সিগনাল সবুজ হলে আমার অবসাদ-ভাঙা শরীরটা রিকসার মোড়কে নিয়ে এগিয়ে গেলাম ইউনিভার্সিটির দিকে। জানিনা কেন, ইউনিভার্সিটির মাঠ-ঘাট-বিল্ডিং, এমনকি অচেনা জোড়া জোড়া জটলার ভীড়-গুঞ্জনও আমাকে কেমন অজানা একাকিত্বের গল্প শোনায়। পষ্ট দেখি কলাভবনের চূড়াটা নারিকেল শাখার ভীড়ে কেমন মুখ লুকিয়ে আছে। প্রচন্ড একা, পাদদেশের অনুনাদী গুঞ্জন আকাশে ওড়েনা কখনও, ছুঁয়েও যায়না ওকে। দেখি লাইব্রেরীর উত্তর কোনার দেয়ালটা কেমন নিঃসঙ্গ। বিরাট নাম-না-জানা গাছটার নরম ছায়াটুকু অনিচ্ছায় মুখে মাখছে বুঝতে পারি। আমি বিষণ্ন হই স্বভাবতই।
ওরা ক্থজন বিষণ্ন আমাকে আসতে দেখে অনিচ্ছায়। জটলার কোনায় চুপচাপ বসে আকাশ দেখতে থাকি আমি। আকাশ আর যৌথ পাখির কলহাস্য- এমন যুগল মনে হয় হয়না। ওদের গুটগুটে কথা ভেঙে ছিঁড়ে কানে আসে। আপনার পরীক্ষা শেষ হয়েছে? আমার? শেষ হয়েছে মানে, রেজাল্ট হয়ে কালি শুকিয়ে গেলো। বিসিএস দেননি? ইচ্ছা করেনা। একজায়গাতে আছি, চলে যাচ্ছে তো। আপনার অবশ্য সাবজেক্ট ভাল, বিসিএসের দরকার নেই। আমাদের বিসিএস ছাড়া উপায় নেই। আমার চুপ করার সময় হলে আরেকটা আনন্দ-টাইপ মেয়ে-কন্ঠ শোনা যায়- আমার বোনের সংসার করা শেষ। বিসিএস পুলিশে হয়েছে, পোস্টিং খুলনাতে। জামাই থাকে ঢাকা। আপনার বোনের নাম যেনো কি? সোনিয়া, না? আচ্ছা, উনাদের কি পুলিশের পোষাক পড়তে হয়? হু হয়তো.... কথা চলতে থাকে।
এইসব মানুষের ভীড়েই নিঃশ্বাস নিচ্ছি বহুদিন। সকালে মাখন-মাখা দু-পিচ ব্রেড, একটা সুন্দর ফাট, একটা গাড়ি, একটা বুটিক হাউজ, মার্কেটে ঘোরাঘুরি আর রাতে পঁয়ত্রিশ ইঞ্চি প্লাজমা স্ক্রিনে এইচবিও দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া- এর চেয়ে বড় স্বপ্ন এরা দেখতে শেখেনি মনে হয়। কয়েক মুহূর্তেই দারুণ হাঁপিয়ে পড়ি আমি। মনে হয় আগামী দশ বছর পরে এই রবার গাছের ছায়ায় কি গল্প চলবে তাও আমার জানা। কি অদ্ভুত! অগত্যা সিনাগগ গম্বুজের মাথায় নুয়ে থাকা আকাশের চিত্রকলা দেখি, একা একা। প্রচন্ড লোভাতুর কিছু হাতে আঁকা দেয়াললিখন পুণর্পঠন চলে মনে মনে। একফাঁকে চা-অলার সাথে লেনদেনও শেষ হয়। আর থেমে থেমে সেই ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ... সেদিন আড্ডা দিতে যা ভাল লাগছিল। আপনি তো চলে গেলেন। আমি ছিলাম, মাসুদ ভাই ছিল, নিম্মি আপু আর আরিফ না কি যেন নাম, ওই ছেলেটা। আমার যেতেই ইচ্ছা করছিলনা। পরে হলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে বলে চলে গিয়েছিলাম।
আসলে আড্ডায় ঠিক মজা পাইনা...। কেন? আপনি তো চুপ করে থাকেন। কথাই বলেননা। আর এমন আস্তে আস্তে বলেন, শোনাই যায়না- আরেকজনের গলা। আসলে আমাদের কথা উনার ছোট মানুষের মতো মনে হয়। না না, ও কিন্তু মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছে... ওরা কজন নিজেরাই হাসে। হাসির একটি ভঙ্গি নিজের মুখেও টের পাই। গালে হাত দিয়ে মাটিতে হেঁটে যাওয়া পিপড়ের বহর দেখি। ওদেরও কি এমন অন্তঃসারহীন আড্ডা হয়। আমার অবসাদ বাড়ে। উপস্থিতির অভাবে আরাধ্য মিটিংয়ের সাথে সাথে আড্ডারও ইতি হলে এক বিনয়ী রিকসা-শ্রমিক কাঁটাবনের বহুমাত্রিক মোড়টাতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায়।
বাকি পথটুকু ট্রাফিকের ঘামে ভেজা বিকেল, দুর্গন্ধ ডাস্টবিনের সিঁথানে বসা বয়েসী চা-অলা, ক্রিকেটের ভুত-ভবিষ্যৎ আলোচনায় কতক ইয়াং দোকানী, মোবাইলের দোকানের নারী-পুরুষে মেশানো আটপৌড়ে ভীড় আর চিলতে গলিতে ফুটবল খেলতে নামা ধোপদুরস্ত পোষাকের ধনীর দুলালগুলোকে দেখতে দেখতে নিজের ডেরায় পৌঁছি আমি। বাহির জগতের অনেক আগেই সন্ধ্যা ভাসে আমার ডেরায়। বাতিটা উস্কে দিয়ে কিছু জরুরি কাজ করবো ভেবে কম্পিউটারটা অন করলে গভীর সমুদ্রতলের রঙিন মাছটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমি হঠাৎ চুপ করে থাকি বহুকাল। পরে সেই অগ্রিম সান্ধ্য-ছায়ায় অডিও টর্্যাকটা অন করে টেবিলে উবু হয়ে বিষণ্ন অবসাদে ডুবে থাকি। দুর নির্জন মাদাগাস্কার উপকূলের পাম ট্রি আর সূর্যাস্তের ভীড় ঠেলে তখন কেঁপে কেঁপে ভেসে আসতে থাকে সানি জুবায়েরের বিষাদমাখা কন্ঠটা- ্তুআজ আমার মন ভাল নেই.....্থ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০০৬ বিকাল ৩:৫০