রকমের সাদামাটা বাচ্চা ছিলাম।
সাদামাটা মানে একেবারেই সাদামাটা।
দাপাদাপি, গোয়ার্তুমি আবদারের
ধারেকাছেও ঘেঁষতাম না।
আমার বয়েসি ছেলেপেলেরা যখন ফিশিং গেমের মাছগুলোর নাটবল্টু খুলতে না পেরে কেঁদে
কেটে সব একসার করে তুলতো,তখন আমি
কষিটানা খাতায় হোমওয়ার্ক তুলতাম।
চুপচাপ খেয়েদেয়ে দুপুরের ভাতঘুমে ব্যস্ত
থাকতাম।
বিকেলে অন্যরা রাস্তার পাশের বালুর
ঢিবিতে চড়ে নিচে নামার রেস লাগাতো।
আমি ওপরের তলার বারান্দার গ্রিল ধরে ওদের কম্পিটিশনের নিষ্ক্রিয় দর্শক হতাম।জামাকাপড়ে আচ্ছামতো ধূলো জড়িয়ে যে সবচে' আগে গড়িয়ে নিচে পড়তো,সেই গোবেচারার জন্যে
হাতে তালি বাজাতাম।গোবেচারা বলছি এজন্য যে পোশাকে ময়লা লাগাবার অপরাধে বাড়ি ফেরার পর তাকে কানমলা বা দু তিনটা গাট্টা খেতে হতো।
এই এদের মতো ডানপিটে ছেলেবেলা হাতছাড়া হওয়াতে কোন মন্দ ব্যাপার হয়েছে বলে আমার মনে হয়
না।বরং আমার বেশ সুবিধেই হয়েছে।
পাড়াবেড়ানো মহিলা সাংবাদিক
চাচীরা আশেপাশের বাড়ি গিয়ে তিতলির
জন্যে গাদা গাদা প্রশংসা বিলিয়ে
আসতেন।
যাই হোক।
তার একটু পরে মানে টিনেজ শেষ হবে হবে
করেও হচ্ছে না সময়টাতে আমি আরেক গোছের কাজ করতাম।আমি একটা নতুন
বাহানায় আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম।
ঘন্টাখানেক এর মতো সেখানে
থাকতাম।আমার কাজ হচ্ছে গা'র ওড়না মাথায় ফেলে হাসি
হাসি মুখে বউ জাতীয় ভাব করা।আমি
হাসছি আর সামনে কেউ আমার ঘপাঘপ
ছবি তুলছে। সেই ছবি আবার আমি
কল্পনাতে প্রিন্ট করা অবস্থায় দেখতে পেতাম।বাম ডানে সরিয়ে, ওপরে বা নিচে উল্টে পাল্টে দেখে বাহবা দিতাম।কি অদ্ভুত।দিন কাটছিলো বেশ।
একদিন দুপুরবেলায় মা সেই আয়নাওয়ালা
আলমারির সামনে এনে আমায় দাঁড়
করালেন।টের পেলাম হাতের মুঠোয় কোন
জিনিশ নিয়ে এসছেন।মা জিনিশটা
আলগোছে আমার সামনে মেলে ধরলেন।
আমি হাঁ করা চোখে তাকিয়ে দেখলাম
সেটা একটা নথ।
'বিয়ের দিন এটা পড়িস' মা মুখে কেবল
এইটুকুই বললেন।আমার পানসে কৈশোরে
নথটা বোধহয় বিশাল অর্থ যোগ করলো।
সেদিন ছেলেপক্ষের সামনে নথ পড়তে
পারার লোভেই হয়তো টুপ করে বিয়েতে রাজি
হয়ে গেলাম।চুপচাপ আমি নাকে নথ ঝুলিয়ে
সংসারী কারবারে দুরন্ত হয়ে উঠলাম।আয়নায় নিজেকে দেখবার জো নেই পর্যন্ত।
সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে
একসময় মাগরিবের আযান পড়তো।অযু নিতে
গিয়ে আমি তর্জনী ছোঁয়াতাম নথে।
চলছিলো এভাবেই।
-মাঝরাত্তির
এই পর্যন্ত লিখে তিতলি বেগম হাঁপিয়ে উঠলেন।হাতের টনটনে ব্যাথাটা বেড়েছে বলে মনে হলো।
যেদিন মাতাল স্বামীর খুব বেশি মারধোর
গায়ে সইতে হয় সেদিন তিনি
ডায়েরি লিখতে বসেন।
ভাঙা হাতে আজ আর লিখতে থাকবার জো নেই।তাই নিঃশব্দে ডায়েরির কভার বোজালেন।
হঠাৎ জোছনার আলোয় আধবোজা ড্রয়ারের ভেতরটায় চোখ আঁটকে গেলো।নথের চূর্ণ হওয়া কারুকাজ চিকচিক করে জ্বলছে আর মনে করিয়ে দিচ্ছে সেইসব রাত্তিরের কথা যেসব রাত্তিরে তিতলিরা পছন্দের নথ খুইয়ে ফেলে,সাথে মায়াকাড়া আহ্লাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩১