আমার আম্মু বড় হয়েছে পিলখানায়। আমার নানা বিডিআর অফিসার হওয়ার কারনে সেখানেই তার বড় হওয়া।স্কুল কলেজ দুটোই ছিল রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।
আমার আম্মু তখন ক্লাস টেন এ পড়ে। বই পড়া আর ডায়রী লিখার খুব শখ। তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানার দারুন ভক্ত। আসলে তার মাধ্যমেই আমার তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানার সাথে পরিচয় । যাদের গল্প পড়ে তার কৈশোর কেটেছে আমার ও সেই গল্প পড়েই কৈশোর কেটেছে। বইয়ের প্রতি তার পাগলামীর উদাহরন দিই। এসএসসি টেস্ট পরীক্ষার আগের দিন সে বড় মামার রুম থেকে ইয়া মোটা একটা বই চুরি করে আনে। ৫০০ এর উপরে পৃষ্ঠা ছিল। সে একদিনেই ওই বই টা পড়ে শেষ করে। আমার আম্মুর টিন এজ টাইম টা ৯০ এ হওয়ার কারনে ব্যান্ড মিউজিক এর প্রতি আম্মুর একটু ঝোক ছিল। মাইলস...সোলস...রেনেসা..ফিডব্যাক..আর্ক..ওয়ারফেইজ এর নাম গুলো প্রথম আম্মুর কাছ থেকেই শোনা। আমার আম্মু ইংলিশে অনেক ভালো ছিল । লেটার মার্ক ছিল। আম্মুর লিখার হাত খুব ভালো। আমি বলবোনা আমি ভালো লিখি বাট যতটুকু আমার হিউমর এবং লিখার অ্যাবিলিটি আছে তার সবটুকুই আম্মুর কাছ থেকে পাওয়া।আমার আম্মুর ড্রিম ছিল জারনালিস্ট হওয়া। কিন্তু একটা রেস্ট্রিক্টেড মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে হিসেবে এই স্বপ্ন টা বোধহয় একটু বেশি ছিল।
অতঃপর সাংবাদিক হওয়ার পরিবর্তে তার ভাগ্যে জোটে প্রবাসী বিজনেস ম্যান।
এই ছিল আমার আম্মুর বিবাহ পূর্ব জীবনের ক্ষুদ্র বিবরন।
এরপর শুরু হলো একটি ফ্যামিলির কাহিনী।এক মা..সাথে দুই বছর ডিফারেন্সের পিঠাপিঠি সিব্লিংস। তাদের ত্রাণকর্তা তাদের বাবা। যে ফরেইন কান্ট্রি থেকে ফ্যামিলির যোগান দিয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকে আমার ধারনা ছিল বাবা হলো এমন একটা জিনিস যে প্রতিদিন দুইবার করে ফোন করতো আর মাঝে মাঝে বিদেশ থেকে কারটন ভর্তি দামি দামি চকলেট..পারফিউম আর খেলনা আনতো।
আমার আম্মু তখন তার স্বপ্ন কে ত্যাগ করে একটা ফ্যামিলি কে কিভাবে দাড় করানো যায় সেই স্বপ্নে বিভোর। তার সব চিন্তা তার দুই ছেলে মেয়ে কে নিয়ে। ছোটবেলায় আমার ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল ধরে স্কুলে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে রাতে ঘুম পাড়ানো সব কাজ টাই আম্মু করতো। এর মাঝে ছিল গোসল করানো একটু মারধোর করা আর পাশে একটা কাঠের স্কেল রেখে পড়তে বসানো। আমার আম্মু ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী। কোন ছেলের সাথে যদি আমার ঝগড়া বাধতো আর সেখানে যদি আমার দোষ নাও থাকতো তারপরেও আম্মু আমার পক্ষ নিতোনা। আমার আম্মু আমাকে বলত "তুমি কেন ওদেরকে সুযোগ দিবা?"
একজন মহিলার পক্ষে একা একটা ফ্যামিলি পরিচালনা করা মোটেও সহজ কাজ নয়। এখন ম্যাচুইরড হওয়ার পর বুঝতে পারি স্বামীর সঙ্গ ছাড়া একজন নারীর ফ্যামিলি পরিচালনা করা কতটা কষ্টের। আসলে আমি এই লিখা গুলো কেন লিখতেসি? এগুলো দিয়ে তো এই মানুষ টার আত্মত্যাগ এর বিশালতা টা বোঝা যাবেনা।
আব্বু মারা যাওয়ার পর ব্যাপারটা আরেকটু কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে। তবুও কখনো আম্মু কে আমার অভাব অপূর্ণ রাখতে দেখিনি। চাওয়ার আগেই সব পেয়েছি। কষ্ট হলেও আম্মু দিয়েছে। এখনো মাস শেষে আমার টেবিলে ক্রিম..ফ্রেসওয়াশ থেকে শুরু করে পছন্দের ডিওডোরেন্ট সবকিছুই শেষ হওয়ার আগে নতুন গুলো এসে পড়ে।
বাবার দায়িত্ব গুলোও তাকে পালন করতে হয়েছে। প্রথম রেজর..শেভিং ফোম..আন্ডারওয়্যার সবকিছুই কিনে দিতে হয়েছে আম্মু কে।
আসলে বোঝানো যাবেনা এই মানুষ টা কি করেছে আমার জন্য। আমার লাইফ স্টাইলের জন্য আমার ছোট বোন এর অনেক ইচ্ছা অপূর্ণ থাকে। আমার ছোট বোন যতটুকু বোঝে আমি হয়তো ততটুকুও বুঝি না।এখনো বাজার টা আম্মু করে । আমাকে কখনো প্রয়োজন ছাড়া কোন কাজ করায় না। আসলে আম্মু কখনো চায় না তার ছেলের এতটুকু কষ্ট হোক। আসলে আমি বোধ হয় অনেক টা সেলফিশ।
কিন্তু আমি জানি আমি আমার আম্মু কে কত ভালোবাসি। আমার আম্মু কখনো আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় নি। আমার আম্মু কখনো তার নিজের ড্রিম কে ট্রু করতে পারেনি। তাই সে আমার কোন কাজ কে সেরকম বাধা দেয় না।সে জানে মানুষের কাছে তার নিজের ড্রিম টা কতটুক মূল্যবান। আমার চিন্তা আমার মতামত কে সে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও পারিপার্শ্বিক চাপের জন্য তাকে অনেক সময় আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে হয়।
আমার আম্মু জানে নিজের স্বপ্ন কে সত্য করতে না পারার কষ্ট কত টা। তাই সে আমাকে আমার মতই থাকতে দেয়। তার জাস্ট একটাই কথা "আশিক নিজেকে ভালো রেখো এটাই আমার চাওয়া "
আমি জানিনা এই মানুষ টা কে আমি কি দিয়ে সম্মান দিবো।তার ঋন শোধ করতে পারার কোন যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আমাকে এই পৃথিবীতে পাঠায় নাই। লাইফে তাই একটাই চাওয়া বাকীটা জীবন আমার স্বপ্নের পিছু ছোটা আর আম্মু কে সঙ্গ দেয়া।
আমার আম্মুর সাথে আমার অনেক ফ্রেন্ডলি একটা সম্পর্ক। আমি কাদের উপরে ক্রাশ খাই সেগুলো নিয়ে তার সাথে আমার নিয়মিত কথা হয়।আমার ব্লগের নিয়মিত পাঠক সে। আমরা একসাথে মুভি দেখি সময় পেলে। বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক করি। বিতর্ক একসময় ঝগড়া তে পরিণত হয়। সেই ঝগড়া আবার সকালের অমলেটের সাথে নাই হয়ে যায়।
আম্মু আমাকে তুমি করে ডাকে। তার সাথে আমার ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক থাকলেও আমরা কেউ আমাদের আবেগ কে প্রকাশ করতে পারিনা। আসলে আম্মু পারে আমি পারিনা। কখনো আম্মু কে বড় হয়ে বলা হয় নাই " আম্মু তোমাকে ভালোবাসি"। কখনো আম্মু কে সব কিছুর জন্য থ্যাংক্স বলা হয় নাই।
আম্মু আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে অ্যাড থাকায় এই স্ট্যটাস তা তার চোখে পড়ার সম্ভাবনা আছে দেখে আমি প্রাইভেসি কাস্টম করে রাখবো। জানিনা ক্যানো বাট আমি এইরকম ই আবেগ টা প্রকাশ করতে পারিনা বা প্রকাশ হতে দিতে চাই না। আমাদের আম্মু-ছেলের সম্পর্ক টা এরকম ই জটিল..কমপ্লিকেটেড।
জানি আম্মু তুমি শুনবানা তারপরেও " Ashik..happy mothers day to your mother"
প্লিজ আম্মু ভালো থেকো আজীবন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৯:৫৫