহী এই বিধানের দিকে ফিরে যাওয়া প্রত্যেকটি মুসলিমের ওপর অপরিহার্য। এই বিধানটি এক ধরণের 'ইজমা'য় পরিণত হয়েছে। ফলে যে ব্যক্তি এর বিরোধিতা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব- নিকাশের ওপর নির্ভর করবে, তার কথা ব্যতিক্রমী হিসাবে প্রমাণিত হবে এবং তার কথার ওপর নির্ভর করা যাবে না।

দ্বিতীয় মত: চাঁদ না দেখতে পাওয়া বা দেখতে পাওয়া

উভয়ের প্রমাণ হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশের ওপর নির্ভর করা যাবে। এই অভিমতটি ইবন সুরাইজ, যা ইমাম শাফে'ঈর একটি মত হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, মুত্বাররিফ ইবন আব্দুল্লাহ আশ-শিখখীর, ইবন কুতায়বা, ইবনস-সুবকী প্রমুখের বলে মনে করা হয়। অবশ্য ইবন আব্দিল বার এই অভিমতটি ইমাম শাফে'ঈ এবং মুত্বাররিফ-এর নয় বলে মন্তব্য করেছেন। ইবন হাজার রহ. বলেছেন, ইমাম শাফে'ঈ এই মতের পক্ষে নন; বরং তিনি বেশির ভাগ বিদ্যানের মতের পক্ষে।

বর্তমান যুগের আলিম সমাজের মধ্যে শাইখ আহমাদ শাকের এবং শাইখ মোস্তফা যারক্কা রহ. মনে করেন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব-নিকাশের ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভর করা যাবে।

তারা নিম্নোক্ত আয়াতটিকে দলীল হিসাবে পেশ করে থাকেন,
]اَلشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانِ ﴾ [الرحمن: ٥ "সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব মতো চলে” [সূরা আর-রহমান,আয়াত: ৫]।
তারা বলেন, মহান আল্লাহ এসব গ্রহ-নক্ষত্র বিশেষ হিসাব-নিকাশ এবং প্রজ্ঞার সাথে সৃষ্টি করেছেন, এগুলো এলোপাতাড়িভাবে প্রবহমান নয়; বরং আল- কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী এসব গ্রহ-নক্ষত্র কীভাবে চলে, সে সম্পর্কে জানতে হবে।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَلِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ [الاسراء : ١٢]

“আর যাতে তোমরা স্থির করতে পার বছরসমূহের গণনা ও হিসাব”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১২]
অন্য আয়াতে এসেছে,
هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءَ وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ مَا خَلَقَ اللهُ ذَلِكَ إِلَّا بِالْحَقِّ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ
لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ ﴾ [يونس : ٥]

“তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি সূর্যকে উজ্জ্বল আলোকময় এবং চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে সৃষ্টি করেছেন। আর এর (গতির) জন্য মনযীলসমূহ নির্ধারিত করেছেন, যাতে তোমরা বছরসমূহের সংখ্যা ও হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এ সমস্ত বস্তু যথার্থতার সাথে সৃষ্টি করেছেন। তিনি এই প্রমাণাদি বিশদভাবে বর্ণনা করেন ঐসব লোকের জন্য যারা জ্ঞানবান।” [সূরা ইউনূস, আয়াত: ৫] নিম্নোক্ত হাদীসদ্বয়কে তারা দলীল হিসাবে পেশ করে থাকেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
فَإِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا، وَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَأَفْطِرُوا، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ
فَاقْدِرُوا لَهُ»

"তোমরা চাঁদ দেখে সাওম পালন করবে এবং চাঁদ দেখে সাওম ছেড়ে দিবে। যদি মেঘের কারণে চাঁদ দেখা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে হিসাব কর"। উক্ত হাদীসে হিসাব- নিকাশ করার এবং মস্তিষ্ক ও বুদ্ধি খাটানোর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
' সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮০



অন্য হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّا أُمَّةً أُمِّيَّةٌ، لَا نَكْتُبُ وَلَا نَحْسُبُ الشَّهْرُ هَكَذَا وَهَكَذَا يَعْنِي مَرَّةً تِسْعَةً وَعِشْرِينَ، وَمَرَّةً ثَلَاثِينَ

“আমরা উম্মী জাতি। আমরা লিখি না এবং (গ্রহ- নক্ষত্রের) হিসাবও করি না। তবে মাস এরূপ এরূপ হয়ে থাকে অর্থাৎ কখনও ঊনত্রিশ দিনে আবার কখনও ত্রিশ দিনে"।'

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮০।

অনেকেই বলে থাকেন নবী করিম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিরক্ষর ছিলেন। সূরা আরাফের ১৫৭ নং আয়াতে নবীজীকে (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ‘রাসুলান নাবিইয়্যাল উম্মি’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ওই আয়াতে ‘উম্মি’ শব্দটাকে তফসিরকারকরা নিরক্ষর অর্থে অনুবাদ করেছেন। এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনের অনেক জায়গায় যেমন সূরা বাকারা ৭৮, আলে ইমরান ২০, ৭৫ নং আয়াতগুলোতে উম্মি শব্দটি নিরক্ষর পড়াহীন ও মূর্খ ব্যবহৃত হয়েছে। সূরা আরাফের ১৫৭, ১৫৮ নং আয়াতে প্রিয় নবীর (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শানে উম্মি শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

উম্মি শব্দটি আরবি ‘উম্মুন’ ধাতুর সঙ্গে সম্পৃক্ত। উম্মুন শব্দের অর্থ হচ্ছে মা বা কোনো জিনিসের মূল বা আসল। যেমন মক্কা নগরীকে ‘উম্মুল কুরা’ অর্থাৎ দুনিয়ার সব নগরীর উৎসমূল এভাবে সূরা ফাতিহাকে ‘উম্মুল কিতাব’ বা কোরআনের মূল বলা হয়। আরবি সমৃদ্ধ একটি ভাষা। একটি শব্দের অনেক অর্থ হয়ে থাকে। তাই বাক্যের ভাবধারা অনুযায়ী শব্দের অর্থ করতে হয়। অন্যথায় অনুবাদ বা অর্থ বিকৃত হয়ে যায়।

উম্মি শব্দের অর্থ যেমন মূল বা আসল, তেমনি তার অর্থ নিরক্ষর, লেখাপড়াহীন, মূর্খ ইত্যাদিও হয়। উল্লিখিত তিনটি আয়াতে (২:৭৮, ৩:২০, ৩:৭৫) এ অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সূরা আরাফের ১৫৭, ১৫৮ নং আয়াতে যেখানে নবী করিম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কথা উল্লেখ আছে সে সব আয়াতে নিরক্ষর লেখাপড়াহীন অর্থ নেয়াটা মূর্খতারই পরিচায়ক।

প্রকৃতপক্ষে যারা মূর্খ তারাই নবীজীর (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শানে ব্যবৃহৃত ‘উম্মি’ শব্দটিকে নিরক্ষর, লেখাপড়াহীন এ অর্থে ব্যবহার করেন। অথচ উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে ‘উম্মি’ শব্দটি নবী করিম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একটি বিশেষ বিশেষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং নবীজী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শানে ব্যবহৃত উম্মি শব্দটির অর্থ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে -- --ইমাম ইবনে আববাস রাঃ হতে বর্নিত -তিনি বলেন --রাসুল সাঃ এর যখন অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলো। তখন তিনি উপস্থিত সাহাবিদের বললেন, তোমার এক টুকরো কাগজ কলম নিয়ে আসো,আমি তোদের জন্য কতিপয় উপদেশ লিখে দিবো,যাতে তোমার পরবর্তীতে পথভ্রস্ট না হও।
[বুখারী শরীফ ৮/ ১৩ হাঃ নং ৪৪৩২, মুসলিম শরীফ ১৬৩৭, মিশকাত শরীফ ৫৯৬৬.]
উক্ত হাদিস থেকে প্রমান হলো রাসুল সাঃ লিখতে জবানে। আর সে কারণেই কাগজ কলম নিয়ে আসতে বলছে যাতে তিনি উপদেশ লিখে দিতে চেয়েছিলেন। ইহা রাসুল সাঃ এর নিজের পাক জবানের কথা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২৪ সকাল ১০:১৮
১৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×