somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মা

০৪ ঠা মে, ২০০৯ বিকাল ৪:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাকে নিয়ে লেখতে বসে কিভাবে যে শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না। কোন দিক রেখে কোন দিকের কথা যে বলব সেটাই বুঝতে পারছি না। আমার মা, মায়ের সাথে আমার পরিচয় আমার জন্মেরও দশ মাস আগে। হা, তার গর্ভেই আমার জন্ম। তার মাধ্যমেই আমি এসেছি এই পৃথিবীতে। অজানা এই পৃথিবীতে তিনিই ছিলেন আমার একমাত্র আপন। তিনিই ছিলেন আমার একান্ত কাছে।

আমার নানার অজ পাড়াগায়ের বাড়ীতেই আমার জন্ম । মায়ের বিয়ের পর মা চলে গেলেন আমার দাদার বাড়ী। আমার দাদার বাড়ী ছিলো আরো অজ পাড়া গায়ে। বাড়ীর ছোট বউ হওয়াতে বিয়ের প্রথম দিকে মা বেশিই বাপের বাড়ী থাকতেন। বাবা থাকতেন সিলেটে। মাসে আসতেন আবার চলে যেতেন। মা একা একাই থাকতেন। এই অবস্থায় আমার নানা বাড়ীতে আমার জন্ম হয়।

মা যখন দাদা বাড়ী যেতেন তখন আমার নানা বাড়ীর জন্য সব সময়ই মন কাদত। আমার দাদা বাড়ী থেকে আসতে মাকে অনেক টাকার রিক্সা ভাড়া গুনতে হত। মা এই টাকা আস্তে আস্তে জমিয়েই তারপর আমার নানা বাড়ি আসতেন। আমার দাদা বাড়ী ছিল গ্রামের দক্ষিণ কোনায়। মার কাছে শুধুই মনে হত, ইস, তার শ্বশুর বাড়ীটা যদি উত্তর কোনায় হত তাহলে কতই না সহজে উনার বাপের বাড়ী যেতে পারতেন।

আমার মা, পড়াশুনা বেশি একটা করতে পারেননি। তিনি যখন ক্লাস এইটে তখন আমার মামা তার স্কুলে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তারপরও তিনি তার পড়াশুনা বন্ধ করা যায়নি তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিকই স্কুলে যেতেন। মা একেবারেই খারাপ স্টুডেন্ট ছিলেন না। ক্লাস নাইনে উঠার পর মামা আমার মার বইগুলো লুকিয়ে ফেলেন । এরপর থেকে মার পড়াশুনা আর এগোই নি।সেই যে পড়া বন্ধ হল তা আর হয়ে উঠেনি। আমরা যখন ছোট ছিলাম মা আমাদের পাশে বসে আমাদের বইখাতাগুলো নাড়তেন আর দেখতেন কিভাবে আমরা পড়ি। মা সবসময়ই আমাদের পড়াশুনার ব্যাপারে কেয়ারফুল ছিলেন। সেই ছোট বেলা থেকেই দেখতাম আমার মা আমাদের স্কুলের জামা কাপড়গুলো কত যত্ন সহকারে ইস্ত্রি করে দিতেন।

আমরা যখন ঢাকায় আসি তখন আমার মামাই আমাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। মায়ের জমানো টাকা ভেংগে আমাদের গাড়ি ভাড়া দিতে হয়। আমাদের ছোট্ট বাসায় আমরা মাত্র চারজন মানুষ আমি, মা-বাবা আর আমার এক বছরের ছোট বোন। গ্রামের বাড়ি থেকে আসার কারণে মার খুব বাড়ীর জন্য মন কাদত। তিনি বিভিন্ন সময় বাড়ীর জন্য কান্না কাটি করতেন। নতুন সংসারে আমাদের কিছুই ছিল না। শুধু একটা খাট দিয়েই শুরু করতে হয় আমার মায়ের সংসার।

আমার মা বিভিন্ন সময় আমার মাধ্যমে পাশের বাসার খালাম্মাদের কাছ থেকে হাওলাত নিতেন। টানাটানির সংসার হাওলাত না করলে চলতই না। আমিও এনে দিতাম সেই টাকাগুলো। একবার আমি এক বিপদে পড়লাম। আমি এক বড় ভাইয়ের লাটিম হারিয়ে ফেল্লাম। সেই লাটিম কিনে দেওয়ার মত টাকা আমার নেই। আমি কি করি? অবশেষে বুদ্ধি করে মায়ের নামে মিথ্যে বলে দশ টাকা হাওলাত নিলাম। কিছু দিনের মধ্যে ধরাও খেয়ে গেলাম। সেই পিচ্চি বয়সেই আমাকে আমার মা অনেক মানুষের সামনে কান ধরে উঠবস করালেন। সেই শিক্ষাটা আমি আজও ভুলতে পারি না।

একবার আমার মায়ের সাথে আমার বাবার প্রচন্ড ঝগড়া হয়। মা রাগ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে যান। আমি উনাকে খোজার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাই। বাসার ছাদ, বিভিন্ন বাসা এমন কি আমি রেল লাইনে পর্যন্ত মাকে খুজতে যাই। তাকিয়ে তাকিয়ে খুজছি আমার মা কোথায় আছে? হ্যা, মাকে পাওয়া গিয়েছিল । আমার মা গিয়ে ছিলেন আমার এক দাদার বাসায়। অবশেষে দাদা আমার মাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাসায় দিয়ে যান।

আমার মা বেশী শিক্ষিত না হওয়ায় ভার্সিটি কি জিনিস, তিনি তা বুঝতেন না।ওনার এক বান্ধবীর কাছে শুনলেন যে ওনার ছেলে সিলেট ভার্সিটিতে পড়ে । আমার মা মনে করেছিলেন হয়ত উনার ছেলে অনেক বড়। তাই ভার্সিটিতে পড়ে। অথচ সেই মায়ের সন্তান হয়েই আমরা দুই ভাইবোন আজ ভার্সিটি পড়ছি। আমি ভার্সিটিতে চাকরিও করছি।

আমার মা সব সময়েই আল্লাহর উপর ভরসা করার কথা বলতেন।আমি তখন ইন্টার পাশ করার পর ভার্সিটি এডমিশন দিচ্ছি। কোন জায়গায়ই আমার হচ্ছিল না। কি যে খারপ অবস্থা? তারপরও মা আমার জন্য দোয়া করতে থাকলেন। হ্যা, তারপরই কম্পিউটারের মত ভাল সাবজেক্ট এ আমার চান্স হয়। শুধু মাত্র মায়ের দোয়ার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল।

আরেকটি ঘটনা, আমার তখন অনার্স ফাইনাল এক্সাম হচ্ছে। সেই সময়ে আমি প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে গেলাম। হাসপাতালে ভর্তি করানো ছাড়া কোন উপায় ছিল না। এইদিকে আমার বন্ধুরা ছাত্রজীবনের শেষ পরীক্ষা দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। তখনও দুইটা ফাইনাল এক্সাম বাকী। আমার জন্য তিনবার পরীক্ষা পিছানো হল। আমার বন্ধুরা আর আমার জন্য ওয়েট করতে রাজী না। এইবার পরীক্ষা না দিলে একেবারে ইয়ার লস। পাক্কা এক বছর বসে থাকতে হবে। আমি এতই অসুস্থ যে পড়াশুনা কি জিনিস সেটাই ভুলে গেছি। আম্মাকে পরীক্ষা কথা বলাতে তিনি বললেন আল্লাহর উপর ভরসা কর। আল্লাহ যেন তোমাকে তোমার মঙ্গলটা দেন। সেইসময় মায়ের দোয়ার কারণেই আমি রক্ষা পেয়েছিলাম পুরা একবছর শিক্ষা জীবনের লস থেকে। আমি সুস্থ হয়েই পরীক্ষা দিতে পেরেছিলাম সেই সময়ে।

আমার মা একে বারেই কোন কিছুর প্রতিশোধ নেওয়া পছন্দ করেন না। কিছুদিন আগের ঘটনা, একটা পরিবার আমার সাথে বিশাল রকমের গাদ্দারী করল । আমি এই দিকে বলতেও পারছি না কাউকে বিষয়টা। মাকে শুধু ফোন করে বললাম আমার জন্য দোয়া করো, আমি বিশাল এক বিপদের মধ্যে আছি। আমার মা আমার জন্য দোয়া করলেন। তারপরও আমার কান্নাকাটি থামছে না দেখে আমার মা আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , কি হয়েছে বাবা? তুই আমাকে বল। কাউকে কিছু না বলার শর্তে আমি আমার মাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। তিনিও আমার সাথে কাদলেন। অবশেষে বললেন, আল্লাহ যা করে ভালর জন্য করে।তুই ওদের কোন ক্ষতি করবি না। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দে যেন আল্লাহ তাদের শাস্তি দেন।

আচ্ছা, আমি আমার মার কাছে কখন যাই। আমার যখন খুব সমস্যা আমি তখনই ছুটে যাই মায়ের কাছে। জ্বরাক্রান্ত হলে মা যদি পাশে বসে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় তখন কতই না ভাল লাগে। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে কতই না ভাল লাগে। আমার বিপদের দিনগুলোতে তিনি থাকেন আমার পাশে। একান্ত পাশে।

আর আমি! আমার অফিসের ব্যস্তার কারণে মাকে ঠিক মত সময় দিতে পারি না। মা হয়ত বললেন আমার আজকে ডাক্তার দেখাতে যাওয়া দরকার সেইসময় বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে আমি যেতে পারি না মায়ের সাথে। মায়ের অভাব গুলো বুঝতে পারি না।মাকে বিভিন্ন সময় বুঝে না বুঝে কষ্ট দেই। সেই মাই আমার পাশে থাকেন সারাক্ষণ, আমার দু:খের দিনগুলোতে তিনিই আমার সাথী। সুখের দিনগুলোতে আমি এই আমি একেবারেই ভুলে যাই আমার মাকে। মার সেই ক্লান্তি মাখা মুখের কথা একেবারেই মনে করতে পারি না। মনে থাকে না আমার মায়ের কষ্টগুলো। মাকে যখনই ফোন করে জিজ্ঞাসা করি মা কেমন আছ? তিনি কখনও শরীর খারাপ থাকলেও বলেন না যে তিনি খারাপ আছেন।

কিছু্দিন পরেই হয়ত বাংলাদেশ ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে আমাকে চলে যেতে হবে। আমার মা, আমার একান্ত কাছের মা থেকে চলে যাব অনেক দুরে। হয়ত আবার দেখা হবে দুই তিন বছর পর। এইদিন গুলো আমার মা কেমন থাকবেন? হয়ত আমি ফোন করে কথা বললে অসুস্থ অবস্থায়ই বলবেন তিনি ভাল আছেন। আমার জন্য জায়নামাজে বসে বসে দোয়া করবেন। নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আমার মা থেকে আমি আলাদা হব। আমার বউ হবে, বাচ্চা হবে। তাদের নিয়ে আমি দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবো।আর আমার মা অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকবেন এই বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মাটিতে। হয়ত আমার মা আরো অসুস্থ হবেন, একদিন মারাও যাবেন।দেশের মাটিতে এসে তার কবরের পাশে দাড়িয়ে শুধু আমি কান্নাই করে যেতে পারব।

[এই লেখাটি উৎসর্গ করলাম বর্তমান ও আগামী দিনের মা দেরকে।]
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০০৯ বিকাল ৪:৪৮
১৮টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ট্রাম্প ভাইয়ের প্রেসিডেন্সিয়াল টিমের সদস্য এর মধ্যে এই তিন জন সদস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লিখেছেন অতনু কুমার সেন , ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮

প্রথম জন হলো: জেডি ভান্স, উনি মেবি ভাইস প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। ভদ্রলোকের বউ আবার ইন্ডিয়ান হিন্দু। ওনার নাম উষা ভান্স। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট।

দ্বিতীয় জন হলো বিবেক রামাস্বামী। এই ভদ্রলোক আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসল 'আয়না ঘর' থাকতে রেপ্লিকা 'আয়না ঘর ' তৈরির প্রয়োজন নেই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩৮


স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ৫ই আগস্ট সর্বস্তরের জনতা রাস্তায় নেমে এসে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসন আমলে অসংখ্য মানুষ কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নিজের বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯






ঢাকায় নিজের বাসার ছাদ থেকে কালপুরুষ নীহারিকার ছবি তুলেছেন বাংলাদেশি অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার জুবায়ের কাওলিন। যে টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি এই ছবি তুলেছেন, সেটিও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×