অনেকদিন ধরেই ফ্রি এবং মুক্ত সফটওয়ার-এর কথা লিখব ভাবছিলাম। শুরুতেই বলে নেই লেখাটি একেবারেই সাধারণ ব্যবহার কারীদের জন্য লেখা। আমি জানি এই ব্লগে অনেক বোদ্ধা মানুষজন আছেন। কিছু ভুল ভাল বললে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
ফোস কি?:
এক কথায় ফোস মানে ফ্রি এবং ওপেন সোর্স সফটওয়ার। এটার ২-টা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে: ১) ফ্রি ২) ওপেন সোর্স। আসুন কোনটার তাৎপর্য কি জানা যাক:
২) ওপেন সোর্স:
উল্টা দিক থেকে শুরু করলাম। ওপেন সোর্স মানে হল ঐ সফটওয়ার-টা বানাতে যা যা কোড লিখা হয়েছিল, সফটওয়ারটা সেসব কোডসহ আসে। শুনলে মনে হবে আমি অত কোড ফোড বুঝিনা। ওপেন সোর্স হলে আমার কি? হুমম। কথায় যুক্তি আছে। তবে একটা কিন্তু আছে! আপনার অনেক লাভ আছে- কিভাবে?
ওপেন সোর্স সফটওয়ার গুলোর সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী হল কর্পোরেট কোম্পানীগুলো এবং কম্পুটার পড়া ছেলেমেয়েরা। এটা অনেকটা সাইন্স-এর থিওরির মত। কোন সমস্যার সমাধা করতে পারছে না কেউ, ওপেন সোর্স কোড ডাউনলোড করে খুলে দেখল অন্যরা কিভাবে সেটা করছে। অথবা কোনো কিছু ঠিক যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে হচ্ছেনা, কোড খুলে নিজের ইচ্ছামত চেন্জ করে নিলাম। সাধারণ সফটওয়ারে নিজের ইচ্ছামত যেকোনো কিছু পরিবর্তন করা যায়না।
আমার সুবিধাটা কোথায়? খেয়াল করে দেখুন- নানা প্রয়োজনে কত হাজার হাজার মানুষ এই কোড গুলো ঘাটাচ্ছে- তাই কেউ দুষ্টবুদ্ধি করে ভিতরে আপনার উপর খবরদারী করার মত কিছু ঢুকিয়ে দিতে পারবেনা। (কারণ কোড রিভিও করে অনেক মানুষ) অনেক বড় বড় কোম্পানী এ অন্যায় কাজ করেছে তাদের কমার্শিয়াল অথবা ক্লোজড সোর্স ফ্রি সফটওয়ারে - মাইক্রোসফট, সনি, এপল, রিয়েল - কেউ বাদ নেই এধরণের অপরাধ থেকে। পরে কোর্ট-এর ঝারি খেয়ে তারা সেগুলা বাদ দিয়েছে। ওপেন সোর্স-এ ধরণের কোনো ঝামেলা নেই। নিশ্চিন্তে আপনার কাজ করতে পারেন কারো খবরদারি ছাড়া।
বলা হয়ে থাকে ওপেন সোর্স সফটওয়ার গুলো সবচেয়ে সিকিউরড। এক। সহজে কেউ হ্যাক করতে পারবেনা। দুই। কোনো কারণে কোনো সমস্যা পাওয়া গেলে ১-২ দিনের মধ্যে (কখনও কয়েক ঘন্টার মধ্যে) তার সমাধান বের হয়ে যায়।
তাহলে কি কি সুবিধা পেলেন ওপেন সোর্স থেকে?
ক। কোনো কোম্পানীর বলির পাঠা হতে হবেনা।
খ। নিরাপদভাবে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারছেন।
১। ফ্রি:
হুমম... এটা মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনেকের কাছে। এটার মানে নিয়েও রয়েছে অনেক রকমের বিভ্রান্তি। ফ্রির আভিধানিক অর্থ ২-টাই হয়: ক) বিনামূল্য অথবা মাগনা খ) স্বাধীনতা। দুইটাই সত্য। দেখি কিভাবে:
ক) বিনামূল্য:
> সাধারণত আপনাকে কোনো টাকা দিতে হয়না; এর চেয়ে পরিস্কার করে বলা বোধ হয় সম্ভব না।
খ) স্বাধীনতা:
> ফোস সফটওয়ার তার ব্যবহারকারীদের উপর কিছু চাপিয়ে দিবেনা। ব্যবহারকারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে তাদের যা খুশি তা করার। ক্রাক করেন আর যাই করেন- সব লিগাল। (যদিও ক্রাক করার কোনো দরকার নাই।) এমনকি অনেক সফটওয়ার চাইলে আপনি কিছু পরিবর্তন করে নিজের ইচ্ছামত নাম দিয়ে আরেকজনের কাছে বিক্রিও করতে পারেন। তবে অবশ্যই লাইসেন্স-এর কথামত।
একেকজনের কাছে একেকটা গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ ফ্রি ব্যাপারটাকে বেশি উপভোগ করেন, কেউ স্বাধীনতা। আমার কাছে স্বাধীনতা। কেন বলি।
একটু আগেই বলছিলাম অনেক বড় বড় কোম্পানী খবরদারী করার মত অন্যায় কাজ করেছে এবং করছে। সবচেয়ে যন্ত্রনা দায়ক ছিল রিয়েল প্লেয়ার। রিয়েল প্লেয়ার ফ্রি সবাই জানেন। কিন্তু ক্লোজড সোর্স। তাই মার্কেটে আসার পর অনেকে সরল বিশ্বাসে ফ্রি খেতে ডাউনলোড করে। কয়েক বছর আগে, একটা রিলিজে রিয়েল কিছু স্পাই ওয়ার ঢুকিয়ে দিল- দেখতে ব্যবহারকারীরা কি কি করে। তারপর এটা নিয়ে অনেক হৈ চৈ হল। কিন্তু কারো কাছে স্পাই ওয়ার রিমুভ করার স্বাধীনতা ছিলনা। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ ভুগল কোর্ট নাক গলানোর আগ পর্যন্ত। একারণেই আমার চাই স্বাধীনতা।
ফোস-এর কিছু ইতিকথা:
ফোস আসলো কি করে? সেটা বোধ হয় অনেক লম্বা ইতিহাস। সহজ করে বলার জন্য; কিছু সফটওয়ার পন্ডিত এবং ছাত্র-ছাত্রী কম্পিউটারের প্রথম যুগে ('৭০-'৮০-র দিকে) তাদের কাজের সুবিধার জন্য যেসব ছোট ছোট সফটওয়ার লিখেছিল তা একজন আরেকজনের সাথে বিনিময় করত; অনেকটা আমরা যেভাবে আমাদের নোট শেয়ার করি সেভাবে। তারপর সেই নোট আবার আরেকজন ইমপ্রুভ করতে লাগল। ইন্টারনেট-এর কারণে এই শেয়ার করাটা অনেক সহজ হয়ে গেল। অনেক অনেক মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে অংশগ্রহণ করা শুরু করল। একসময়ে দেখা গেল বিশাল বড় কমিউনিটি হয়ে গেছে এদের। আর এরকম সফটওয়ার এখন হাজার-এর উপর। কিছু কিছু এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠল যে কোনো বাণিজ্যিক সফটওয়ার তাদের ধারে কাছে আসতে পারলোনা। ফায়ারফক্স ব্রাউজার- এরকম একটি সফটওয়ার (একটা বাচ্চা ছেলে তার ইন্টারনেট-এক বন্ধুর সাথে সামার প্রজেক্ট হিসেবে ফায়ারফক্স শুরু করেছিল)। আর যত ওয়েবসাইটে যান; তার বেশিরভাগ-ই চলে এপাচে নামে একটা ফোস সার্ভারে। বিশ্বের যত সুপার কম্পুটার আছে, তার ৮০%-এর উপরের কম্পিউটার ব্যবহার করে লিনাক্স- যা ফোস-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট। অনেক কোম্পানী আবার তাদের কমার্শিয়াল সফটওয়ার পরে ফোস করে দিয়েছে। যেমন সান-এর স্টার অফিস- পরে ওপেনঅফিস ডট অরগ।
এখন উবুন্তু নামে একটি প্রজেক্ট ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সাউথ আফ্রিকার এক পাগলা ধনী মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দিয়ে দিচ্ছে উবুন্তুর কাজ করার জন্য। অনেকেই ধারণা করছে মাইক্রোসফট তার বিজনেস-এর মডেল পরিবর্তন না করলে উবুন্তু উইন্ডোজ-এর মার্কেট নিয়ে নিবে। বাংলাদেশে জোড়ে সোড়েই উবুন্তুর প্রচারণা চলছে।
এরকম গল্প বলে শেষ করা যাবেনা! কিন্তু কারা করে এসব? কেন করে?
আগে বলেছি; কর্পোরেট-রা আর কম্পুটার পড়া ছেলেমেয়েরা বেশি অংশগ্রহণ করে এসব কাজে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে অন্যান্য সাবজেক্ট-এর ছেলেমেয়েরাও অনেক কাজ করে।
কেন করে? এটা একটু জটিল। একেকজনের কারণ একেক। কর্পোরেটগুলো ওপেন সোর্স-এ আসা শুরু করেছে সম্প্রতি। কারণ হল ওপেন সোর্স সফটওয়ারগুলো এখন অনেক ভাল; আর কিছু বড় সড় লোকজন এই কমিউনিটি থেকেই আসা। এখন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অনেকেই খরচ কমানোর জন্য ফোস ব্যবহার করে।
ছাত্র ছাত্রীরা অনেকেই ফোস দর্শন (ফোস ফিলোসফি)-তে বিশ্বাস করে। কেউ কেউ বায়ো ডাটা বাড়ানোর জন্য। কেউ আবার টাকা আয় করার জন্য (কিছু ফোস সফটওয়ার কিন্তু টাকা আয় করার ভাল উৎস- এর উপর আরেকদিন আরেকটা পোস্ট লেখার ইচ্ছা রইল)।
আপনি নন ট্যাকনিকেল হিসেবে কেন ফোস সফটওয়ার ব্যবহার করবেন? সব কারণ আমার মাথায় আসছেনা। এই মুহূর্তে যা মনে পড়ছে:
১। কারণ এসব সফটওয়ার ফ্রি।
২। এদের সাপোর্ট অসাধারণ। বাংলাদেশে বেশ কিছু সাপোর্ট মেইলিং লিস্ট, ফোরাম আছে যেখানে কয়েক ঘন্টার মধ্যে কেউ না কেউ আপনাকে সাহায্য করবে। অনেকে ফ্রি আপনাকে ফোন অথবা সামনে এসে ঠিক করে দিয়ে যাবে (আপনাকে না চিনলেও!)
৩। ইলিগাল সফটওয়ার চালানোর নৈতিক দ্বিধাবোধ থেকে বাঁচবেন। (উইন্ডোজ-এও ফোস সফটওয়ার অনেক ভালো চলে)।
৪। অনেক কিছু জানতে পারবেন। আপনি যদি মনে প্রাণে তরুণ হোন, নতুনকে জানতে চান, তাহলে ফোস আপনার জন্য! অনেক নন-টেক মানুষ ফোস অনেক স্বাচ্ছন্দে ব্যবহার করছে।
৫। সবার উপরে স্বাধীনতা!!
আরো জানতে চাইলে আই আর সি-তে irc.freenode.net -এ #bangladesh চ্যানেলে যোগ দিন- যে কোনো সময়- যে কোনো দিন। খেয়াল করুন- এটা ফোস বিষয়ে কথা বলার জন্য চ্যাট রুম। কেউ না থাকলে ফোরামে অথবা মেইলিং লিস্ট-এ লিখুন এখানে: বাংলাদেশে লিনাক্স বিষয়ক সাহায্যের জন্য:
(http://www.linux.org.bd/)